Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রাম্পের শাসনে নতুন কিছু নেই

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম


২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের এক বছর পূর্ণ হবে। তার এই একবছরের শাসন কালকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তার শাসনে নতুন কিছু নেই। তিনি তার পূর্বসুরিদের নীতিই বাস্তবায়ন করে চলেছেন মাত্র। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেই তিনি ধারণ করেছেন এবং সেই নীতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই তার এক বছরের শাসনামলেও বিশ্ব আগের মতই চলেছে। ইসরাইলের প্রতি সমর্থন এবং ফিলিস্তিনীদের প্রতি বৈরিতা ট্রাম্পের আমলেও আগের মতই আছে। বরং তিনি এক ধাপ এগিয়ে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন। রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্ব›দ্ব এবং বৈরিতা আগের মতই বিদ্যমান আছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বছর জুড়েই বাকযুদ্ধ চলেছে। সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব এবং পাকিস্তানের সাথে দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প আরো এক ধাপ এগিয়ে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য স্থগিত করেছেন। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে আগের মতোই অশান্তি বিরাজ করছে। ট্রাম্পের শাসনকাল নিয়ে যে যাই বিশ্লেষণ করুক না কেন আর্ন্তজাতিক রাজনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একজন গবেষক এবং বিশ্লেষক হিসেবে এ কথা আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ট্রাম্পের শাসন এবং নীতিতে নতুন কিছু নেই এবং তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কোন লাভ নেই। কারণ ব্যক্তি এবং দলের পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। দৃষ্টির গভীরতা আর প্রসারতা দিয়ে দেখলে বিষয়টি সবার কাছেই পরিষ্কার হবে।
ডোলান্ড ট্রাম্প এখন পৃথিবীর একক পরাশক্তি এবং ৯৬ লক্ষের ও বেশি বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ কোটি জনগণের প্রেসিডেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাই বিশ্বে শান্তি, গণতন্ত্র এবং স¤প্রীতির প্রতিষ্ঠায় তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। একইভাবে বিশ্বে অশান্তি এবং হানাহানি সৃষ্টির জন্য তিনিই বেশি দায়ী। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, সেখানকার শাসনের গতিপ্রকৃতি এবং পররাষ্ট্রনীতি একটি নির্দিষ্ট নীতিতে পরিচালিত হয় বিধায় আগের দল বা ব্যক্তির গৃহীত পদক্ষেপ পরবর্তী দল বা ব্যক্তির আমলেও অব্যাহত থাকে। ফলে ফরেন পলিসিতে তেমন কোন পরিবর্তন আসে না এবং বিশ^ব্যবস্থা আগের মতই চলে। তাই যুক্তরাষ্ট্রে কোন দল ক্ষমতায় এলো এবং প্রেসিডেন্ট পদে কে অধিষ্ঠিত হলো তা নিয়ে চিন্তা এবং গবেষণা না করে আমাদের উচিত হবে নিজেদের অধিকতর যোগ্য এবং শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। আর এর মাধ্যমেই কেবল নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন এবং ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব। কারণ শক্তি হচ্ছে শান্তি এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭২ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু সেই ১৯৪৫ সালে জাপান, জার্মানি ও ইতালির পরাজয়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সেইসব দেশ পুনর্গঠন ও নিরাপত্তার নামে মার্কিনীরা সেখানে যে সৈন্য মোতায়েন এবং ঘাঁটি করেছিল তা কিন্তু এখনো বহাল আছে এবং সেই সৈন্য প্রত্যাহারের আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের আগে সমগ্র আরব জাহানে, এমনকি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কোন দেশেই একজন মার্কিন সৈন্যও ছিল না। কিন্তু আজ ১৬টি মুসলিম দেশে মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি রয়েছে। এসব দেশ হচ্ছে, বাহরাইন, কুয়েত, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, আরব আমিরাত, ইয়েমেন, জিবুতি, মিসর, তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও ইরাক। ১৯৯১ সালে কুয়েত মুক্তির নামে এবং সাদ্দামের হাত থেকে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আমিরাত প্রভৃতি দেশকে তথাকথিত রক্ষার নামে সেই সব দেশে মার্কিনীরা যে সৈন্য মোতায়েন ও সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিল, কুয়েত মুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এমনকি তথাকথিত তাদের সেই ভয়ের উৎস সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ফাঁসি দিলেও মার্কিনীরা কিন্তু সেই সব দেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। অথচ আজ তো সাদ্দাম নেই। একইভাবে কিউবা এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী নীতিরও কোন পরিবর্তন হয়নি। রাশিয়া এবং চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শত্রæতাও কমেনি। ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত আছে। ফলে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় বিভিন্ন ব্যক্তিরা এসেছেন। কিন্তু ফলাফল একই। ওবামার আমলেও ইরাক-আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব অব্যাহত ছিল। গুয়ানতানামো কারাগারও বন্ধ হয়নি। অধিকন্তু ওবামার শাসনামলেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি এবং চল্লিশ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটোর নেতৃত্বে সামরিক আগ্রাসন পরিচালিত হয়েছে। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফীকে হত্যা করা হয়েছে। লিবিয়া আজ বহু খÐে বিভক্ত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। মিসরের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতন সবই ওবামার শাসনামলেই হয়েছে। ওবামার আমলেই ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ওবামার আমলেও অব্যাহত ছিল এবং ট্রাম্পের আমলেও অব্যাহত আছে।
