হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান প্রশ্নে প্রায় সত্তুর বছর ধরেই দুই রাষ্ট্রের সমাধানের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও মধ্যস্থতা পেয়ে আসছে। প্রথমত: বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ রেজুলেশনে জেরুজালেমকে বিশেষ মর্যাদা ও আন্তর্জাতিক প্রশাসনের হাতে রেখে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। শতকরা দশভাগের কাছাকাছি জনসংখ্যা নিয়ে একটি কৃত্রিম ইহুদি রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া অস্তিত্ব স্বাভাবিকভাবেই আরবরা মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে জাতিসংঘ রেজুলেশন পাস হওয়ার পর পরই ইহুদিরা ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষনা করে বসে এবং ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাবিত পশ্চিমা বিশ্ব তা’ সমর্থন জানায়। ইহুদিরা ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছে হাজার বছর ধরে। তবে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ায় ঊনবিশং শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ইহুদিরা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করতে পারেনি। মূলত ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে প্রথম জায়নিস্ট কংগ্রেসের আগে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বা পরিকল্পনা ছিলনা। বলকান যুদ্ধের পর উসমানীয় খিলাফতের পতন ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব হাতে নেয়া এবং সেখানে চুড়ান্তভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রকল্প হাতে নেয় বৃটিশরা। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আরব জাতিয়তাবাদের ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের টোপ ফেলে তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহী করে তোলা এবং জাজিরাতুল আরবকে ভাগ করে কয়েকটি আরব গোত্রপতিকে রাজা বানিয়ে দেয়ার শর্তে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে তাদের সমর্থন আদায় করে নেয় (সাইক-পাইকট/হুসেইন-ম্যাকমোহন সমঝোতা) বৃটিশ ও ফরাসীরা। সে সব ঐতিহাসিক বির্তক বাদ দিলে, সহজভাবে বলা যায়, ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে এই রাষ্ট্রের প্রতি আরব প্রতিবেশিদের সমর্থন আদায় এবং উদ্বাস্তু ও ভাগ্যবিড়ম্বিত ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান নিশ্চিত করা এক জটিল আবহ ধারন করেছে। প্রথমে একই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে ইহুদি ও মুসলমানদের সমান আইনগত অধিকার ও সুযোগ সুবিধাসহ একটি কনফেডারেট রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব নিয়ে ভাবা হয়েছিল, যা’ ওয়ান স্টেট বা এক রাষ্ট্র সমাধান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সে প্রস্তাবেও বায়তুল মোকাদ্দাসসহ পূর্ব জেরুজালেমকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তাকে একটি নিরপেক্ষ বৃহৎ শক্তির দ্বারা পরিচালিত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যদিও সাধারণ আরবরা অভিবাসি ইহুদিদের নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। বলাবাহুল্য ইহুদিরা ইসরাইলকে তাদের জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনিরাও প্রস্তাবিত স্বাধীন প্যালেস্টাইনকে নিজেদের জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চায়। এসব বিষয়ে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলীরা কঠোরভাবে আপোসহীন ভ‚মিকা গ্রহণ করার কারণেই দ্বিজাতি ভিত্তিক সমাধানের ক্ষেত্র তৈরী হয় এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষেই জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হলেও অদ্যাবধি আরবরা ইসরাইলকে মেনে নেয়নি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় নব্বইয়ের দশকে শুরু হওয়া আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার মূল থিম ছিল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন তথা দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধান।
