Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ঝামেলার মূলে ওজন মেশিন এক্সেল লোড নীতিমালা নিয়ে ষড়যন্ত্র

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভোগান্তি -৫

| প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : যানজটমুক্ত মহাসড়কে যানজটের মূলে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা। টোল আদায়ে ধীরগতির সাথে রয়েছে ওজন পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট ঝামেলা। ওজন পরিমাপ করতে গিয়ে চালক ও শ্রমিকদের সাথে বাক-বিতন্ডা লেগেই থাকে। এতে যেমন সময় নষ্ট হয়, তেমনি টোল প্লাজা ও ওজন করার জন্য গাড়িগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগীতাও যানজটের সৃষ্টি করে। এই ওজন পরিমাপক যন্ত্র নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতিরি সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী অভিযোগ করে বলেছেন, টোল প্লাজার ওজন মেশিনটি সঠিক ওজন দেয় না। এটি একেক সময় একেক রকম ওজন দেখানোর কারনে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চালক ও শ্রমিকদের সাথে বাকবিতন্ডা লেগে থাকে।
আবার ট্রাক ও কাভার্ঢভ্যান চালক ও শ্রমিকদের অভিযোগ, ওজন পরিমাপক যন্ত্রটি নষ্টের সুবাদে সেখানকার কর্মচারিরা দুর্নীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদেরকে ঘুষ দিলে ওজন কমিয়ে দেখানো হয়। আর ঘুষ না দিলে ওজন বেড়ে যায়। এ নিয়েও প্রতিনিয়ত ঝামেলা হয়। আর এতে করে গাড়ির দীর্ঘ সারি থেকে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ভুক্তভোগিদে যাত্রী ও চালকদের মতে, চার লেনের মহাসড়ক ধরে এসে টোল প্লাজা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রের লেনে যেতে একেকটি যানবাহনকে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা বা কোনো কোনো সময় তারও বেশি সময় আটকে থাকতে হচ্ছে। আবার টোলবুথ অতিক্রমের পর সেতুতে ওঠার আগে যানবাহনগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। টোলপ্লাজায় প্রবেশের আগেও চলে একইরকম প্রতিযোগিতা। এ কারনে সেখানেও কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে।
জানা গেছে, গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে ওজন মেশিনে কড়াকড়ি আরোপ করার পর থেকে ঝামেলা বেড়েছে। ওই দিন কার্যকর করা হয় এক্সেল লোড নীতিমালা। এর আওতায় নির্ধারিত সীমার বেশি পণ্য পরিবহনে শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ নীতিমালা বাতিল করার জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জোর তদবির করছেন ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা।
নীতিমালা অনুযায়ী, দুই এক্সেলের ছয় চাকার ট্রাকে সর্বোচ্চ ২২ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে। তিন এক্সেলের ১০ চাকার ট্রাকে পণ্য পরিবহন করা যাবে ৩০ টন। আর চার এক্সেলের ১৪ চাকার মোটরযানে পণ্য পরিবহন করা যাবে ৪০ টন। নির্ধারিত ওজনের তুলনায় শূন্য দশমিক এক শতাংশ বেশি পণ্য পরিবহন করলে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হবে। ২০ শতাংশ বেশি পণ্য পরিবহনের জন্য জরিমানা গুনতে হবে ১২ হাজার টাকা। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে দ্বিগুণ জরিমানার পাশাপাশি অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা আদায় করা হবে।
তবে শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করছেন ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা। পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে তারা এ সীমা আরও বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ট্রাক বা ট্রেইলারে অতিরিক্ত পণ্য বহনের কারণে রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। তাহলে একই সড়কে ১০ চাকা ও ১৪ চাকার মোটরযান চলার অনুমতি দেওয়ার কারণ কী? অথচ ১০ চাকার ধারণক্ষমতা ৩০ টন ও ১৪ চাকার ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৪০ টন। এসব ভারী যানবাহন চলাচলে সড়কের আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার কথা।
