Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

১৬ স্কুলের শিক্ষার্থীর নৌকাই ভরসা

শীত মৌসুমে জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে চলে ক্লাস

| প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উথান মন্ডল, নাজিরপুর (পিরোজপুর) থেকে : সড়ক যোগাযোগ নেই, আছে শুধু বিস্তীর্ন খাল আর বিল। এমন অবহেলিত জনপদের কোমলমতি শিশুদের স্কুলে আসা যাওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা। যে বয়সে এ সকল শিশুরা বাবা-মায়ের হাত ধরে অথবা যে কোনো নিরাপদ বাহনে বা পরিবেশে স্কুলে যাওয়া-আসা করবে। সে বয়সে এ অবহেলিত জনপদের শিশুরা বছরের বার মাসই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেরাই নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করছে। বর্ষা মৌসুমে তারা সহজেই নৌকা যোগে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমের শেষে দিকে পড়তে হয় কচুরিপানার বিড়ম্বনায়। আবার শীত মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকাও চলে না। তখন জোয়ারের অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এ সময় জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে চলে বিদ্যালয়ের পাঠদান।
এভাবে নানা জানা-অজানা শঙ্কায় পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ইউনিয়নের অবহেলিত বিলাঞ্চলের ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের বার মাসই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। জোয়ার ভাটার খেলায় সামান্য ঢেউয়ে নৌকা উল্টে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আছে জীবন হারানোর ভয়। তবুও ঝুঁকি নিয়েই রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার একমাত্র বাহন কেবল নৌকা। গত শনিবার সকাল ১০টায় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে এ অবহেলিত বিলাঞ্চলে পৌছে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে দেউলবাড়ী ইউনিয়নটি সবচেয়ে অবহেলিত। এ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য কোন সড়ক যোগাযোগ নাই। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও এ বিলাঞ্চলে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। এ ৬টি ওয়ার্ডেই রয়েছে ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ৩টি দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা। এ ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতায়াতের জন্য কোন সড়ক যোগাযোগ নেই। এ প্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা নৌকা।
বর্ষা মৌসুমের চিত্র চারিদিকে পানি আর পানি। আবার শীতকালে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। তখন পড়তে হয় ভিন্ন সমস্যা। তখন জোয়ার-ভাটা নির্ণয় করে দেয়া হয় স্কুলের সময়সূচি। অর্থাৎ- খালে জোয়ার এলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় এবং জোয়ার শেষ হওয়ার আগে অথবা পরবর্তী জোয়ারে তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। পরবর্তী জোয়ার পেতে অনেক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। অবহেলিত এ জনপদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দারিদ্র পরিবারের হওয়ায় স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না কেউ। তাছাড়া বিলাঞ্চল হওয়ায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রমও নেই এখানে। ফলে শিশুরা ক্ষুধার তাড়না নিয়ে ক্লাস করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ অবহেলিত বিলাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা ও একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, আমাদের ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাষ্টার মো. ওয়ালিউল্লাহ। তার বাড়ী এই বিলাঞ্চলেই। এ বিলাঞ্চলের ৬ ওয়ার্ডের মানুষ অবহেলিত বিলাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তাকে পর পর তিন বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে। প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই তিনি ইউনিয়নের শহরাঞ্চল বলে খ্যাত গাওখালি বাজারে বাড়ী করে সেখানে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। অবহেলিত বিলাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষে ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বাহাদুর জানান, বিলাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। অধিকাংশ স্থান বর্ষা মৌসুমে ডুবে থাকে, নৌকা ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকে না। শীতকালে খালে পানি থাকে না। তখন অবস্থা আরো খারাপ হয়। জোয়ার-ভাটা দেখে স্কুলে যেতে-আসতে হয়। আবার নৌকা কিনে স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থা অনেকের নেই। অনেক সময় যে জায়গায় স্কুল সেখানে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য কোনো নৌকাও পাওয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে অনেক শিশু বর্ষাকালে স্কুলে যেতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চায় না। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষা বিভাগ থেকে বর্ষাকালে স্কুলে যাতায়াত করার জন্য যান্ত্রিক নৌকার ব্যবস্থা করা উচিত। উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ রায় বলেন, এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খালে পানি থাকে তখন নৌকায় আসা-যাওয়া করা যায়। অক্টোবর ও নভেম্বরে কচুরিপানার কারণে খাল বন্ধ হয়ে যায় তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে আসতে পারে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে খালে পারি থাকে না তখন জোয়ার-ভাটা অনুসরন করে স্কুল চালাতে হয়। মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমীরণ রায় জানান, বছরের ১২ মাসই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ৬ কিলোমিটার রাস্তা হলে এই দুর্ভোগ আর থাকে না। মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনিল বড়াল বলেন, আমার স্কুল থেকে প্রতি বছরই শতভাগ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে থাকে। শিক্ষক মাত্র ১২ জন। টিনশেড স্কুলে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এখানে একটি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণের কথা থাকলেও তা নির্মাণ করা হয়নি। সাইক্লোন সেল্টারটি নির্মাণ করা হলে পাঠদানে আর ঝুঁকি থাকবে না।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিলাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এ কারণে স্কুলে উপস্থিতিও কম। সার্বিক বিষয়ে কথা হলে পিরোজপুর জেলা প্রশাসক মো. খায়রুল আলম শেখ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে’-এ কথা শুনে আমি সরেজমিন দেখতে গিয়েছি। স্কুলগুলোর বিরাজমান সমস্যা সমাধানের জন্য শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্কুল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