হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
নির্বাচনী বছর শুরু হলো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সংবিধান অনুযায়ী, ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে প্রতিদ্ব›িদ্বতাহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে গঠিত সংসদ ২৯ জানুয়ারি প্রথম অধিবেশনে বসে। এই দিন থেকেই সংসদের ৫ বছরের মেয়াদ শুরু হয়। সংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় আগামী একাদশ নির্বাচন বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই অনুষ্ঠিত হবে। এ হিসেবে নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ টিম নিয়ে জেলা সফরে বের হয়েছেন। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করে আগামী নির্বাচনে প্রচারণার ইস্যু ঠিক করে দিচ্ছেন এবং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ১৫টি টিম এবং বিএনপির ৭০টি টিম পর্যায়ক্রমে জেলা সফরে রয়েছে। বলা যায়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান দুই দল প্রচারণা যুদ্ধের কার্যক্রম শুরু করেছে। এ প্রচারণা যুদ্ধে যে এক দল আরেক দলকে ‘ঘায়েল’-এর ইস্যু নিয়ে মাঠে নামবে, তাতে সন্দেহ নেই। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিও থাকবে।
দুই.
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সিংহভাগ কথা সাধারণ মানুষ শোনে, তবে বিশ্বাস করে খুব কম। এর কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের বেশিরভাগই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেয়ে, সুন্দর সুন্দর কথামালা দিয়ে জনগণকে মুগ্ধ করতে দক্ষ বেশি। এজন্য তাদের কথা ‘মেঠো বক্তব্য’ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ ‘মেঠো বক্তব্য’ ধর্তব্যের মধ্যে নয় এবং খুব বেশি দাম দেয়ারও কিছু নেই। ফলে নেতাদের কোন বক্তব্য সঠিক আর কোনটি শুধু কথার কথা, এ নিয়ে জনগণকে বরাবরই দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব থাকতে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিজেদের বোধ-বুদ্ধি দিয়েই তারা সিদ্ধান্ত নেয়। আবার নেতাদের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে বাস্তবে তারা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তা দিয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশে জনগণকে এমন ‘ধন্ধে’র মধ্যে পড়তে হয় কিনা বা রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যকে ‘মেঠো বক্তব্য’ বলে উড়িয়ে দেয়া হয় কিনা জানি না। আমাদের দেশে এটা রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, যে দেশে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে, সে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা ধীর হয়ে পড়ে। জনগণকে যদি কেবলই রাজনৈতিক নেতাদের কথামালা শুনতে হয়, তাদের মুগ্ধ করার চেষ্টা চলতেই থাকে, তবে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। একটা বিষয় ঠিক, জনসাধারণ রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে দ্বিধায় থাকলেও তাদের ‘মেঠো বক্তব্যে’ সত্যিকারের কিছু বক্তব্যও থাকে। তা নাহলে দেশ একেবারে স্থবির হয়ে পড়ত। নেতাদের ‘মেঠো বক্তব্যে’র মধ্যেই তাদের বক্তব্যের সত্যাসত্য লুকিয়ে থাকে। কাটছাঁট করে এ বক্তব্যের নব্বই শতাংশ বাদ দিলে যে দশ শতাংশ বাকি থাকে, তাই তাদের কাজের বক্তব্য। নেতাদের এই দশ শতাংশ বক্তব্য নিয়েই দেশ চলছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশ কতটা ধীর গতিতে এগুচ্ছে। এই যে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হয়েছি, আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হব এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে, এসব বক্তব্যের পুরোটাই কি সঠিক? নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশের কথা যদি ধরা হয়, তবে বলতে হবে, এটা দশ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় ১৬১০ ডলারের কথা ধরলে বলা যায়, এটা এক শুভংকরের ফাঁকি। কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নি¤œ আয় এবং কোটি কোটি বেকার জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করলে, তা মোটেও সঠিক নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কথা যদি ধরা হয় তবে দেখা যাবে, মানুষের আয় দিন দিন কমছে। যা আয় করছে, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস তারা কিনতে পারছে না। যেমন মোটা চালের দাম এখন কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি। একটি পরিবারে যদি মাসে ৫০ কেজি চাল লাগে, তবে তার বাড়তি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশি লাগছে। তার মানে, বাড়তি এই টাকাটা তার আয় থেকে কমে যাচ্ছে। পেঁয়াজের উর্ধ্বমূল্যের কারণে কেজি প্রতি একজনের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকার বেশি। এই টাকাটাও তার আয় থেকে কমে গেছে। সম্প্রতি একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক মাসে ৫ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। এই যে ৫ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেল, পরিস্থিতি যদি না বদলায় তবে, তাদেরকে পুনরায় এই সীমায় পৌঁছে উন্নতি করতে অনেক সময় লেগে যাবে। চাল ও পেঁয়াজের মতো একইভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য কিনতে গিয়ে আরও অনেক টাকা বাড়তি ব্যয় হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, যাতায়াত খরচ, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, বাসা ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আয়ে ব্যাপক হারে টান ধরেছে। আয় কমে যাওয়ায় অনেকে সামাজিক অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে যাওয়ার বিষয়টিও এড়িয়ে যায়। কাজেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যের ধর্তব্যের দশ শতাংশের মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে