হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, রাজনৈতিক মতভিন্নতা ভেদে এমন প্রশ্নের অবশ্যই বিপরীতমুখী জবাব পাওয়া যাবে। একদল মুখে আত্মতুষ্টির ভাব নিয়ে বলবে, দেশ সামনে এগিয়ে চলেছে, আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে ইত্যাদি। অন্যপক্ষ হয়তো বলবে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, দেশে বিনিয়োগ নেই, দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়েছে ইত্যাদি। এই দুইপক্ষের বক্তব্যের মধ্যেই কিছু যুক্তি, কিছু তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান রয়েছে। তবে দেশের সচেতন মানুষ এই বিপরীতমুখী দাবীকে সামনে রেখেই শুধু নিজের মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনা। তারা নিজের সমাজে, ঘরে-বাইরে ও বাজারের হালচাল দেখেই নিজ মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। ঠিক এ কারণেই উন্নয়নের দাবীকে দৃশ্যগ্রাহ্য করার পরও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনে অনীহা দেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে জনগন শুধু অবকাঠামো উন্নয়নকেই সুশাসনের মানদন্ড হিসেবে গন্য করেনা। পাশাপাশি পরিসংখ্যানগত জিডিপি প্রবৃদ্ধিই যে অর্থনীতির সুষম উন্নয়ন নয় তা সাধারণ সচেতন মানুষেরও অজানা নয়। অর্থনীতির ভাষা ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে সম্পদ সসীম এবং মানুষের চাহিদা অসীম। পদার্থ বিজ্ঞানের মতে মৌলিক বস্তুর আকৃতি প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটলেও এর কোন ধ্বংস নেই। একই নিয়ম অর্থনীতিতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অনুদঘাটিত, অনুৎপাদিত সম্পদকে পুঁজিতে পরিণত করা এবং পুঞ্জিভুত সম্পদকে দরিদ্র মানুষের উপযোগিতার জন্য বন্টন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাঙ্খিত লক্ষ্য। এখানেও আমরা লক্ষ্য করব, প্রবহমানতা এবং পুঞ্জিভবনই সম্পদের মূল বৈশিষ্ট্য। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং কর্পোরেট পুঁজিবাদের একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থাপনা যখন বিশ্বের সম্পদকে গুটি কয়েক পরিবারের হাতে পুঞ্জিভ’ত করে তুলছে, তখন সম্পদের সুষম বন্টনই এ সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত অর্থনীতির সুষম বন্টন ব্যবস্থাই শান্তি, সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। আজকে আমাদের সমাজে যে বিপরীতমুখী বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছি, একদিকে সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়নের দাবী করছে অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাধারণ মানুষ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেশ পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা তুলে ধরছে। কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রেখে দেশের কয়েকশ পরিবার শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়া এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতাই হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে সৃষ্ট সামাজিক সঙ্কট। দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত করতে হলে প্রথমেই সম্পদের সুষম বন্টন ব্যবস্থার উপর নজর দিতে হবে।
বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূলে কাজ করছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফামের রিপোর্টে দেখা গেছে বিশ্বের ৮২ভাগ সম্পদের মালিক মাত্র ধনীক শ্রেনীভুক্ত মাত্র একভাগ মানুষ। আর এইসব ধনকুবেরদের ঠিকুজি খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, বিশ্বের বেশীরভাগ সম্পদ গুটি কয়েক পরিবারের হাতে। পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত ও বল্গাহীন বিকাশের কারণে একই প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা আওতায় থেকেও মানুষে মানুষে ব্যাপক পার্থক্য এবং বঞ্চনাবোধের মনোজাগতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যে নতুন মানবিক স্বত্তার জন্ম হিয়েছিল সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা না থাকলে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হবে। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণবাদের বিস্তৃতি ঘটেছিল তা শেষ পর্যন্ত বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করেছিল। অত:পর উত্তর আমেরিকায় বৃটিশ কলোনীর বিরুদ্ধে গণজাগরণ, গৃহযুদ্ধ ও মার্কিন গণতন্ত্রের যে মাইলফলক সূচিত হয়েছিল তা বিশ্বের রাজনৈতিক ধারনায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেয়। তবে অর্থব্যবস্থাকে বেসরকারী খাতের উপর নির্ভরশীল করে ফেলা এবং পুঁজির পুঞ্জিভবন এবং কর্পোরেট অর্থনীতির প্রভাব রাষ্ট্রের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কর্পোরেট অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা যেন ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যতই দিন যাচ্ছে দেশে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা এবং বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কোম্পানী ও বৃহৎ শক্তির স্বার্থরক্ষার দালালে পরিনত হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোর সরকার। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিদ্যমান গণতন্ত্রের সঙ্কট ও সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য এই পরিস্থিতিই দায়ী। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তবতা ভয়াবহ সঙ্কটপূর্ণ। প্রথমে এক-এগারো সেনা সমর্থিত সরকারের অভ্যুদয় অত:পর সেই সরকারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, অত:পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের বদলে বিএনপিকে বাইরে রেখে,এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করে, বেশীরভাগ আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতাহীন ও ভোটারবিহিন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ সম্ভাবনায় স্থবিরতা দেখা দিলেও এ সময়ে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বিনা মাশুলের স্থল ও নৌ-ট্রানজিট সুবিধা, বন্দর সুবিধা আদায় করে নিলেও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবারের প্রতিশ্রুতি সত্বেও বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। পক্ষান্তরে এ সময়ে ভারতের অনুক‚লে বাণিজ্যবৈষম্য আরো বিলিয়ন ডলার বেড়েছে সেই সাথে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভারতের বৈদেশিক রেমিটেন্স আয়ের অন্যতম বড় উৎস। এ সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মস্থানের বাজারগুলোতে এক ধরনের স্থবিরতা ও বন্ধ্যাত্ব দেখা দিলেও বাংলাদেশে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশে কর্মরত অর্ধকোটি শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার শ্রমে পাঠানো রেমিটেন্সের বিশাল অংশ বৈধ অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ভারতে গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করলেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে ভারত বিবিধ উপায়ে লাভবান হয়েছে ভারত। এ সময়ে ভারতের সাথে শুধু বাণিজ্য বৈষম্যই বাড়েনি, বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন পশ্চিমা বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তাদের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে তৈরী পোশাক রফতানীতে জিএসপি সুবিধা বাতিলসহ মার্কিন বাজারে ভারতের কাছে অবস্থান হারিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকলে, চরমপন্থার উদ্ভব হলে তা ভারতের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভারতের পক্ষ থেকে বাহ্যিকভাবে মত প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে চাপ থাকলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাক বা না থাক তাতে ভারত বা চীনের যেন কোন কিছু যায় আসেনা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মত ইস্যুতে ভারত ও চীনের ভ‚মিকা যেন মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আর বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সম্ভাব্য ক্ষমতাসীনদের সাথে বোঝাপড়ার মত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ভারতের দিকেই। ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধণ শ্রিংলা বাংলাদেশের নির্বাচনকে আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে ভারতের নাক না গলানোর একটি পরোক্ষ ইঙ্গিত দিলেও কার্যত: বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা যেন ভারতের রাজনৈতিক ইচ্ছার উপরই নির্ভর করছে। যত্রতত্র যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের কথা বলছেন, তারাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্পষ্ট বিভাজনরেখা সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্বল করছে, তাদের ঘাড়ে চেপেই বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ স্থায়ী আসন গেড়ে বসতে চাইছে। ভারতের মত বড় প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুতাপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক সম্পর্ক বজায় রাখতে যে ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ থাকা প্রয়োজন বিভাজন, বৈরিতা ও নির্মূলের রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তা তিরোহিত হয়েছে। এমনকি মিয়ানমারের মত অনগ্রসর প্রতিবেশী রাষ্ট্রও এখন বাংলাদেশকে সমীহ করেনা। রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বার বার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন এবং বেপরোয়া আচরণ বাংলাদেশের প্রতি মিয়ানমারের তাচ্ছিল্যের ভাবই প্রকাশিত হয়েছে। ভৌগলিক আয়তনে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে বেশ বড় হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের তিনগুন এবং নমিনাল জিডিপি ও অর্থনীতির আকারেও বেশ এগিয়ে থাকার পরও রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের অসহায়ত্ব ও বন্ধুহীনতার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। মানবিক কারণে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন করেছেন বটে, সেই সাথে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর তরফ থেকে নানা ধরনের সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেলেও স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে আর কখনো বাংলাদেশকে আর কখনো এমন দুর্বল, অসহায় ও বন্ধুহীন বলে মনে হয়নি। পরিসংখ্যানের হিসাবে দেশ যতই অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাক, দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিপজ্জনক বিভাজন এবং অর্থনীতিতে আকাশ-পাতাল বৈষম্য জিইয়ে রেখে কখনো আত্মমর্যাদাশীল ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ সম্ভব নয়।
আর তিন বছর পর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ। দেশের স্বাধীনতার অর্ধশতক উৎযাপন কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠির এক বিষয় নয়, এটি দলমত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এটি জাতীয় ঐক্যের বিষয়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর ঐতিহাসিক স্মরনীয় মুহূর্তটিতে গত ৫০ বছরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভ‚-রাজনৈকিভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্জনের একটি নির্মোহ অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন প্রকাশিত হওয়ার দাবী রাখে। এ কথা আর গোপন বিষয় নয় যে, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন অর্থেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ সুত্রে গত চার বছর ধরেই বাংলাদেশকে একটি পলিটিক্যাল ডায়ালগ ও ক্রেডিবল ইলেকশনের পরিবেশ তৈরীর জন্য চা দিচ্ছে পশ্চিমা সরকারগুলো। তবে বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে চীন-ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থের কাছে পশ্চিমা স্বার্থ অনেকটাই গৌণ হয়ে গেছে। অবশ্য উপমহাদেশের আর কোন রাষ্ট্রের উপর ভারতের এতটা নগ্ন হস্তক্ষেপ ও নজরদারির সুযোগ নেই যেটা বাংলাদেশের উপর রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত দেশে যে রাজনৈতিক সমীকরণ দেখা যাচ্ছে তাতে রাজনীতি ও নির্বাচনের গুনগত পরিবর্তনের কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বললেই চলে। উপরন্তু এক-এগারো সরকারের দায়ের করা দুর্নীতি মামলায় বিএনপি নেতা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হওয়ার আশঙ্কায় দেশে এখন টান টান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও রক্তক্ষয়ী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষ্ফোরক উত্তাপ বেড়ে চলেছে। যদিও নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টির সময় ও সম্ভাবনা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তবে সে ধরনের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখার জন্য যে ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা থাকা প্রয়োজন তা এখনো অনুপস্থিত এবং নেতিবাচক। দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাখতে এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মননশীলতা, সংযমী ও ত্যাগী মনোভাব থাকা প্রয়োজন বাংলাদেশে এখন তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ ও স্থিতিশীলতা না থাকায় দেশ থেকে অর্থ পাচার অব্যাহত রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে ধস ও দেউলিয়াত্ব দেখা দিয়েছে। অযৌক্তিকভাবে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষের জীবন যাপন কঠিন করে তোলা হয়েছে। এর ফলে গত বছর দারিদ্র্য বেড়েছে বলে একাধিক জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। নানাভাবে কৃষি উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ফসলের বাম্পার উৎপাদন হওয়ার পরও কৃষকের খরচ উঠেনা। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য তিন থেকে পাঁচগুন বেশী মূল্যে কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রতিদিনের এই অসম, নাভিশ্বাস রোজনামচা দেশে সম্পদের বন্টন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। সর্বগ্রাসি দুর্নীতি, অবক্ষয়, বেপরোয়া দলবাজি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজপ্রগতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের টুটি চেপে ধরেছে। এহেন বাস্তবতার দোলাচলে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সময় গুনছে দেশের মানুষ।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।