পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধে ওষুধের বিকল্প নেই। একই রোগের ওষুধ আবিষ্কারের পর তা গবেষণার মাধ্যমে আরও উন্নত এবং কার্যকর করার প্রক্রিয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। একই গ্রæপের এই ওষুধ প্রায় প্রত্যেকটি কোম্পানিই উৎপাদন করে। দেখা যাচ্ছে, একেক কোম্পানির উৎপাদিত একই ওষুধের মানে যথেষ্ট হেরফের হয়। এর উপর রয়েছে নকলের প্রবণতা। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দেশে এখন রোগ নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ওষুধ ভেজালে আক্রান্ত। নকল ও মানহীন ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। কোনো ধরনের গুণগতমান পরীক্ষা ছাড়াই ১৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বাজারে রয়েছে। যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর উৎপাদিত ওষুধের শতকরা ৭০ ভাগের মান পরীক্ষা ছাড়াই বাজারজাত করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ল্যাবে কোনোরকমে মান পরীক্ষা করে বাজারজাত করছে। এদের মান সঠিক না বেঠিক, তা নির্ণয়ের প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যেন কোনো ভূমিকাই নেই। প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, লোকবলের সংকটের কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। একই ব্যক্তিকে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন, লাইসেন্স বিতরণসহ অফিসের অন্য কাজও করতে হচ্ছে। এ এক ভয়াবহ চিত্র।
স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের উন্নতির কথা সরকারের তরফ থেকে অহরহ বলা হচ্ছে। এই খাতে বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কী ধরনের সেবা সাধারণ মানুষ পেয়ে থাকে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অনিয়ম, অবহেলা, ভুল চিকিৎসা, রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে সরকারি ওষুধ না পাওয়া সরকারি হাসপাতালগুলোর নিত্যকার চিত্র। এ নিয়ে অনেক অভিযোগ এবং পত্র-পত্রিকায় বছরের পর বছর ধরে লেখালেখি হলেও, এর কোনো উন্নতি নেই। সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে অপর্যাপ্ত ও যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার সুযোগে বেসরকারি খাতে ব্যয়বহুল ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব অনেক হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এগুলোর কিছু বাদে বেশিরভাগই সুচিকিৎসার পরিবর্তে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অসহায়-দরিদ্র রোগীদের পক্ষে এখানে চিকিৎসা করা এক প্রকার অসম্ভব। অনেক সময় রোগীদের জিম্মি করে ব্যবসা করার সংবাদও পাওয়া যায়। দেশের চিকিৎসা সেবার এই অনিয়মের মধ্যেই মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে রয়েছে, ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ। একদিকে আমাদের কিছু কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে ওষুধ রপ্তানি করছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ কোম্পানির ওষুধই গুণগত পরীক্ষা ছাড়া বাজারজাত করা হচ্ছে। এর সাথে রয়েছে, নকল ওষুধ তৈরির কারখানা। প্রায়ই এসব কারখানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব কারখানার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা কতটা নেয়া হয়, তা অনেকটা অজানাই থেকে যায়। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আইনের দুর্বলতার কারণে, সেসব কারখানা পুনরায় নকল ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। শুধু তাই নয়, অনুমোদনহীন অসংখ্য ফার্মেসিও চালু রয়েছে। নকল ওষুধ বাজারজাতকরণে এসব ফার্মেসির ভূমিকা রয়েছে। অনেক সময় এসব ফার্মেসির মালিক বা কম্পাউন্ডারই চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করে। তারাই মানহীন ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির ওষুধ খেতে রোগীদের প্ররোচিত করে। শুধু তাই নয়, অনেক নামকরা ওষুধ কোম্পানির ওষুধও যথাযথভাবে কার্যকর নয়। অতি সাধারণ ওষুধ প্যারাসেটামল ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের কথাই যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে, এর মান কোম্পানিভেদে একেক রকম হয়ে থাকে। আবার ভেজাল প্যারাসেটামল খেয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। একই গ্রæপের ওষুধের মানের এমন হেরফের হবে কেন? এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওষুধের মানের বিষয়টি যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে না। বাজারে থাকা ২৭ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধের মধ্যে যদি ১৪ হাজারের বেশি পরীক্ষাহীন থেকে যায়, তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না ওষুধের বাজার কতটা নিয়ন্ত্রণহীন ও শঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। ওষুধের মানহীনতার পাশাপাশি এর দামও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সংসারের আয়ের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ওষুধের পেছনে চলে যাচ্ছে। দাম দিয়ে ওষুধ কিনেও যদি রোগের যথাযথ উপশম পাওয়া যেত, তবে কিছুটা হলেও সান্ত¦না পাওয়া যেত। এর পরিবর্তে ভেজাল ও মানহীন ওষুধের দৌরাত্মে মানুষের জীবনই বিপন্নের আশঙ্কার মধ্যে পড়েছে। এসব দেখার দায়িত্ব যে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের, সে যে যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না, তাতে সন্দেহ নেই। বছরের পর বছর ধরে জনবল সংকটের অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছে। তার এই সংকট কবে কাটবে, তা অনিশ্চিত।
রোগ নিরাময়ে সহায়ক ওষুধের নি¤œমান ও ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সুস্থ্যতার পরিবর্তে অসুস্থ্যতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এতে মানুষের জীবন যেমন সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে, তেমনি অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। ওষুধ কিনতে গিয়ে অনেক পরিবারকে নিঃস্বও হতে হচ্ছে। ওষুধের পেছনে অর্থ খরচ করছে ঠিকই, রোগ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। এর পেছনে যে ওষুধের গুণগত মানের অভাব ও ভেজাল ওষুধ দায়ী, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যেখানে নি¤œমধ্যবিত্ত দেশ থেকে আমরা মধ্যবিত্ত দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি বলে বলা হচ্ছে, সেখানে যদি জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে থাকে, তবে এ লক্ষ্য পূরণ সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। অসুস্থ্য মানুষ নিয়ে কখনো কোনো জাতিই অগ্রসর হতে পারে না। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানহীন ও ভেজাল ওষুধ যারাই উৎপাদন করুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে যারা মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। ওষুধ অধিদপ্তরকে কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে লোকবল সংকট দূর করার পাশাপাশি ওষুধের বাজার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।