Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদে মিলাদুন্নবীর পয়গাম

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। মানব ইতিহাসে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন এমন এক মহামানবের আবির্ভাবের দিন কোনো বিচারেই যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কারোর আবির্ভাব ঘটেনি এই পৃথিবী গ্রহে। যার প্রভাব তাঁর কর্মকালে, জীবদ্দশায় যেমন তৎকালীন দুনিয়া অনুভব করেছে তেমনি ১৪০০ বছর পরও বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে। মনে হয় প্রলয়দিন পর্যন্ত সমগুরুত্বের সঙ্গে তা অনুভূত হতে থাকবে। যুগের পরিবর্তন হয়, কালের বিবর্তন ঘটে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক চাহিদার ধরন বদলায়, নব নব সমস্যার উদ্ভব হয়, তা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কাল যা অপরিহার্য ছিল আজ তার উপযোগিতা নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু এমন এক মহামানব যিনি কখনো পুরাতন হন না, যার আবেদন কখনো নিঃশেষ হয় না, যার প্রয়োজন কখনো ফুরায় না, যিনি স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে উঠেছেন, চিন্তায়, কর্মে, অনুভবে, বিশ্বাসে. সর্বত্র-সর্বব্যাপী সকল ক্ষেত্রে যার উপস্থিতি, প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়; অপরিহার্য, অনিবার্য হয়ে যিনি সতত বিরাজ করেন; কী দর্শনে, কী বিজ্ঞানে, কী সাহিত্যে, কী কলায়, কী ইবাদত-বন্দেগীতে, ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত যার উপস্থিতি চেতনে-অচেতনে সমভাবে অনুভূত তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম, সুন্দরতম. মহোত্তম, মাহবুবে খোদা, রাহমাতুল্লিল আলামীন, হযরত মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এমন যুগ-বিজয়ী, কাল-বিজয়ী, মহাবিজয়ী, বিশ্ববিজয়ী, এমন পরিপূর্ণ, এমন সর্বগুণের আকর এই পৃথিবী গ্রহে আর কেউ আসেননি, তার সমকক্ষ আর কেউ হননি, ভবিষ্যতে যে হবেন তেমন ধারণাও করা যায় না। তিনি অতুলনীয়, তিনি অনুপম, তিনি বে-মিসাল।
মহাকবি ইমাম বুসীরীর ভাষায়-
‘মুনাজ্জাহুন আন শারীকিন ফী মুহাসিনিহী
ফা জাওহারুল হুসনি ফি হি গায়রু মুনকাসিমী।’
সকল গুণের মৌল আদিম
উৎস ধারা রূপ সুষমার
শরিকবিহীন ভাজ্যবিহীন
অদ্বিতীয় সত্তা যে তার।
আল্লাহ রূপ-সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন, গুণ সৃষ্টি করেছেন, যোগ্যতা সৃষ্টি করেছেনÑ সেই রূপ-সৌন্দর্যের সার নির্যাস, সেই গুণাবলির একই ক্ষেত্রে বিকাশ, সেই যোগ্যতার একই পাত্রে সমাহার, আর এসবের একীভূত সমন্বিত উদ্ভাস একই সত্তায় ঘটিয়ে যাকে এই গ্রহে প্রেরণ করেছেন তিনি শামসুদ্দোহা, বদরুদ্দোজা, নূরুল হুদা, খায়রুল ওয়ারা, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মহাকবি শেখ সাদীর ভাষায়-
‘বালাগাল উলা কি কামালিহি
কাশাফাত দুজা বি জামালিহি
হাসুনাত জামিউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
সবার ঊর্ধ্বে সবার শীর্ষে পূর্ণতায়
তিমির আঁধার বিদূরিত যার জ্যোতি-আভায়
পূত অনুপম মধুময় চারু স্বভাব যার
সালাম সালাম সে নবী এবং স্বজনেতার
কবির কল্পনা যে সীমা অতিক্রম করতে অক্ষম, দার্শনিকের চিন্তার গতি যেখানে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়, সাহিত্যিকের লেখনি যেখানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, সুরকারের সুর যে মঞ্জিল অতিক্রমে অসমর্থ, তারও উপরে যার অবস্থান, সকল ভাষায় সকল শ্রেষ্ঠ শব্দসম্ভার একত্রিত করে, সকল মণিমুক্তা আহরণ করে, সে সবের শ্রেষ্ঠতমের সমাহার ঘটিয়েও যার রূপ- সৌন্দর্য, যোগ্যতা-দক্ষতা, গুণাবলির যথার্থ প্রকাশ ঘটানো যায় না, তিনি মহাশিল্পীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম, মহান ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ আলাই ওয়া সাল্লাম। মধু পূর্ণিমারি সে কি আন্দোলিত চাঁদ? সে কি নব ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি? সে কি কুল মাখলুকাতের গুলবাগে একটি ফোটা ফুল? কী সে? কোনো উপমা দিয়ে তার রূপ ফুটিয়ে তোলা যায়? কোন তুলির আঁচড় দিয়ে সেরূপ উপস্থাপন করা যায়? না- কোনো কল্পনাই সে সীমায় পৌঁছতে পারে না। এ ব্যাপারে সবাই অসমর্থ, অক্ষম, অপারগ। লা ইমকিনু সানাউহু কামাকানা হাক্কুহু/বাদ আয খোদা বুজুর্গ তুই কেসসা মুখতাসারÑ খোদার পরেই ওগো হাবীব খোদার তোমার উচ্চ মাকাম।
আল্লাহ যার মধ্য দিয়ে নিজের সৃজন ব্যগ্রতার প্রথম স্ফূরণ ঘটিয়েছেন, নিজ নামের সাথে যার নাম সংযোজন করেছেন, নিজ প্রেমাস্পদের মহিমায় যাকে মহিমান্বিত করেছেন, আকাশে-বাতাসে যার গুনগান ছড়িয়ে দিয়েছেন; যার স্মরণকে সমুন্নত করেছেন; নিজ বাণী আল- কোরআন দিয়ে যাকে নন্দিত করেছেন; আরশে আজীমে আমন্ত্রণ করে নিয়ে দিদার দানে তাকে ধন্য করেছেন; সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন; কবরে চিরঞ্জীব রেখেছেন; হাশরে শাফায়াতের চাবিকাঠি অর্পণ করেছেন; হাউজে কাওসারে পুরস্কৃত করেছেন; মাকামে মাহমুদের সর্বোচ্চ মাকামে উন্নীত করেছেন; তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল তাবৎ আসমানী কিতাবে যার প্রশংসা-স্তুতি গীত হয়েছে, জগতের প্রখ্যাত ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগুরুরা তাঁর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যার শহরের ধূলিকণা চোখে মাখার জন্য আশিকদের হৃদয় ব্যাকুল করেছেন; নিষ্প্রাণ পাথর যার ইঙ্গিতে কালেমা পড়েছে; আসমানের চাঁদ যার হাতের ইশারায় দ্বিখন্ডিত হয়েছে; তার শরীরের ঘাম মিশক আম্বরের চেয়ে সুরভিত, যার ভেতর-বাহির নূরে নূরান্বিত ‘নীল গগন নিরালা’ যে ফুল চুমতে ব্যাকুল, ‘আম্বিয়া আউলিয়া যাঁকে ধ্যানে না পায়’ তিনি খাতেমুন্নাবিয়্যিন, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, শাফিউল মুজনিবীন, আনিসুল গারেবীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
যেই সৃষ্টির সম্প্রাটের সংবর্ধনার জন্য সুনীল গগন সুসজ্জিত করা হয়েছে নিহারিকাপুঞ্জে নক্ষত্ররাজিতে; হাসছে সূর্য, ছড়াচ্ছে আলোকরশ্মি; হাসছে চাঁদ, রুপালি জোছনায় প্লাবিত করছে ভূমন্ডল; রূপ-বৈচিত্র্যে ভরপুর করা হয়েছে এই বসুন্ধরা; কোথাও অভ্রভেদি পর্বতমালা, কোথাও বালুরাশি পূর্ণ মরুবিয়াবান, কোথাও ঘনকুঞ্জ অরণ্যানি, কোথাও বরফাচ্ছাদিত তুন্দ্রাঞ্চল, কোথাও তৃণশোভিত স্তেপভূমি, কোথাও পারাপারহীন নীল সমুদ্র, কোথাও শস্য-শ্যামল, সুজলা-সুফলা মাঠ; কোথাও ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা-নদী মেখলা জনপদ; যাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য এত আয়োজন, এত এন্তেজাম; যাকে স্বাগত সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সকলের এমন ব্যাকুল এন্তেজার, যাকে বরণ করার জন্য, ধারণ করার জন্য এবং যার দিদারে ধন্য হওয়ার জন্য কুল মাখলুকাত অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণ; যার আগমনের সংবাদ বাবা হযরত আদম পরিবেশন করেছেন, সকল নবী-রাসূল ঘোষণা করেছেন, হযরত ইব্রাহীম যার জন্য প্রার্থনা করেছেন, হযরত মুসা যার আগমনী বার্তা শুনিয়েছেন, হযরত ঈসা যার সুসংবাদ প্রচার করেছেন সেই দোজাহানের বাদশা এলেন, নবীকুল সম্প্রাট এলেন। আকাশে-বাতাসে তাই আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল; বৃক্ষের কিশলয়ে কিশলয়ে, পত্রপুষ্প পল্লবে পল্লবে পুলক শিহরণ জাগল, নদীর ঊর্মিতে ঊর্মিতে জয়ধ্বনি নিনাদিত হলো; বাতিলের ভিত প্রকম্পিত হলো, নওশেরোয়ার সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ চূড়া ধসে পড়ল, কাবার নকল খোদারা ভূলুণ্ঠিত হলো; আনন্দ ও পুলকের দোলায় আলোড়িত, মুখরিত স্পন্দিত হলো বিশ্বনিখিল। মারহাবা ইয়া রাসূলুল্লাহ। মারহাবা ইয়া হাবিবুল্লাহ। মারহাবা।
