Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবনে বাঘ বিলুপ্তপ্রায় এবং নির্বিচারে চলছে হরিণ নিধন

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন রাজসিক বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও মায়াবী চিত্রল হরিণের জন্য বিখ্যাত। এক সময় এই বনে অগুণতি বাঘ ও হরিণের অবস্থিতি ছিল। কালপ্রবাহে তাদের অস্তিÍত্ব এখন হুমকির মুখে। এই দুই মনোহর বন্য প্রাণীর আদি ও শেষ আগ্রয়স্থল এই বন। দিনে দিনে এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে এ আশঙ্কা প্রবল, এমন এক সময় আসতে পারে যখন এদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যাবে। সুন্দরবন যেমন বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং বিশ্ব ঐতিহ্যও বটে, তেমনি রয়েল বেঙ্গল টাইটার ও বর্ণবহুল হরিণ ও বাংলাদেশ ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমতে কমতে একশ-দেড়শ আছে কিনা সন্দেহ। বনের পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্যাভাব ও চোরা শিকারীদের দৌরাত্ম্যে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। উপযুপরি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে বনের প্রকৃতি পাল্টে গেছে। গাছের স্বল্পতার কারণে বনের গভীরতা কমে গেছে। বাঘের নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ বসবাসের জন্য তা আর এখন আগের মতো অনুকূল নয়। এছাড়া খাদ্য সংকটও প্রকট। অনেক সময় বাঘকে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়তেও দেখা যায়। চোরা শিকারীরা এ অবস্থায় বেপরোয়া হয়ে নির্বিচারে বাঘ নিধন করেছে। তথ্য মতে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে যখন বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে তখন ভারতীয় অংশে সংখ্যা বাড়ছে। এর একটা কারণ এই হতে পারে, বাঘ নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় অংশে চলে যাচ্ছে। বড় কারণটি হলো, বাঘ সুরক্ষায় ভারতীয় অংশে নানারকম উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশ অংশে অনুপস্থিত। বাঘের মতো চিত্রা হরিণও দিন দিন সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। খাদ্যভাব ও অবাধে শিকার এর প্রধান কারণ। হরিণের প্রধান খাদ্য কেউড়া পাতা, যা লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। বনের পরিবেশ তার বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বনের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা ও সাউদখালী অংশে হরিণ শিকার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বনবিভাগ, আইন শৃংখলা বাহিনীসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত শোচনীয় ব্যর্থতার কারণেই বাঘ ও হরিণের জীবনচক্র ও নিরাপত্তা এরকম বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
হরিণ অত্যন্ত নিরিহ ও লাজুক প্রাণী। আত্মরক্ষায় তাদের সক্ষমতাও কম। তাদের শত্রæর অভাব নেই। ডাঙ্গায় বাঘ, পানিতে কুমীর এবং চোরা শিকারীরা সব সময় ওতপেতে থাকে। বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। বাঘের থাবায় তাদের সংহার স্বাভাবিক ঘটনা। পানি পানও তাদের জন্য নিরাপদ নয়। যে কোনো সময় কুমীরের পেটে চলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। লক্ষ্য করার বিষয়, বাঘ ও কুমীরের থাবা থেকে কখনো কখনো রেহাই পেলেও চোরা শিকারীদের হাত থেকে হরিণের রেহাই মেলেনা। সারা বছরই চোরা শিকারীরা হরিণ শিকার করে। তবে বিশেষ বিশেষ সময়ে শিকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর মধ্যে একটি সময় হলো রাশ মেলার সময়। প্রতি বছর এই মেলার ১০-১৫ দিন আগে শিকারীরা ব্যাপক সংখ্যায় হরিণ শিকার করে ডুবিভোজের জন্য। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া তারা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। একাজ সহযোগিতা করে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারা। হরিণের গোশত সুস্বাদু, দামে চড়া এবং তার শিং, চামড়া উচ্চমূল্যে বিক্রী হয়। জানা গেছে, অন্যান্য বছরের মতো এবারের রাশ মেলা উপলক্ষেও বিপুল সংখ্যক হরিণ শিকার করা হয়েছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, বিগত অর্ধযুগে চোরা শিকারীরা অন্তত ১০ হাজার হরিণ নিধন করেছে। সর্বশেষ জরিপে বনে হরিণের সংখ্যা ছিল দেড় থেকে দুই লাখ। এই হিসাবে ৮ বছরে ৫০-৮০ হাজার হরিণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ এই সময় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মতো। এ থেকে অনুধাবণ করা যায়, কীভাবে হরিণের বংশ ধ্বংস হচ্ছে। এভাবে হরিণ বিনাশ হলে ভবিষ্যতে এর পরিচিতি হয়তো বইয়ের পাতায় পাওয়া যাবে, বাস্তবে নয়।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রময় হরিণের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচিতি যুক্ত হয়ে আছে। এই বিরল প্রজাতির বন্য প্রাণী দুটির অস্তিত্ব সুরক্ষাই শুধু নয়, এদের নিরাপত্তা ও বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। এ জন্য প্রথমত, বনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বনের নিরাপত্তা নিরংকুশ করতে হবে। তৃতীয়ত, বন্যদস্যু ও শিকারীদের দৌরাত্ম্য কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। চতুর্থত, বাঘ ও হরিণ প্রজননের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮৭৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে বড় ধরনের ৪৮টি সাইক্লোন ও ৪৯টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এসব সাইক্লোন ও ঘূর্ণিঝড়ে বনের গাছ-পালার অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বনের পরিধি হ্রাস পেয়েছে। বনের প্রত্যাবাসন ও পরিধি বিস্তার করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেখা গেছে, বৃক্ষনিধন, বনধ্বংস ও বন্যপ্রাণী নিধন ও বনসম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে বন বিভাগের কর্মচারী ও আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকদের যোগসাজস রয়েছে। এ ধরনের যোগসাজস থাকলে বন কখনই নিরাপদ করা যাবে না। কাজেই, সরষের মধ্যে থাকা ভুত আগে তাড়াতে হবে। বন রক্ষার দায়িত্ব নিয়োজিতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাঘ ও হরিণ শিকারীদের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা ও শান্তি বিধান করতে হবে যাতে কেউ অবৈধ শিকারে সাহস দেখাতে না পারে। আমরা জানতে পেরেছি, বৈদেশিক অর্থপুষ্ট সুন্দরবন বায়োডারসিটি প্রজেক্ট নামে যে প্রজেক্টি ছিল, এখন অর্থভাবে তা কার্যকর নয়। ওই প্রজেক্টের অধীনে হরিণ প্রজননের একটি কর্মসূচী ছিল। এই কর্মসূচী চালু করতে হবে। এইসঙ্গে বাঘ প্রজননের জন্যও কর্মসূচী নিতে হবে। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন ক্ষেত্র। এখানে মানুষ আসে বাঘ, হরিণ ও অন্যান্য প্রাণী ও পাখি দেখতে। এই পর্যটনক্ষেত্রটি সবদিক দিয়েই আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সুন্দরবন কেবল ১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থানেরই উৎস নয়, লাখ লাখ মানুষের বিনোদন ক্ষেত্রও হয়ে উঠতে পারে এবং এতে আসতে পারে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোটা অংকের রাজস্ব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবন

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন