Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা নেই বলেই...

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, ভিন্নমতকে বা সমালোচনাকে সহ্য করাই গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান। কিন্তু গণতন্ত্রকে রক্ষা করার নামেই গণতন্ত্রের উপর হামলা হয়, গণতন্ত্রের মায়াকান্না গণতন্ত্র হত্যাকারীরাই করে আসছে। রাজনীতি যেমন অবৈধ টাকা ওয়ালাদের নিকট জিম্মি, অনুরূপ হত্যাকারীদের নিকট জিম্মি হয়ে পড়েছে গণতন্ত্র। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এ নিশ্চয়তা ভুলষ্ঠিত হচ্ছে বার বার। সংবিধানের ৩৫(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিক ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দন্ডিত করা যাইবে না।’ অথচ এক অপরাধের জন্য অনেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা হয়েছে। নেতাদের গুড-বুকে থাকার জন্য সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদের বরখেলাপ করে একই অপরাধের জন্য বহু মামলা হয়েছে। একই অপরাধের জন্য বিভিন্ন জেলায় মামলা আমলে নেওয়া কি সংবিধানের লংঘন নয়? এ অবস্থার মূল কারণ রাষ্ট্রে আইনের শাসন টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। গণতন্ত্র নাই বলেই আইনের শাসন আজ বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। নিম্ন আদালতগুলির এহেন আচরণ জনগণের নিকট এখন দৃশ্যমান। এসব কর্মকান্ডের মূল কারণ, জবাবদিহিতা না থাকা। জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্র সমান্তরাল গতিতে চলে। যেখানে গণতন্ত্র বিলীন হতে থাকে সেখানে জবাবদিহিতা দিন দিন জ্বালানি সংকটাপন্ন প্রদীপের মত নিভে যায়। জবাবদিহিতার জ্বালানি শক্তি হচ্ছে গণতন্ত্র। যেখানে গণতন্ত্র নাই সেখানে জবাবদিহিতা থাকে না এবং সে কারণেই গণতন্ত্র বা আইনের শাসন রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তাই আজকাল আইনের অপপ্রয়োগের মহোৎসব পালন করছে। গত ৮ জানুয়ারি ‘দ্বিতীয় বিয়ে লুকাতে ডিআইজির কান্ড’ শিরোনামে একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। সংবাদটিতে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান দ্বিতীয় বিবাহ গোপন না করায় তার স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছেন। তিন সপ্তাহ কারাভোগের পর মরিয়ম আক্তার জামিন পেয়েছেন। পুলিশী ক্ষমতার এ চিত্র গোটা বাংলাদেশের চিত্র। ক্ষমতাসীন ও তাদের রক্ষাকর্তা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতো বেপরোয়া হওয়ায় কারণ জবাবদিহিতবিহীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। দেশের বোদ্ধা মহল মনে করে, রাজনৈতিক অপব্যবহারে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে। তবে আমি মনে করি যে, ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে বিরোধী দলকে বিলীন করার কাজে আইনের অপপ্রয়োগের মধ্যে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে বলে পুলিশ এখন লাগামহীন। পুলিশ সরকারের দুর্বলতা জানে। তাই সরকারকে দুর্বল ভেবে নিজেরা নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করে। জবাবদিহিতা নাই বলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে এসপি বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পুলিশ দিয়ে নিজ স্ত্রীকে জেল খাটিয়েছেন। ওসিরা তো শুধুমাত্র স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোরঞ্জন করে সংশ্লিষ্ট থানার রাজা বনে যান। ফলে তারা ‘রাজা ভুল করে না’, এই থিউরিতেই চলছেন। পুলিশ প্রধান শহীদুল হক অকপটে স্বীকার করেছেন যে, মাদক ও জঙ্গীবাদ নির্মূল করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। সরকার বিরোধীদের দমন করতে পুলিশকে এতো ব্যস্ত থাকতে হলে রাষ্ট্রের মূল সমস্যা দূর করতে তাদের ফুরসত (সময়) কোথায়?
