Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে বসনিয়ার কসাই রাটকো ম্লাদিচের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গণহত্যায় অভিযুক্ত ‘বসনিয়ার কসাই’ নামে কুখ্যাত সাবেক সার্ব কমান্ডার রাটকো ম্লাদিচকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তদন্তে গঠিত জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনাল বুধবার বসনিয়ার স্রেব্রেনিসায় গণহত্যা বিয়ষক মামলার রায় ঘোষণা করে।
গণহত্যার ২২ বছর পর এ রায় হল। খবর আল জাজিরা। ১৯৯১ সালে যুগোশ্লোভিয়া সোশ্যালিস্ট ফেডারেশন ভেঙে পড়ার সময় ম্লাদিচ ছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। পরের বছর বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তার নির্দেশে সার্ব বাহিনী দেশটিকে দুই টুকরো ফেলে। তখন তিন বছর ধরে চলে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধ। এতে প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত হন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত রাটকো ম্লাদিচ ছিলেন তৎকালীন সার্ব সামরিক প্রধান। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে সেখানে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ওই ঘটনায় অন্তত ৮ হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল। সাড়ে চার বছরের বিচারকার্য চলার পর গত বছর ডিসেম্বরে আইনজীবীরা যুদ্ধাপরাধে তার যুক্ত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের দাবি জানান। বুধবার দেওয়া রায়ে ম্লাদিচকে ওই হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা আখ্যা দেওয়া হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী, তখন তার নির্দেশেই সৈনিকরা ব্যাপক গণনিপীড়ন চালায় ।
খবরে বলা হয়, দুই দশক আগের বলকান সংঘাতের সময়কার গণহত্যায় তার সংযোগ পেয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। রাটকো মøাদিচের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনাকারী বিচারক জানিয়েছেন, সেই সময়কার গণহত্যায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ¯øাভিচের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সংঘটিত সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার ঘটনায় ‘বসনিয়ার কসাই’খ্যাত ম্লাদিচকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশেষ এই ট্রাইব্যুনাল যুগো¯øাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তাদের কার্যক্রমের সমাপ্তি টানলো। এটাই ট্রাইব্যুনালের শেষ রায়।
মøাদিচ সব অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে তিনি আপিল করতে পারেন।
বসনিয়া যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ সার্বিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ডাচ সদস্যরা এলাকাটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই মøাদিচের বাহিনীর আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল ডাচ শান্তিরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করে। সার্ব বাহিনী এরপর শহরটির পুরুষ ও বালকদের নারীদের কাছ থেকে আলাদা করে। পুরুষদের বাসে করে সরিয়ে নিয়ে কিংবা দূরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ব্রোঞ্জের বর্ম পরা মøাদিচ স্রেব্রেনিৎসার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ক্যামেরার সামনে তিনি শিশুদের মাঝে চকোলেট ও মিষ্টি বিলি করেন।
গণহত্যার ওই ঘটনায় স্বামী-সন্তানহারানো এক নারী মুনিরা সুবাসিচ। তিনি রয়টার্সকে বলেন,“ক্যামেরার সামনে তিনি (ম্লাদিচ) বলছিলেন কিছুই হবে না এবং আমাদের ভয় পাওয়ারও কারণ নেই।“ক্যামেরা চলে যাওয়ার পর তিনি তার সৈন্যদের যাকে যাকে হত্যা করা যায় তাদেরকে হত্যা করতে, যাকে যাকে ধর্ষণ করা যায় তাদেরকে ধর্ষণ করার নির্দেশ দেন। সবশেষে আমাদের বলেন, স্রেব্রেনিৎসা থেকে পালিয়ে যেতে, যেন তিনি সেখানে ‘জাতিগতভাবে শুদ্ধ’ একটি শহর প্রতিষ্ঠা করতে পারেন,”বলেন মুনিরা।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পারসনের (আইসিএমপি) কর্মীরা পরে স্রেব্রেনিৎসার গণকবর থেকে মুনিরার ছেলে নারমিন ও স্বামী হিলমোর দেহাবশেষ উদ্ধার করে। গণকবরগুলোতে পাওয়া দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে প্রায় ৭ হাজার নিহতের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
মøাদিচের বিরুদ্ধে মোট ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পাশাপাশি সারায়েভো অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সার্ব বাহিনী সারায়েভো অবরোধ করে রেখেছিল। তাদের নিক্ষেপ করা গোলা ও স্নাইপারদের গুলিতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বুধবার শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতের আইনজীবী অ্যালান টিগার বলেন, ‘তাকে (ম্লাদিচ) যাবজ্জীবন কারাদন্ড থেকে কম সাজা দেওয়া হলে তা হবে জীবিত বা মৃত নিপীড়িত ব্যক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতি অপমান।’
বেশ কয়েকদফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত মøাদিচের স্বাস্থ্যের কারণেই বিচার দীর্ঘায়িত হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে। একই কারণ দেখিয়ে সাবেক এ সার্ব কমান্ডারের আইনজীবীরা শেষ মুহুর্তে রায় মুলতু্বি রাখারও আবেদন জানিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তাতে সাড়া দেননি। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ম্লাদিচ যদি হত্যাকান্ডের সরাসরি নির্দেশ নাও দিয়ে থাকেন তাও অধস্তনদের কৃতকর্মের দায় তার ওপর বর্তায়। এর আগে যুগোসøাভিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটিওয়াই) মøাদিচের চার অধস্তনকে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন দিয়েছিল।
বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ¯েøাভোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে মিলে ম্লাদিচ বসনিয়া থেকে মুসলমানদের সরিয়ে ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠা করতে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিকল্পনা করেন বলেও ভাষ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের।“(মøাদিচের) যাবজ্জীবন ছাড়া অন্য যে কোনো রায়ই হবে নিহতদের জন্য অপমান, ন্যায় বিচারের জন্য অপমান,” আদালতে বলেন তদন্ত কর্মকর্তা অ্যালান তিয়েগার। গণহত্যার পর ১৯৯৫ সালে কারাদজিচের সঙ্গেই অভিযুক্ত হন ম্লাদিচ; ২০১১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারদজিচকে ২০১৬ সালে ৪০ বছরের কারাদন্ড দেয় আইসিটিওয়াই। আর নিজেকে নির্দোষ দাবি করা মিলোসেভিচ ২০০৬ সালে বিচার চলাকালে জেলের মধ্যেই মারা যান। বসনিয়া যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইসিটিওয়াই বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও কসোভোর ১৬১ জনের বিচার করেছে। এর মধ্যে ৮৩ জনই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে সার্ব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কারাদন্ড


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