জাতিভেদ ও মুসলমানদের প্রতি কমিউনাল হিন্দু এলিটদের ঘৃনা(¤েøচ্ছ, অস্পৃশ্য) এবং বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আগমুহুর্তে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু যেমন ভারত বিভাজনে দ্বিজাতিভিত্তিক সমাধানকে অনিবার্য করে তুলেছি। ঠিক একইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উপর সংখ্যালঘু ইহুদিদের চরম বিদ্বেষ এবং ১৯৩৭ সালের ইহুদি-মুসলিম রায়ট ফিলিস্তিনের আরব-ইহুদিদের জন্য দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়। ১৯১৭ সালের বালফোর ডিক্লারেশনে ফিলিস্তিনের ভ‚মিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও আদতে তা যে কোন বাস্তবসম্মত প্রস্তাব বা পরিকল্পনা ছিলনা তা যথাসময়ে পরিস্কার হয়ে গেছে। ১৯৩৬-৩৯ সালে সংঘটিত আরর রিভল্টের সময় বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে মাইগ্রেট হওয়ার পরই আরব-ইহুদি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। দাঙ্গার পর এ ক্ষেত্রে বৃটিশদের প্রথম উদ্যোগটি ছিল আরব রিভল্ট এবং দাঙ্গা পরবর্তি বৃটিশ নীতি এবং ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত নির্ধারণে একটি স্বেতপত্র প্রকাশ। ১৯৩৯ সালের মার্চে লন্ডনে আরব-জায়নিস্ট কনফারেন্স লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর নেভিল শেম্বারলেইনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির হোয়াইট পেপারে আরব ও ইসরাইলীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সেই সাথে পরবর্তি ১০ বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভ‚মির প্রতিশ্রুত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। হোয়াইট পেপারে প্রস্তাবিত নীতিমালার মধ্যে পরবর্তি ৫ বছরে ফিলিস্তিনে বহিরাগত ইহুদি অভিবাসির সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশী না হওয়া(আরবদের মতামত সাপেক্ষে) এবং আরবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধিসহ বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে আরবদের জমি ইহুদিদের কাছে বিক্রির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হয়। স্বেতপত্রটিতে মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের কিছু কৌশল আরোপ করা হলেও এটি ছিল মূলত একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি নির্মানে আরবদের প্রাথমিক সর্মথন আদায়েরই কৌশল। তবে এই স্বেতপত্রের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেলেও ফিলিস্তিনের আরবরা তা’ প্রত্যাখ্যান করে। মহাযুদ্ধে বৃটিশদের প্রতি আরবদের সমর্থন অব্যাহত রাখতে ইহুদি অভিবাসন এবং ভ‚মি অধিগ্রহন ৫ বছর বন্ধ থাকলেও সময়সীমা পার হওয়ার পর তারা ব্যাপকহারে বহিরাগত ইহুদিদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসে এবং দরিদ্র আরবদের ভ‚মি কিনে নেয়ার পাশাপাশি জবরদস্তি জমি দখলের মাধ্যমে ইহুদি অধিগ্রহনের আয়তন বাড়াতে থাকে। ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদি নীলনকশায় ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুরু থেকেই দ্বিজাতিত্বাত্তিক সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করেছে। লক্ষ্যনীয় যে, ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বরে পাসকৃত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৮১ নম্বর রেজ্যুলুশনে বৃটিশ মেন্ডেট প্যালেস্টাইনে আরব ও ইহুদিদের জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন এবং জেরুজালেমের আন্তর্জাতিক মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিন প্রশ্নে সাধারণ পরিষদের সবর্শেষ রেজুলেশনটি পাস হয় ২১ ডিসেম্বর২০১৭ তারিখে। সেখানে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর এবং ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির নিন্দা জানানো হয়। একইভাবে ১৯৪৮ সালের ৫ই মার্চ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৪২ নম্বর রেজুলেশনে একটি প্যালেস্টাইন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এরপর গত ৭০ বছরে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান প্রশ্নে ২ শতাধিক প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর ২৩৩৪ নম্বর রেজুলেশনে অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরাইলের নতুন বসতি নির্মান বন্ধের প্রস্তাব করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় ন্যায়ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে থাকলেও আরব-ইসরাইল সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ শুধুমাত্র প্রস্তাব পাস করেই তার দায়িত্ব শেষ করেছে। ইঙ্গ-মার্কিন ভেটোর কারণে বার বার বিশ্বসম্প্রদায়ের চুড়ান্ত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ভেস্তে গেছে।