‘মানুষে মানুষের অধিকার দিলো যেজন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাহি কহিল যেজন
মানুষের লাগি চির দীন হীন বেশ ধরিল যেজন
বাদশা-ফকিরে এক শামিল করিল যেজন
এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজ মাতিল বিশ্ব নিখিল তাই মুক্তির কলরোলে।’
হ্যাঁ, সেই বিশ্বনিখিল মুক্তির কলরোলে মাতার দিনই ঈদে মিলাদুন্নবী।
তিনি তো খুলুকুন আজীম; ‘ইন্নাকা লা আলা খুলুকুন আজীম- চারিত্রিক মাধুর্যে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ (কোরআন)। তিনি তো রাহমাতুল্লিল আলামীন; ‘অমা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন- আপনাকে প্রেরণ করেছি আমি বিশ্বজগতের কল্যাণের প্রতীকরূপে (আল কোরআন)। তিনি তো খাতামুন্নাবীয়ান ‘রাসূলাল্লাহি ওয়া খাতামুন্নাবিয়্যন- সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল এবং সর্বশেষ নবী (আল-কোরআন)। তিনি তো উসওয়ায়ে হাসানা; লাকাদ কানা লাকুম ফী রাসূলিল্লাহি উসআতুন হাসানাহ’- রাসূলুল্লাহ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ (আল-কোরআন)।
তিনি নবী, তিনি সাক্ষী, তিনি সুসংবাদদাতা, তিনি সতর্ককারী, তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, তিনি উজ্জ্বল প্রদীপ- জ্যোতিষ্মান সূর্য: ‘ইয়া আইয়্যুহান নাবীউ ইন্না আরসালনাকা শাহিদাও ওয়া মুবাশশিরাও ওয়া নাযিরা, ওয়া দায়আন ইলাল্লিল্লাহি বিইজনিহী ওয়া সিরাজাম মুনীরা (আল-কুরআন)’। তিনি তো নূর : কাদ জাআকুম মিনাল্লাহি নুরুন (আল- কুরআন)। তিনি তো জীবন্ত কোরআন : কানা খুলুকুহুল কুরআন (আল হাদীস) তার কথা স্বয়ং আল্লাহর বাণী : অমা ইয়ানতিকু আনিল হাওয়া ইন হুয়া ইল্লা ওয়াহইউ ইউহা- তিনি নিজ থেকে কিছু বলেন না, যা ওহি হিসেবে নাজিল হয় তাই বলেন (আল-কোরআন) (‘গোফতায়ে উ গোফতায়ে আল্লাহ বাওয়াদ/গারচে আজ হুলকুমে আবদুল্লাহ বাওয়াদ- তাঁর কথা আল্লাহর কথা, যদিও আল্লাহর বান্দার মুখ থেকে তা নিঃসৃত হয়- মুখ তার, কথা আল্লাহর)। তার হাতে হাত দেয়া মানে আল্লাহর কুদরতি হাতে হাত দেয়া : ইয়াদুল্লাহি ফাওকা আইদিহিম (আল কুরআন)। তার নিক্ষেপণ স্বয়ং আল্লাহর নিক্ষেপণ : অমা রামাইতা ইজ রামাইতা অলাকিন্নাল্লাহা রামা- যখন আপনি নিক্ষেপ করলেন প্রকৃতপক্ষে তা তো আপনি নিক্ষেপ করেননি, আপনার হাতের মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন (আল-কুরআন)। তার অনুসরণের নামই আল্লাহপ্রেম- (কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুন্নাআল্লাহা ফাত্তাবিউনী ইউহবিব কুমুল্লাহ (আল- কুরআন)। তাঁর স্মরণ আল্লাহরই স্মরণ : হাবীবী জিকরুকা জিকরি : (হাদীসে কুদসী)। উম্মতের নিজ সত্তার চেয়ে, আত্মার চেয়েও তিনি অধিক নিকটবর্তী, অধিক প্রিয়; আন্নাবীউ আওলা বিল মুমিনিনা মিন আনফুসিহিম (আল-কুরআন)। তিনি সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ অভিভাবক, সবার চেয়ে অধিক দরদী : বিল মুমিনীনা রাউফুর রাহীম (আল-কুরআন)।
এলো জগতের খোদার সে প্রিয় রাসূল
দরদে নাই কেহ যার সমতুল
পড় দরুদ তাঁর, সারা মন হৃদয় দিয়া
সাল্লেআলা নবী সাল্লেআলা।
