চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম। ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানবজীবনের সকল সমস্যার সার্থক সমাধান রয়েছে ইসলামে। যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করে মানবজাতির অর্থনৈতিক সমস্যার সার্থক সমাধানের পথ সুগম করে দিয়েছে শাশ্বত সুন্দর ও সত্য-ন্যায়ের ধর্ম ইসলাম। মূলতঃ যাকাত ব্যবস্থার পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে কোন সমাজে দারিদ্র্য থাকতে পারে না। সম্পদের যাকাত আদায় করা ফরজ। অন্যান্য সম্পদের ন্যায় ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের ও নির্ধারিত যাকাত রয়েছে। এটা আদায় করা ফরজ। শরীয়তের পরিভাষায়-ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ ও ‘খিরাজ’ বলে। অর্থাৎ জমি উশরী হলে যা আদায় করতে হবে তা ‘উশর’ এবং জমি খিরাজী হসলে যা আদায় করতে হবে তা ‘খিরাজ’। মুসলমানের মালিকাধীন ভূমিই হচ্ছে উশরী ভূমি। ‘উশর’ এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে-একদশমাংশ। মুসলমানের মালিকানাধীন ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের একদশমাংশ বা দশ ভাগের এক ভাগ অথবা একদশমাংশের অর্ধেক তথা বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দেয়াকে ‘উশর’ বলে। অর্থাৎ মুসলমানের মালিকানাধীন যেসব জমিকে বৃষ্টির পানি এবং নদীর পানি সিক্ত করে কিংবা স্বভাবতই সিক্ত থাকে-এমন জমি থেকে উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে এবং যেসব জমিকে সেচের মাধ্যমে সিক্ত করা হয়-এমন জমি উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। অন্যান্য সম্পদের যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর মালিকানাধীন থাকা শর্ত কিন্তু ফসলের যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে সেই ফসল এক বছর মালিকানাধীন থাকা শর্ত নয়। বরং যখনই ফসল হস্তগত হবে তখনই উশর আদায় করতে হবে। এমনকি বছরে যতবার ফসল উৎপাদন হবে ততবারই ফসলের দশভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।
ফসলের যাকাত আদায় করা ফরজ। এ বিষয়টি পবিত্র কোরআন দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। ইরশাদ হচ্ছে-“তার ফসল উৎপাদিত হলে তা তোমরা খাও এবং ফসল কাটার দিনই তার হক আদায় কর” (সূরা আনআম : আয়াত-১৪১)। উক্ত আয়াতে ‘ফসল কাটার দিনই তার হক আদায় কর’-এখানে ‘হক’ দ্বারা যাকাতকে বুঝানো হয়েছে। আর ফসলের যাকাত হচ্ছে ‘উশর’। তাই উক্ত আয়াতের মর্মানুযায়ী ‘উশর’ আদায় করা ফরজ প্রমাণিত হল। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর” (সূরা বাকারা : আয়াত-২৬৭)। উক্ত আয়াতেও বাধ্যতামূলকভাবে ফসলের যাকাত তথা ‘উশর’ আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘উশর’ এর যাকাত সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘যে জমিকে বৃষ্টির পানি অথবা নদীর পানি সিক্ত করে অথবা স্বভাবতই সিক্ত হয় তাতে ‘উশর’ অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর যে জমিকে সেচের মাধ্যমে সিক্ত করা হয় তাতে ‘অর্ধ উশর’ অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে (বুখারী-১ম খÐ : পৃষ্ঠা-২০১, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-১৫৯)। উক্ত হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত যে জমিকে বৃষ্টির পানি, নদীর পানি দ্বারা সিক্ত করে ফসল উৎপাদন করা হয়-পরিশ্রম করে পানি সেচের ব্যবস্থার করতে হয় না, সেসব জমির উৎপাদিত ফসলের একদশমাংশ (দশ মন হলে এক মন) উশর হিসেবে দিতে হবে। আর যে জমিতে পরিশ্রম করে পানি সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা হয়-সেসব জমির উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ (বিশ মন হলে এক মন) উশর হিসেবে দিতে হবে।
উশর এর নিসাব কী? বা কী পরিমাণ ফসল হলে উশর আদায় করতে হবে-এ সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর মতে-উশর এর নির্ধারিত কোন নিসাব নেই। যে পরিমাণ ফসলই উৎপাদন হোক না কেন উশর (দশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করতে হবে। হানাফী ফিকহের কিতাবাদীতে উশর এর নিসাবের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার মতের পক্ষে ফতোয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতে-উশর এর নিসাবের পরিমাণ পাঁচ ওসাক (প্রচলিত মাপে ৯৪৮ কেজি)। অর্থাৎ ফসলের পরিমাণ ৯৪৮ কেজি হলে উশর (দশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করতে হবে-এর কম হলে উশর আদায় করতে হবে না। কোন কোন কিতাবে মুতাআখখিরীনদের মতে-ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উশরী ভূমিতে উৎপাদিত ধান, গম ইত্যাদির মত ফলমূল, শাক-সবজিরও উশর দিতে হবে। প্রাপ্ত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ বা এর বাজার মূল্য দিয়েও উশর আদায় করতে পারবে। বর্গা চাষের ক্ষেত্রে জমির মালিক এবং চাষী প্রাপ্ত ফসলের নিজ নিজ অংশের উশর আদায় করতে হবে। অন্যান্য সম্পদের যাকাত যাদের মধ্যে বণ্টন করা হয় উশরের যাকাত তাদের মধ্যেই বণ্টন করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে উশর আদায় হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতে উশর এর গুরুত্ব অপরিসীম। যাকাতে উশর সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপকৃত হবে। তাই যাকাতে উশর বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।