পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের একটি মেট্রো স্টেশন এবং বিমানবন্দরে তিন দফায় সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৩৫ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে ব্রাসেলসের জাবেন্টাম বিমানবন্দরে দুই দফায় বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ১৫ জন নিহত হন। এর এক ঘণ্টার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোয়ার্টারের কাছাকাছি একটি সাবওয়ে স্টেশনে প্রচ- বিস্ফোরণে ২০ জন নিহত হন। হতাহতদের আর্তচিৎকার এবং রক্তে ভেসে যাওয়া বিমান বন্দর এবং সাবওয়েতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আহতদের মধ্যে আরো ১৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে বেলজিয়াম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই সন্ত্রাসী হামলাকে ‘অন্ধ, হিংস্র ও কাপুরুষোচিত’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউরোপ জুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা সতর্কতা এবং সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান আরো জোরদার হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো হামলার পর তথাকথিত আইএস’র দায় স্বীকারের ধারাবাহিকতায় ব্রাসেলসে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলারও দায় স্বীকার করেছে আইএস। অর্থাৎ ইউরোপে আরেকটি রক্তাক্ত সন্ত্রাসী হামলার সাথে মুসলিম জেহাদি গোষ্ঠীটি নিজেদের নাম সম্পৃক্ত করল। আমরা আবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা ইসলাম অনুমোদন করেনা। ইসলামের সাচ্চা অনুসারী তো বটেই, কোন সাধারণ বিবেকবান মুসলমানও এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা সমর্থন করেননা।
গত বছর নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পরও ইউরোপসহ সারাবিশ্ব থেকে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। পশ্চিমা নেতারা হাতে-হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জোরদার করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। এরপর সিরিয়া এবং ইরাকে আইএস ঘাঁটির উপর বিমান হামলা জোরদার করা হয়। সিরিয়া থেকে আরো লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপীয় সীমান্তগুলোতে ভিড় জমায়। তাদের উপর অমানবিক আচরণের দৃশ্যও বিশ্ববাসী নীরব দর্শকের মত দেখেছে এখনো দেখছে। হাজার হাজার সিরীয় শিশু খাদ্য, ওষুধ ও মানবিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক রেডক্রস, ডক্টর্স উইদাউট বর্ডারসহ বিভিন্ন সহায়তা সংস্থার পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় পশ্চিমা নেতা এবং নাগরিক সমাজ অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেও সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, গাজা, লেবানন, ইয়েমেনে হাজার হাজার মানুষের প্রতিদিনের আহাজারি তাদেরকে তেমন বিচলিত করেনা। এমনকি জঙ্গি গোষ্ঠীর আত্মঘাতী ও সন্ত্রাসী হামলায়, বাগাদাদ, লেবানন, ইস্তাম্বুল বা আঙ্কারায় এর চেয়ে অনেক বেশী মানুষ হতাহত হওয়ার পরও তাদের শীতল প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার কিছুদিন আগে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৪৩ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। সে হামলায় বিশ্বনেতারা নিস্পৃহ থাকলেও প্যারিসের বাটাক্লঁ কনসার্ট হলের সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। গত মাসের শেষদিকে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সন্ত্রাসী বোমা হামলায় অন্তত ৮২জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। এ নিয়েও তেমন কোনো উচ্চবাচ্য লক্ষ্য করা যায়নি। পশ্চিমা নেতাদের এ ভূমিকা থেকে মনে হয়, ঘটনার ভয়াবহতা এবং হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী হলেও লন্ডনে, প্যারিসে, ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের তুলনায় মুসলমান দেশগুলোতে সন্ত্রাসের শিকার হওয়া মানুষগুলোর জীবন তুচ্ছ, মূল্যহীন।
জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা বা আইএস সৃষ্টির পেছনে পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি অনেকাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন পশ্চিমা নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও এ কথা স্বীকার করেছেন। নাইন ইলেভেন বা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনার সাথে আল-কায়েদার সম্পৃক্ততার অভিযোগ সামনে রেখে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান। তবে দেড় দশকের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে তছনছ করে দিয়ে, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা ও কোটি মানুষের বাস্তুভিটা ধ্বংস করেও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের হোতারা। এ সময়ে বিশ্ব আরো অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল হয়েছে। যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করতে পারলেও সন্ত্রাস কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস, অথবা ঘৃণা দিয়ে ঘৃণাকে জয় করা যায়না। এটাই প্রমাণিত। যে সব জঙ্গি গোষ্ঠী নিজেদের মুসলমান দাবী করে আত্মঘাতী হামলায় নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হত্যা করছে কখনো তা’ বিশ্বের মুসলমানরা সমর্থন করেনি, করছেনা। পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ও ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে ইসরাইল এবং কোন কোন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার মদদে উগ্র ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থানের কথা নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জকে সমর্থন করতে সেখানকার সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রতি ইসরাইল এবং পশ্চিমাদের সর্বপ্রকার সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি এখন আর কোন গোপন বিষয় নয়। ইসলাম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা এবং ফল্স ফ্লাগ সন্ত্রাসের দায় মুসলমানদের উপর চাপানোর ইভিল আইডিয়া পরিহার করতে হবে। সব মানুষের জীবনই মূল্যবান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর বিমান হামলা এবং ‘রিজিম চেঞ্জ’র রক্তাক্ত ষড়যন্ত্রের দাবাখেলা বন্ধ না করে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বন্ধ করা সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পশ্চিমা বিমান হামলা অথবা বৈরুত, প্যারিস, ব্রাসেলসের মত সন্ত্রাসী হামলায় আর কোন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হোক, এটা কারো কাছে কাম্য নয়। প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় আমরা নিন্দা প্রতিবাদ জানাই। ঘৃণা ও ব্লেইম গেম পরিহার করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্বনেতারা সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করবেন। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।