জানা গেছে, ছয় চাকার ট্রাকে ভারতে পণ্য পরিবহন করা যায় ১৬ দশমিক ২০ টন। একই ধরনের ট্রাকে বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে ২২ টন। আর ছয় চাকার ট্রাকে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য পরিবহনে অনুমতি দিয়েছে নেদারল্যান্ডস। দেশটিতে এ ধরনের ট্রাকে সাড়ে ২১ টন পণ্য পরিবহন করা যায়। একই অবস্থা ১০ ও ১৪ চাকার পণ্যবাহী মোটরযানেও। এর পরও অনুমোদিত সীমায় পণ্য পরিবহনে রাজি নন ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা। এজন্য এক্সেল লোড নীতিমালা বাতিল করার জন্য চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র।
এদিকে, সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা পরিবহণ মালিকদের যুক্তিকে সম্পূর্ণ অকার্যকর যুক্তি বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, যখন মোটরযানে এক্সেল ও চাকার সংখ্যা বাড়ে তখন এর ভার বিভক্ত ও বিস্তৃত হয়ে যায়। ফলে বেশি এক্সেলের মোটরযানে অধিক পণ্য পরিবহন করলেও সড়কের কোনো ক্ষতি হয় না। তাই সড়ক অবকাঠামো রক্ষার্থে এক্সেল লোড নীতিমালা প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। সময় এসেছে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার। আর দেশের বিদ্যমান সড়ক কাঠামোতে নির্ধারিত সীমাই উপযুক্ত নয়, এটি আরও কমানো উচিত।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, বিশ্বে বর্তমানে সবচেয়ে উন্নতমানের সড়ককাঠামো রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। অথচ এসব দেশে দুই এক্সেলের ট্রাকে গড়ে ১৮-১৯ টন পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়। তিন এক্সেলের ট্রাকে এর পরিমাণ ২৪-২৬ টন। আর চার এক্সেলের মোটরযানে পণ্য পরিবহনের অনুমতি রয়েছে গড়ে ৩৬-৩৮ টন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ সীমা আরও কম। অথচ বাংলাদেশে এ সীমার চেয়ে অনেক বেশি পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের প্রকাশিত ‘অপটিমাইজেশন অব এক্সেল লোডস অব কমার্শিয়াল ভেহিক্যালস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রাক-লরিতে পণ্য পরিবহনে অনুমোদিত সর্বোচ্চ লোড তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডসে দুই এক্সেলের ট্রাকে সাড়ে ২১ টন পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিন এক্সেলের ট্রাকে এ পরিমাণ ৩৩ টন আর চার এক্সেলের মোটরযানে ৪০ টন। এটি ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ হার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের সব দেশে এক্সেল লোড নীতিমালা রয়েছে এবং তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। শুধু বাংলাদেশেই এ নীতিমালা নিয়ে যত টালবাহানা করা হয়। পরিবহন মালিকদের চাপে এরই মধ্যে এ খাতে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে করে দ্রæত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক।
সওজ সূত্র জানায়, ২০১২ সালে প্রথম এক্সেল লোড নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ওই বছর বছর ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর করার কথা ছিল। এতে দুই এক্সেলের ট্রাকে সাড়ে ১৫ টন, তিন এক্সেলে ২৫ ও চার এক্সেলের মোটরযানে ৩২ টন পণ্য পরিবহন সীমা ধার্য করা হয়। তবে ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকদের বাধায় তা স্থগিত করা হয়। পরে আলোচনা সাপেক্ষে কয়েক দফা পিছিয়ে দেওয়া হয় এক্সেল লোড নীতিমালা। পাশাপাশি বাড়ানো হয় এর সীমাও।
ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক এবং শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ডিসেম্বরের পর থেকে এক্সেল লোড নীতিমালা অনুযায়ী কড়াকড়ি আরোপ করার পর থেকে ওজন মেশিন নিয়ে ঝামেলা বেড়েছে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে একেকটা গাড়ি ওজন করতে সময় লাগছে কয়েক গুণ বেশি। এতে করে যানবাহনের ধীর গতি থেকে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।



 

Show all comments
  • ইমতিয়াজ ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ৪:১৩ এএম says : 0
    ধারাবাহিক এই নিউজটি করায় নূরুল ইসলাম ভাইকে ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহাসড়ক

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২১ ডিসেম্বর, ২০২২
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