যে সমস্ত মানুষ ট্রাম্পের শাসনে উদ্বিগ্ন এবং ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখর তাদের বলছি, অহেতুক টেনশন করার দরকার নেই। আর এতে কোন লাভও নেই। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন অত্যন্ত খারাপ মানুষ। অতএব তিনি বিশ্বে আগ্রাসন এবং যুদ্ধ ছড়িয়ে দেবেন। তিনি বিশ্বে হানাহানি শুরু করবেন এবং অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প যদি যুদ্ধ বিগ্রহ বাঁধিয়ে দেন তাহলে সেটা তো নতুন কিছুই নয়। কারণ পৃথিবীর দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ তো চলছেই। বছরের পর বছর ধরে সেটা প্রবাহমান। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যটদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। তাই তাদের ক্ষমতারোহণ এবং ক্ষমতা থেকে বিদায়ে বিশ্বের রাজনীতিতে কোন প্রভাব পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ২৪২ বছরের ইতিহাসকে যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে, এর প্রায় অর্ধেক সময় শাসন করেছে রিপাবলিকানরা এবং বাকী অর্ধেক সময় শাসন করেছে ডেমোক্র্যটরা। কিন্তু উভয়ের শাসনামলেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি একই ছিল। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সেই শুরু থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এই নির্যাতনের পরিমাণ ডেমোক্র্যট আর রিপাবলিকানÑউভয়ের শাসনামলেই সমান। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে উদারপন্থী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। অথচ তার আমলেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি মার্কিন আচরণ একই ছিল এবং ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ও ইসরাইলের পক্ষে জাতিসংঘে সবসময় ভেটো প্রয়োগ করেছিল। ক্লিনটনের শাসনামলেই বসনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সার্বরা চালিয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ, যাতে কয়েক লক্ষ নিরাপরাধ মুসলমান মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। সেদিন কিন্তু নিরাপরাধ মুসলমানদের বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এগিয়ে আসেনি। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ কুয়েত উদ্ধারের নামে ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং সেই সময় কুয়েত এবং সৌদিআরবসহ আরো কয়েকটি উপসাগরীয় মুসলিম দেশে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি গড়েন। পরবর্তীতে ডেমোক্র্যটরা ও তাদের নেতা ক্লিনটন আট বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও কিন্তু কুয়েতসহ এসব উপসাগরীয় দেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেননি, ঘাঁটিও বন্ধ করেননি। বরং সেখানের ঘাঁটিসমূহকে মজবুত করেছেন। পাকিস্তান এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বরাবরই এক। ইসরাইলকে সমর্থনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও বরারবই এক। সুতরাং রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যটদের যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন এবং ব্যক্তি হিসেবে যেই প্রেসিডেন্ট হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তনীয়। আর ট্রাম্পের অভিবাসী এবং মুসলিম বিরোধী নীতি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে তো লাভ নেই। কারণ মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলা, হিজাবকে কটাক্ষ করা, মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন এবং ইসরাইলের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনÑ সবই তো আগের প্রেসিডেন্টদের আমল থেকে চলমান। পার্থক্য শুধু এটাই, ট্রাম্পের আগের প্রেসিডেন্টরা সরাসরি মুসলিম বিরোধী কথা বলেননি, কিন্তু ট্রাম্প বলছেন। আর একটা পার্থক্য হচ্ছে ট্রাম্প একটু কথা বেশি বলেন, তাই তাকে নিয়ে একটু বেশি হই চই। কিন্তু কাজের বেলায় সবাই সমান। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা এবং সত্য কথা। সুতরাং ট্রাম্পের শাসন নিয়ে না ভেবে আমাদের উচিত হবে আগামীতে পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিজেদেরকে তৈরি করা। আর মুসলমানদের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। যখন সংহতি ও শক্তি থাকবে তখন সবাই স্যালুট করবে। যুক্তরাষ্ট্র দুই নীতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সাহায্য করে থাকে। একপক্ষকে সাহায্য করে সমৃদ্ধ করার জন্য, আর এক পক্ষকে সাহায্য করে বশীভূত করার জন্য। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সাহায্য করে ইসরাইলকে সমৃদ্ধ করার জন্য। আর মিসর-পাকিস্তানকে সাহায্য করে তাদেরকে বশীভূত করে রাখার জন্য। সুতরাং শক্তি অর্জনের বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা সত্তে¡ও অনেক দেশ কিন্তু নিজেদের যোগ্য করার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, সুদান, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, ভিয়েতনামসহ অনেক রাষ্ট্রই তার বাস্তব উদাহরণ। সুতরাং ট্রাম্পের শাসনামল কেমন হবে, তার শাসনামলে বিশে^ অশান্তি বাড়বেÑ এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে টেনশন না বাড়িয়ে বরং নিজের এবং নিজের দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রাম্প


আরও
আরও পড়ুন