গত ৮ জানুয়ারি নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন যে, ‘এমপিদের সম্পদের হিসাব জনগণ জানতে চায়।’ প্রশ্ন হলো, তার মতে জনগণ যা জানতে চায় সেটা দুদক চেয়ারম্যান জানতে চান না কেন? দুদক আইন-২০০৪ এ তাকে এ ক্ষমতা দেয়া হলেও তিনি এমপিদের ক্ষেত্রে তার আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন না কেন?
দুদক আইনের ২৬ ধারা মোতাবেক, কেরানীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ প্রদান করছে, স্কুল শিক্ষকদের দুর্নীতি খোঁজার জন্য কোচিং সেন্টারে হানা দিয়েছে; কিন্তু এমপিদের দুর্নীতির প্রশ্নে আইন প্রয়োগ না করে জনগণের কাঁধে বন্ধুক রাখছেন কেন? কারণ এমপিরা সরকারি ঘরনার লোক। তারা দুদক চেয়ারম্যানের নিয়োগ দাতা, তাই দুদক আইন এমপিদের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
পুলিশ বিভাগেও দায়িত্বশীল লোক রয়েছে, তাদের সংখ্যা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে। ১৯৯৭ সালে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং ২০০৭-২০০৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীন থাকাবস্থায় দু’ জন কারা রক্ষীকে দেখেছি যে, তারা হাজতী/কয়েদীদের নিকট থেকে বাড়তি কোন সুবিধা নেয় না। ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার সেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীর সঙ্গে রাত্রিকালীন ডিউটিতে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তখন তিনি বলেছেন যে, হালাল রুজি ছাড়া এবাদত কবুল হবে না। অনুরূপ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষীও বলেছেন, আমি আমার বেতনের বাহিরে এক টাকাও কারো থেকে নেই না। এ ধরনের কিছু লোক সরকারি চাকরিতে পাওয়া যায় যারা মনে করে যে, সৃষ্টিকর্তার নিকট তার জবাবদিহিতা রয়েছে। জবাবদিহিতার অভাবই মানুষকে লাগামহীন করে তোলে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে জবাবদিহিতা নাই বলেই মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দেশের বা একটি রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে রাজনীতি। কিন্তু সেই রাজনীতিও রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ থেকে লুটেরাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ক্যাপিটালিজম বা কম্যুনিজম, ধর্মভিত্তিক বা ধর্মবিহীন রাজনীতির একটি নীতি আদর্শ আছে, যা নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। কিন্তু লুটেরাদের কোন নীতি আর্দশ নাই। যেখানে যা পাওয়া যাবে তা গিলে খাওয়াই লুটেরাদের আদর্শ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে লুটেরাদের দিন দিন কদর বাড়ছে। কিন্তু দল যখন ক্র্যাকডাউন হয় তখন লুটেরা কোথাও সংস্কারবাদী, কোথাও সুবিধাবাদী, কোথাও চেহারা পরিবর্তন করে নিজ অবস্থানে ঠিক থাকে, বিপদে পড়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
বর্তমানে লুটের একটি অভিজাত খাত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। লুটেরা বাহিনী দেশকে লুট করার জন্য রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপে সফলতা অর্জন করেছে। তারা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ব্যাংক লাইসেন্স নিয়ে জনগণের অর্থ সুকৌশলে লুটে নিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট তহবিলের ৫০৮ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থ প্রদানে ফার্মাস ব্যাংক গড়িমসি করছে, যার জন্য টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ফার্মাস ব্যাংক সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক হওয়া সত্তে¡ও ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্টের’ ৫০৮ কোটি টাকা সেখানে কেন গচ্ছিত রাখা হলো? দেশে আরো অভিজ্ঞ সিডিউল ব্যাংক থাকা সত্তে¡ও সেসব ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হলো না কেন? আজকে দেশে যদি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থাকতো, তবে নতুন করে এতোগুলি ব্যাংক পরিচালনার লাইসেন্স দেয়ার প্রশ্নে নিশ্চয় আলোচনা-সমালোচনা হতো। গণতন্ত্রের অভাবে জবাবদিহিতা নাই এবং জবাবদিহিতার অভাবে দেশকে ছিড়ে খাচ্ছে লুটেরার দল। সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবীতেই স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী স্বোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্র আজ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় জনগণ সে দাবী আদায় থেকেও বঞ্চিত। মোটা দাগে বলতে হয় যে, স্বৈরতন্ত্রকেই গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন