Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রংপুরের ভোট কার?

| প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : জনসেবার রাজনীতির এখন হয়ে গেছে ‘ব্যবসা’। জাতীয় সংসদের চিত্র এবং স্থানীয় সরকার তথা সির্টি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের দিকে তাকালে বোঝা যায় রাজনীতি ক্রমশ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। নানা প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে তারা জনগণের সঙ্গে দাম্ভিকতা নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছেন তাতে মনে হয় দেশের রাজনীতি ঠকবাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তারপরও কিছু সৎ-পরোপকারী রাজনীতিক রয়েছে যারা মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণা থেকেই রাজনীতি করছেন। রসিকের নতুন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা তেমনই একজন মানুষ। ৯৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে তার নির্বাচিন হওয়ার পর রংপুরের ভোটারদের নিয়ে রাজনীতির সরলীকরণ প্রচারণা দুঃখজনক।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে দেশের মিডিয়াগুলোতে বিস্তর লেখালেখি আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে এবং একটিও জাল ভোট দেয়ার চেস্টা হয়নি। রংপুর সিটির নির্বাচনের ভোটারদের স্বর্তস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়া দেখে রংপুরের মানুষ হিসেবে গর্ববোধ করছি। রংপুর সিটির নির্বাচন নিয়ে এতো বিস্তর আলোচনা হয়েছে যে নিজের থেকে লেখার কোনো তাগিদবোধ করিনি। কিন্তু রংপুর থেকে এতো ফোন এসেছে যে না লিখে পারলাম না। রংপুরের মানুষ খুশি তারা একজন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি-জনবান্ধব যিনি মানুষের দুঃখকষ্ট বোঝেন এমন একজনকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখ জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ভোটের মূল্যায়ন নিয়ে। নির্বাচনের রিপোর্ট করার জন্য ঢাকা থেকে প্রতিটি টিভি চ্যানেলের ৮ জন থেকে ১৩ জন প্রতিনিধি রংপুরে যান। প্রায় ৩০টি টেলিভিশনের তিনশ এবং অনলাইন মিডিয়া ও দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রায় দুইশ সাংবাদিক রংপুর যান ভোটের নিউজ কভার করতে। এ ছাড়াও রংপুরে বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত রয়েছেন শতাধিক সাংবাদিক। সিটি নির্বাচন নিয়ে তারা নানান ধরণের সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়াও যারা নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নিয়ে গবেষণা করেন সেই সুশাসনের জন্য নাগরিকসহ অনেকগুলো সংগঠন, নির্বাচন পর্যবেক্ষনকারী এনজিও রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে সৎ প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদে উদ্বুদ্ধ করতে প্রার্থীদের সম্পর্কে নানান তথ্য তুলে ধরেন। ইসির প্রচেষ্টা ও সবার সহযোগিতায় রংপুর সিটির নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভোটের মূল্যায়নের সরলীকরণ হিসেব নিয়ে দুঃখের কথা জানান রংপুরের মানুষ। যারা ফোন করে রংপুর সিটির নির্বাচন নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করেন উপদেশ দেন তাদের সবার অভিযোগ লাঙ্গলে ভোট দেয়া নিয়ে অপব্যাখ্যা দেখা হচ্ছে। মিডিয়াগুলো তো বটেই এমনকি সুজনসহ নিবাচন পর্যবেক্ষক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও রংপুরের ভোটের প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরে রাজনীতির সরলীকরণ হিসেব করেছেন। লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী যে ৯৮ লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছে সে ভোট কি সত্যিই এরশাদের জাতীয় পার্টির? নাকি রংপুরের ভোটাররা ভোট দিয়ে বেছে নিয়েছেন সৎ, দক্ষ, যোগ্য এবং নিজেদের মানুষকে?
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা, টিভির খবর এবং টিভির টকশোগুলোতে বলা হয় রংপুরে এরশাদের কারণে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এই বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়েছে। সত্যি কি তাই? মোস্তফার লাঙ্গল মার্কা দ্বিতীয় সর্বচ্চো ভোট পাওয়া প্রার্থী শরাফুদ্দিন আহমদ ঝন্টু মধ্যে ভোটের ব্যবধান বাড়িয়েছে ঠিকই; কিন্তু মোস্তফাকে মানুষ ভোট দিয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়; নিজেদের মানুষ মনে করে। মোস্তফা অন্য যে কোনো প্রতীকে নির্বাচন করলেও মানুষ এবার তাকেই ভোট দিত। মিডিয়ায় প্রচার করা হয় রংপুর এরশাদের ঘাটি এ জন্যই লাঙ্গলের প্রার্থী মোস্তফা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। আবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে প্রচার করছেন মানুষ লাঙ্গলের দিকে তাকিয়েছে। রংপুরের মানুষ তাকেই ভোট দিয়েছে।
রসিক নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ৩৩টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ১৪ জন, বিএনপির ৭ জন, স্বতন্ত্র ১০ জন কাউন্সিলর হন। জাতীয় পার্টির মাত্র ২ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। আবার সংরক্ষিত মহিলা ১১ আসনের ৯ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন। এরশাদের জনপ্রিয়তার জন্যই যদি রংপুরের মানুষ মোস্তফাকে ভোট দিয়ে থাকে তাহলে জাতীয় পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থীদের এই ভরাডুবি কেন? এরশাদের জনপ্রিয়তায় ভোট হলে জাতীয় পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভরাডুবি হলো কেন? নাকি এরশাদ সমর্থকরা নিজ গ্রাম-মহল্লার দলীয় কাউন্সিল প্রার্থীদের ভোট না দিয়ে অন্যের কাছে ভোট বিক্রী করেছেন! বিষয়টি মোটেও তা নয়। মূলত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে ভেল্কিবাজীর কারণে এরশাদের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমে গেছে। যার জন্যই উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টির পক্ষ্যে প্রার্থী হওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। রংপুরের একাধিক সাংবাদিক, কলেজের শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ’৯০ এর পট পরিবর্তনের পর ফাঁসি থেকে বাঁচাতে এরশাদের প্রতি মানুষ সহানুভূতিশীল হন। কিন্তু ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের ভূমিকার কারণেই মানুষ ‘এরশাদের ভোটার’ পরিচয়ে অপমানবোধ করছেন।