তাঁর উপমা তিনি নিজেই। মাতৃক্রোড়ে দুগ্ধপানকালেই তিনি ইনসাফের অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করেছেন। সেই শুরু। তারপর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেটেছে তাঁর মানব কল্যাণে। তিনি জনকল্যাণ, সমাজসেবার অনুপম আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুস্থ, দুর্গত, নিরন্ন, বুভুক্ষু, এতিম, অনাথ, অসহায়, অত্যাচারিত নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষের পাশে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন। বুকে টেনে নিয়েছেন। অশ্রæ মুছিয়েছেন, দুঃখ দূর করেছেন, আশ্রয় প্রদান করেছেন। দলিতমথিত পঞ্জরে পঞ্জরে মহামঙ্গলের অযুত জয়ধ্বনি নিনাদিত করেছেন। আশরাফ-আতরাফ, উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়র দুর্লংঘ্য প্রাচীর তিনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। বর্ণ-গোত্র-ভাষার দেয়াল খান খান করে দিয়ে মানুষকে মানুষের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দাসিত্বের কলঙ্ক মুছে দিয়ে নারীকে রানীর আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিশ্চিত করেছেন। মানুষদের সাম্য, মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব,
স্নেহ-মমতা, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। সমাজ থেকে শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছেন। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তপাতের, কলহ-কোন্দলের উচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। পশু-খাসলত দূর করে পাতক-পতিতদের ফেরেশতার খাসলতে উন্নীত করেছেন। বদলে দিয়েছেন ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, জাতির চরিত্র। শান্তি, নিরাপত্তা- আমান ও সালামতের প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন। শতধাবিভক্ত জাতিকে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ করেছেন। সম্প্রাটের সম্প্রাট হয়েও ফকীরী জিন্দেগী ইখতিয়ার করেছেন। শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। প্রতিশোধ গ্রহণের মহা সুযোগ লাভ করেও তিনি মাফ করে দিয়েছেন। যারা পবিত্র বদনে প্রস্তর নিক্ষেপ করে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছে, যারা নির্বাসন দিয়েছে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে, নির্যাতন-নিপীড়নের একশেষ করেছে, হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, দেশ থেকে বিতাড়িত করার পরও যারা অস্তিত্ব বিনাশী তৎপরতা চালিয়েছে, অভিযানের পর অভিযান, আক্রমণের পর আক্রমণ, যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে, দান্দান মোবারক শহীদ করেছে, তাদের কব্জায় পেয়েও, তাদের দন্ডমুন্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও বদলা না নিয়ে তিনি তাদের বুকে টেনে নিয়েছেন। তাঁর তুলনা কী হতে পারে! কুফরী, শিরকী, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা, অশ্লীলতা, চরিত্রহীনতার পঙ্কে যে জনগোষ্ঠী আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল সেই জনগোষ্ঠীকে তৌহিদের মৃত সঞ্জীবনী পান করিয়ে সঞ্জীবিত করে, জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে, ঐক্যের বলে বলীয়ান করে, বিস্ময়কর শৃঙ্খলায় ঐক্যবদ্ধ করে একটি বিশ্বজয়ী জাতিতে পরিণত করেছেন- এমন সংগঠক, এমন সংস্কারক, দুনিয়ার আর কোথায় মিলতে পারে! যার অনুসারীরা একদা চুপিসারে জন্মভূমি থেকে পালিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল, তারাই স্বল্পকালের ব্যবধানে অজেয় শক্তিতে পরিণত হলো। যুদ্ধের পর যুদ্ধে বিজয়ী হলো। সেই পালিয়ে যাওয়া ভূমিতে মহাবিজয়ী বেশে প্রবেশ করল। তারাই দিকে দিকে বিজয় অভিযান পরিচালিত করল, তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজশক্তি, পরাশক্তিকে পরাজিত করল। এর চেয়ে সফল নেতৃত্বে, এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক আর কে হতে পারে! তিনি আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগকে স্বর্ণযুগে রূপান্তরিত করলেন, মরুচারী বেদুইন জাতিকে বিশ্ববিজয়ী করলেন। দুনিয়ার ইতিহাস-ভূগোল পাল্টে দিলেন। এক নব সভ্যতা, সংস্কৃতির জন্ম দিলেন। নির্বাসিত খোদাকে পুনর্বাসিত করলেন। তাঁর সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর জয়গানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করলেন। এমন বিপ্লব ইতিহাসে আর কবে কোন দিন সংঘটিত হয়েছে! এমন মহাবিপ্লবের মহানায়ক আর কবে কোথায় আবির্ভূত হয়েছে! হয়নি, হবেও না কোনো দিন। কারণ তিনি বেমিসাল অদ্বিতীয় অনুপম। তাঁর আবির্ভাবের দিন তাই মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন। মহাবিপ্লবের দিন। পরম প্রাপ্তির দিন, পরম পুলকের দিন। মানবতার পূর্ণতা লাভের দিন মহা উৎসবের দিন- ঈদে মিলাদুন্নবী।
হায় আফসোস! যিনি তৌহিদের মশাল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর অনুসারী হওয়ার দাবিদার হয়েও তাদের অধিকাংশ আজ শিরক কুফরীতে নিমগ্ন। যিনি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর অনুসারীরা আজ অজ্ঞানতার, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। যিনি সাম্য মৈত্রীর পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর অনুসারীরা আজ বিভেদের বেড়াজালে আবদ্ধ। তিনি ঐক্যের অগ্রদূত হয়ে এসেছিলেন, তাঁর অনুসারীরা আজ শতধা বিচ্ছিন্ন। যার অনুসারীরা এককালে দুনিয়ার মানুষকে জুলুম-অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল, তাদের উত্তরসুরিররা আজ নির্যাতনের, নিপীড়নের শিকার, দিশেহারা মজলুম। যাদের সারা দুনিয়া শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাত তারা আজ ঘৃণীত, অপমানিত, অপদস্ত। যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, আদল-ইনসাপে শৌর্য-বীর্যে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বিশ্বের বিস্ময় উৎপাদন করেছিল তারা আজ সর্বজাতির পশ্চাতে, সকলের করুণা-ভিখারী। অথচ সংখ্যা তাদের ১৪০ কোটি, দেশ তাদের অর্ধ-শতাধিক, সম্পদ তাদের অঢেল, অফুরন্ত। আর এই অধঃপতনের কারণ একটাই- তাঁর শিক্ষা, আদর্শ থেকে আমরা বহুদূরে সরে গেছি। সেই আদর্শে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আমাদের মুক্তি নাই, কল্যাণ নাই। একমাত্র তাঁর নির্দেশিত পথে চলে, তাঁর আদর্শ ধারণ করেই সেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কবি ইকবাল মহান আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন :
‘কি মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে তু হাম তেরে হ্যায়/ইয়েহ জমিন চিজ হ্যায় কেয়া লওহ করম তেরে হ্যাঁয়’।
মুহম্মদের (স:) সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করলে ভূমন্ডল কোন ছার, নভোমন্ডলের কর্তৃত্বও এসে যাবে তোমার কব্জায়।

 



 

Show all comments
  • মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান ৩ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৮:৩৩ এএম says : 0
    মারহাবা, এমন লেখা খাস আশেকে রাসূল শিরোতাজ আল্লামা রুহুল আমিন খান সাহেব ছাড়া কেহ লেখতে পারে না।ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহঃ) এর খাস মায়ার মানুষ খান সাহেব। জাযাকাল্লাহ। বারাকাল্লাহ ফি হায়াতি।
    Total Reply(0) Reply
  • MD. MONSUR ALAM ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৯:৫১ এএম says : 0
    noor nabijir sommaney jey sotto gatona akhaney tuley dora hoyeche ai jonno lekhok key antorik donnobad janassi.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদে মিলাদুন্নবী


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