আরব ও মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক সমাধানের পথ মেনেই নিয়েছিল। এর মানে হচ্ছে ফিলিস্তিনের ভূ-খন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে পরোক্ষভাবে মেনে নেয়া। গত চার দশকে কয়েকটি আরব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের প্রকাশ্য ও গোপন কৌশলগত সমঝোতা হতেও দেখা গেছে। সীমিত পরিসনে হলেও কোন কোন মুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ আরব ও মুসলমানদের চোখে এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষনে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটি ধীরে ধীরে সামাজিক রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেছিল। অবৈধভাবে ভূমি অধিগ্রহন, নতুন সেটেলমেন্ট স্থাপন এবং ফিলিস্তিনি জনগনের উপর বার বার সামরিক আগ্রাসন এবং আল আকসা মসজিদের উপর খবরদারি ও কর্তৃত্ব না ফলালে হয়তো এতদিনে ইসরাইল আরবদের কাছে প্রতিবেশি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারত। দুই রাষ্ট্র সমাধানের জন্য মধ্যস্থতাকারি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚মিকা নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও ভনিতা থাকলেও গত ২৫ বছর ধরে চলে আসা এই শান্তিপ্রক্রিয়ার কফিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নন, গত ৭০ বছরের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পই হচ্ছেন প্রথম কোন রাষ্ট্রপ্রধান যিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক অবস্থানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক মর্যাদার আসন পাওয়া জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা নিকটতম মিত্ররাও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ‚মিকা ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিক সমাজও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকার বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে। শুধুমাত্র ইসরাইল এবং মার্কিন বশংবদ কয়েকটি ক্ষুদ্র গৌণ রাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া ট্রাম্পের জেরুজালেম নীতিকে বিশ্ব সম্প্রদায় প্রত্যাখ্যান করায় এর তেমন কোন মূল্য না থাকলেও ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে আরব-ইসরাইল মধ্যস্থতাকারি হিসেবে মার্কিনীদের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা চিরতরে পরিত্যাজ্য হল। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’শ্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের স্থান থেকে ক্রমে বিচ্যুত হতে শুরু করে। টিপিপি চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ক্লাইমেট চেঞ্জের মত আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ও ইনিশিয়েটিভ থেকে সরে যাওয়ার পর ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম ইস্যুতে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবনমনের বাস্তব উদাহরণ। দুই রাষ্ট্রের সমাধানের ক্ষেত্রে জেরুজালেমের মর্যাদার প্রশ্নটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এর সাথে একদিকে রয়েছে বিশ্বের প্রায় ২শ কোটি মুসলমানের ভাবাবেগ ও সমর্থনের প্রশ্ন, অন্যদিকে খৃষ্টান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতিগত অবস্থান। দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেরুজালেম নীতি ঘোষিত হওয়ার পর আরব ও মুসলিম বিশ্বের কাছে এখন ওয়ান স্টেট সলিউশনের নীতি গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মর্যাদার প্রশ্নে সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যে ও আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে প্রতিয়মান হচ্ছে, ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখাকে মেনে না নিলে আরব ও মুসলিম বিশ্ব ইসরাইলমুক্ত ফিলিস্তিনের পথেই হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে।
জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষনার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের যুদ্ধবাদি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিশ্বসম্প্রদায়ের দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রক্রিয়া থেকে সরে দাড়িয়েছে। যদিও তারা এখন দুই রাষ্ট্র সমাধানে একটি বিকল্প প্রস্তাব হাজির করতে চাচ্ছে। তবে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদ ও জেরুজালেমকে বাদ দিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বিশ্বের মুসলমানরা কখনো ভাবতে পারেনা। ফিলিস্তিনিরা সত্তুর বছর ধরে যে রক্তাক্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তার পেছনে শুধুমাত্র একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি আবাসভ’মির স্বপ্ন নয়, শতকোটি মুসলমানের প্রাণের দাবী বায়তুল মোকাদ্দাসকে জায়নবাদি