কয়েক বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্তের দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টি আশাবাদের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে আশার ফানুস ধরাই ভাল। রাজনীতি নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের হিসাব সহজ এবং মৌলিক। ক্ষমতায় কে থাকল, তা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। ক্ষমতায় থেকে যে দল তাদের তিন বেলা খাবারসহ জীবনযাপন সহজ করে দিতে পারে, সে দলই তাদের কাছে ভাল। নিজে স্বাচ্ছন্দে চলার পর রাজনীতির অন্যান্য জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। পেরেশানির জীবনযাপনে থাকলে যত আশার কথাই শোনানো হোক না কেন, তা তাদের শুনতে ভাল লাগে না। এক্ষেত্রে সরকার জনসাধারণকে স্বার্থপরও বলতে পারে। স্বার্থপর তো বটেই! যে দল তাদের স্বার্থ দেখভাল করবে এবং ভাল রাখতে পারবে, সে দলকেই তো তারা নির্বাচিত করে ক্ষমতায় পাঠায়। তারা ভাল না থাকলে ক্ষমতাসীন দল যতই বলুক, তারা এই করেছে, সেই করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। তারা বাস্তবের সুফল ভোগ করতে চায়। কাজেই আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল যেসব উন্নয়নের কথা প্রচার করবে বা বলবে, তা সাধারণ মানুষ খুব খেয়াল করবে এবং ভোট দেবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে।
তিন.
আগামী নির্বাচনে প্রধানত দুইটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রচারণা যুদ্ধ চলবে। ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার ক্ষেত্রে এ দুইটি দলই মূল দাবীদার। তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার আপাতত সম্ভাবনা নেই। তবে সে বড় দুই দলের সহায়ক শক্তি হতে পারে। এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি সাধারণ মানুষের সামনে নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে কি কি বিষয় তুলে ধরবে, এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার। তবে দুই দলই প্রথমে যে একে অপরকে বিভিন্ন ধরনের বদনাম দিয়ে প্রচারণা শুরু করবে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে কী বলবে, তার ইঙ্গিত এখনই পাওয়া যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায়ও তার কিছু প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতি, তার শাসনামলে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, লুটপাট, দুর্নীতি, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ পুড়িয়ে মারা, আগুন সন্ত্রাস ইত্যাদি। এর পাশাপাশি নিজেদের শাসনামলের সাফল্য তুলে ধরে বলবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সার্বিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আবারও আওয়ামী লীগ সরকার দরকার, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে, জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দেশে বেকার সমস্যা কমেছে, দারিদ্রের হার কমেছে, রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, দশ টাকা দরে চাল বিতরণ করা হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে ইত্যাদি। তবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিষয়টি বিগত বছরগুলোতে যেভাবে বলা হয়েছে, তা বলবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ দেশে এখন খাদ্য ঘাটতি চলছে। লাখ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ উল্লেখিত প্রচারণার বিষয়গুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ১৫টি টিম গঠন করেছে। ১০ জানুয়ারি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যর নেতৃত্বে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরে বের হবে। সফরে জনসভা, সমাবেশ, বর্ধিতসভা, উঠান বৈঠক, পথসভায় এসব প্রচারণার বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের এসব প্রচারণার বিষয় জনসাধারণের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে। কারণ এমনিতেই আমাদের দেশে ‘এন্টিইনকাম্বেসি’ বা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী একটা মনোভাব জনসাধারণের মধ্যে থাকে। যত ভাল করুক, তারা এক সরকারকে বেশিদিন ক্ষমতায় দেখতে চায় না। ক্ষমতার পরিবর্তন দেখতে চায়। বিএনপির ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রচারণার কাজটি অনেকটা জটিল হয়ে পড়বে। একেতো তাদের সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয় না, দিলেও নানা শর্তে সীমিত থাকে, অন্যদিকে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলে কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতে পারে। আবার সারাদেশে দলটির প্রায় চার লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ২৫ হাজার মামলা রয়েছে বলে দলটির আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এছাড়া বিএনপি মহাসচিব থেকে শুরু করে দলের স্থায়ী কমিটির ১২ নেতা, ৮ ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপার্সনের ৭ উপদেষ্টা, ৭ যুগ্ম মহাসচিব এবং চার সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে কয়েকশ’ মামলা রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় প্রতিদিনই নেতা-কর্মীদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এমনও আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছরের মধ্যে অনেক নেতা-কর্মীর সাজা হতে পারে। এমন এক বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই বিএনপিকে চলতে হচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতিও চালাচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে, তবে বর্তমান সরকারের অধীনে নয়। অর্থাৎ দলটি আগামী নির্বাচনে যাবে এবং এ অনুযায়ী প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ৭০টি টিম তৃণমূলে যাওয়া শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি সাধারণ মানুষের সামনে কী বলবে, তার কর্মপন্থাও ঠিক করেছে। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রচারণা চালাবে। দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে শ্লোগান তুলেছেন, এ বছর হবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর। এ শ্লোগান এখন দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতারা তাদের বক্তব্যে তুলে ধরছেন। তবে জনসাধারণ গণতন্ত্র কী এ বিষয়টি তাত্তি¡কভাবে কতটা বুঝবে, এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। এর পরিবর্তে যদি বিভিন্ন জনসভায় দলটির নেতারা আরেকটু খোলাসা করে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে আপনারা কি ভোট দিতে পেরেছেন? কিংবা উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছেন? এ সরকার কি আপনাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার? তাহলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ভোটের গণতন্ত্রের বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। পাশাপাশি দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তুলে ধরা যেতে পারে। বিএনপির প্রচারণার অন্যতম বিষয় হবে, এই ভোট না দিতে পারার ইস্যুটি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি ও তার জোট যে আন্দোলন করেছে, সে আন্দোলনে যে জ্বালাও-পোড়াও এবং মানুষ হতাহত হয়েছে, এ কাজ যে তারা করেনি বরং স্যাবোটাজ হয়েছে, এ বিষয়টি যৌক্তিকভাবে তথ্যসহ সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পারে। তার নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবীসহ যে ধরনের বেসুমার গুম, খুন, অপহরণ, বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড এবং সুশাসনের তীব্র ঘাটতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের চিত্র দলটি তুলে ধরতে পারে। দুনীতির ক্ষেত্র তুলে ধরে বলতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি, সোনালি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়গুলো। শেয়ার বাজার থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়ে মানুষকে নিঃস্ব করার বিষয়টিও যুক্ত হতে পারে। দেশ থেকে গত দশ বছরে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না হওয়ার বিষয়টিও আসতে পারে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ না থাকা, দুর্নীতির ধারণা সূচকে অবনমন-এসব বিষয় তুলে ধরা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হতে পারে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়া। সাধারণ মানুষের কাছে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মাছ-গোশত, শাক-সবজিসহ অন্যান্য দ্রব্যের উচ্চমূল্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। ক্ষমতাসীন দলের শাসনামলে যে এসব পণ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে, তা তুলে ধরতে পারে। দলটির প্রচারণার অন্যতম বিষয় হতে পারে ক্ষমতাসীন দলের ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর বিষয়টি। সেই সাথে তুলনা করে সভা-সমাবেশে মানুষকে জিজ্ঞেস করতে পারে, আমাদের সময় আপনারা কত টাকায় চাল খেয়েছেন? এখন কত টাকায় খাচ্ছেন? দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধি, ক্যুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছা দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরতে পারে। শিক্ষা খাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড এবং শিক্ষার মানের অবনতির বিষয়টিও আসতে পারে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা শহর বৃষ্টির সময় পানিতে ডুবে যাওয়া এবং নগরবাসীর ভোগান্তির বিষয় বলতে পারে। ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়া, সড়ক ও বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়াসহ বাংলাদেশের ন্যায্য দাবী তিস্তা চুক্তি না হওয়া এবং অন্যায্যভাবে অভিন্ন নদ-নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে পানিশূন্য করার বিষয়গুলো তুলে ধরা যেতে পারে।
চার.
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় একে অপরকে ‘ঘায়েল’ করার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে। এমনকি দলের প্রধানরা ব্যক্তিগত আক্রমণও করে থাকেন। তবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তা গঠনমূলক, সৃজনশীল এবং শালীন বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের দেশে এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়। অত্যন্ত অশালীন ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়। বিষয়টি যুক্তিতর্কের চেয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঝগড়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে, জনগণ এ ধরনের ঝগড়ামূলক প্রচারণাকারীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। আমাদের দেশে দুই দলেরর বাইরে বিকল্প না থাকায়, জনগণ বাধ্য হয়ে তাদের কাউকে বেছে নেয়। জনগণের এই সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে হলেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণা গঠনমূলক, যৌক্তিক এবং শোভন হওয়া দরকার। কারণ ‘মুখেই জয়, মুখেই ক্ষয়’ বলে একটা কথা আছে। তাই অশোভনীয় বাকযুদ্ধের পরিবর্তে জনসাধারণের সামনে নমনীয় এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন। ইদানিং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের ধরণ এবং তাদের পাল্টাপাল্টি জবাব দেয়ার ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে সুধীজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। কার বক্তব্য শ্রুতিমধুর আর কারটা শ্রুতিকটু, এ বিচারও করা হচ্ছে। বলা যায়, কোনো ধরনের ব্যতিক্রম না হলে এবং স্বাভাবিকভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত হলে, দুই দলের শীর্ষ নেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের প্রচারণামূলক বক্তব্য ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।