মিডিয়াগুলোয় ‘রংপুর’ এরশাদের ঘাটি হিসেবে যে প্রচারণা চালানো হয় এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের লোকজন টিভির টকশোতে যেভাবে রংপুর এরশাদের ঘাটি হিসেবে প্রচার করছে, মোস্তফার বিজয় এরশাদের কল্যাণে প্রচার করেছেন তা মোটেই প্রকৃত চিত্র নয়। রংপুরের ভোটারদের ভোট দেয়াকে ভুলভাবে প্রচারণার জন্যই রংপুর সিটি কয়েকজন ভোটার ফোন করে সিটি নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার অনুরোধ করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিগত দিনগুলোতে রংপুরের বিভিন্ন পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় অধিকাংশতেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী করার মতো নেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর যেখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচন করেছে সেখানেই জামানত হারিয়েছে।
প্রকৃত অর্থেই মোস্তফা একজন ব্যাতিক্রমধর্মী নেতা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে বর্তমানে রাজনীতিতে নীতি আদর্শের চরম অবক্ষয় চলছে। রাজনীতি এখন বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে; ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ সেজেছেন। আবার কেউ কেউ হয়েছেন বক ধার্মিক নেতা। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে অধিকাংশ রাজনীতিবিদের মধ্যে অহংকার, দাম্ভিকতা, দ্রæত অর্থবিত্তের মালিক হওয়া, পদ-পদবী পাওয়া বা আদায় করে নেওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে কাজ করছে। আদর্শবান রাজনীতিবিদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। আনপ্রেডিক্টেবল খ্যাত রাজনীতিবিদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নের্তৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি করলেও মোস্তফা কিছুটা হলেও ব্যাতিক্রম। রংপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মানুষ সেটা দেখেছে। মানুষ বিপদে পড়লে মোস্তফা ছুটে গেছেন। কেউ তার বাসায় দেখা করতে গেলে তাদের সঙ্গে সৎব্যবহার করেছেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেস্টা করেছেন; দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। আমাদের দেশের বাম নেতাদের গণভিত্তি নেই। কিন্তু তারা গণমানুষের বিভিন্ন দাবিতে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়, আন্দোলন করেন। টিভির টকশোতে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তা বলে থাকেন। বাম নেতারা গণমানুষের স্বার্থ সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে টিভিতে কথাবার্তা বলেন; কিন্তু তার মানুষের কাছাকাছি যান না। যা করতেন সিপিবির কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ। কেউ বিপদে পড়লে তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বামদের মধ্যে এমন খবর পাওয়া দূরহ। কিন্তু ভোগবাদী বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি করলেও মোস্তফা গরীব মানুষ বিপদে পড়লে ছুটে যান। আর্থিক সহায়তা করতে পারুক না পারুক বিপদগ্রস্থ মানুষকে পাশে দাঁড়ান। মানুষকে সহায়তা এবং বিপদগ্রস্থ মানুষের পাশে থাকতে মধ্যরাতে ছুটে যাওয়ায় রংপুর সদরের মানুষ মোস্তফাকে নিজেদের লোক মনে করেন। তারই প্রভাব পড়েছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। ২০১২ সালের সিটি নির্বাচনেও প্রতিকূলতার মধ্যেও তার পাওয়া ৭২ হাজার ভোট তারই প্রমাণ।
ঢাকার উপকণ্ঠে নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভির নের্তৃত্ব এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। তাকে মডেল রাজনীতিক হিসেবে প্রচার করা হয়। চলমান দলবাজী ও দলদাসত্বের রাজনীতিতে আইভি অবশ্যই ব্যতিক্রম। সুশীল সমাজ ও মিডিয়াগুলো তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু রংপুরের মোস্তফার ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। রংপুর সিটির মানুষ মোস্তফাকে ভালবেসেই ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সেটা প্রচার করা হচ্ছে এরশাদের বদৌলতে পাওয়া ভোট হিসেবে। যাপিত জীবন এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজকর্মে স্বেচ্ছাচারিতা, দাম্ভিকতার বদলে সাধাসিধে হওয়ায় রংপুরের মানুষ মোস্তফাকে ভোট দিয়েছে। যা চলমান দলবাজী রাজনীতির বাস্তবতায় অবশ্যই শিক্ষণীয়। স্থানীয় নেতা হিসেবে মোস্তফা মানুষের যে ভালবাসা অর্জন করেছেন তা এরশাদের জন্য বলে চালিয়ে দেয়া অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার নামান্তর। রংপুরের যে ভোটাররা ফোন করে সিটি নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার অনুরোধ করেছেন তাদের দুঃখ এটাই। তাদের দাবি রংপুরে মোস্তফার পক্ষ্যে ভোট বিপ্লবের প্রকৃত চিত্র মিডিয়ায় তুলে ধরা হোক।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভোট

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