ইহুদিদের কবল থেকে মুক্ত করাই সবচে বড় লক্ষ্য। অন্যদিকে জায়নবাদি ইসরাইলীরা পুরো ফিলিস্তিনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর হাজার হাহার কিলোমিটার ভ‚মি দখল করে গ্রেটার ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। ইরাক,লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন, তুরস্ক, ইরাণসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে অস্থিতিশীল (ডি-স্ট্যাবিলাইজ), বলকানাইজড ও ক্ষন্ড-বিখন্ড করে ফেলার নীল নকশা সামনে রেখে সেখানে সরকার বিরোধি বিদ্রোহ উস্কে দেয়া এবং আইএস, দায়েশসহ বিদ্রোহী ও মার্সেনারি বাহিনীগুলোকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়ার পেছনের অনুঘটক হিসেবে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের পশ্চিমা ও আঞ্চলিক মিত্ররা এবং ইসরাইল। বৃহদ পরিসরের কর্ভাড অপারেশনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করে গ্রেটার ইসরাইল গড়ে তোলার পথ তৈরীর পদক্ষেপ লিবিয়া, ইরাক ও মিশরে বেশ ভালভাবে এগিয়ে চললেও সিরিয়ায় হোঁচট খাওয়ার মধ্য দিয়ে তা ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠেছে। বাস্তবে ইসরাইলের উপর এখনো বড় ধরনের কোন চাপ সৃষ্টি না হলেও একদিকে হেজুবল্লাহ ও হামাসের মত মিলিশিয়া গ্রুপগুলো ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার মত শক্তি অর্জন, অন্যদিকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্বসম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান সমর্থনে ইসরাইল ও তার মিত্র আমেরিকা ভীত হয়ে পড়েছে। এমনকি ক্যাথোলিক খৃষ্টানদের সমর্থনও জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। আরবদের প্রতিরোধির বিরুদ্ধে ইহুদি বাহিনীকে সামরিক ও ক‚টনৈতিক সমর্থন দিয়েছিল সম্মিলিত ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদি শক্তি। এরপর ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে ইসরাইলকে রক্ষা করেছে। সিরিয়ায় রিজিম পরিবর্তনে ৫ বছর ধরে সব রকম চেষ্টার পরও ব্যর্থ হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে আগামী আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছে ইসরাইল। বিশেষত: পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে ৬ জাতির সমঝোতা ইরানের জন্য বড় ধরনের ক‚টনৈতিক ও কৌশলগত বিজয় যা ইসরাইলের জন্য মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করতে ট্রাম্পকে দিয়ে ট্রাম্পকার্ড খেলেছে ইসরাইল। ট্রাম্পের জেরুজালেম নীতি যে এমন হোঁচট খাবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে এমনটা হয়তো জায়নবাদিরা চিন্তা করেনি। একটি ভুল সময়ে ট্রাম্পের নেয়া এমন সিদ্ধান্তে মুসলিম বিশ্বকে আবারো একটি একক প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নে এই মুহূর্তে দু’টি পথ খোলা আছে, প্রথমত- পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুসারে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবী মেনে নেয়া, দ্বিতীয়ত: পুরো ইসরাইল, গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, গোলান মালভ‚মিসহ গ্রেটার ফিলিস্তিন কনফেডারেশন গঠন করা। যেখানে আরব ও ইসরাইলীরা সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের জাতিরাষ্ট্র দাবীর বিলুপ্তি ঘটবে। অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে স্থাপিত ইহুদি বসতি অপসারণ এবং বিভিন্ন দেশে বসবাসরত উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন করার মাধ্যমে জনসংখ্যার যে ভারসাম্য গড়ে উঠবে তাতে বরাবরের মত ইহুদিরা সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবেই স্বাধীন গ্রেটার ফিলিস্তিনে বসবাস করার সুযোগ পাবে। তা না হলে বংশানুক্রমে হাজার বছর ধরে বসবাসরত ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানদের সামরিক শক্তির জোরে তাড়িয়ে দিয়ে জায়নবাদি ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশোধ হিসেবে আরব ও মুসলমানরা গ্রেটার ইসরাইল গঠনের ষড়যন্ত্রকারি ইসরাইলীদের ফিলিস্তিন ছাড়তে বাধ্য করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি ও সহাবস্থানের প্রস্তাব চুড়ান্তভাবে অগ্রাহ্য হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত গ্রেটার ফিলিস্তিন গঠনের ওয়ান স্টেট সলিউশনই হবে আরবলীগ, ওআইসিভুক্ত ৫৭টি রাষ্ট্র এবং বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলমানের মূল এজেন্ডা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই এমন মতামত দিয়েছেন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।