Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফিরে দেখা স্বাধীনতার মাস

প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : ১৯৭১-এর ১৮ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। লাগাতার চলতে থাকা অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিন। স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভের আশায় মুক্তিকামী প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবনে। আগের দু’দিনের কারণে এই দিনটি অনেক বেশি উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কাটে সচেতন বাঙালির। মঙ্গল ও বুধবার বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক নিষ্ফলভাবে শেষ হওয়ার কারণে পুরো জাতির মধ্যে এই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। বাংলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ ধারণা করতে থাকে শিগ্গিরই নতুন কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হবে। আর ওই সঙ্কট যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এদিকে আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৭ মার্চ শুরু হওয়া সামরিক মহড়া আরো সক্রিয় করা হয়।
এদিকে গত ২ মার্চ হতে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কি পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়েছিল তার তদন্তের জন্য সামরিক প্রশাসক ৫ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেহেতু, সামরিক কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা না করার জন্য তিনি সকলের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, আমি দুঃখিত যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ হতে উত্থাপিত আমার দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশ বলে এই সামরিক কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছেই এর রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর। বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সেনাবাহিনী তলব ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা তা তদন্ত করতে হবে বিধায় মূল বিষয় সম্পর্কে শুনানির আগেই বিচার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নির্যাতনমূলক কার্যকলাপে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে সে সম্পর্কেও তদন্ত করার এখতিয়ার তদন্ত কমিশনকে দেয়া হয়নি। আর তাই কতজন মারা গেছে, কী পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা হয়েছে সেটিও তদন্ত করে দেখা যাবে না। এহেন কমিশনের দ্বারা কোনো ফলপ্রসূ লক্ষ্য হাসিল হতে পারে না। বস্তুত, এটি মোটেই সত্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি যথাযথ তদন্ত হবে না। হবে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার একটি ফন্দি মাত্র। তাই আমরা এ কমিশন মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ কোনো প্রকারেই এধরনের কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না। কেউ এ কমিশনে কোনো সদস্য মনোনীত করবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না।
১৯৭১ সালের এইদিনে আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কয়েকটি তারবার্তা পাঠায়। ওই বার্তায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের গণহত্যা চক্রান্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে গণহত্যা থেকে তাদের বিরত রাখার জন্য তাদের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানান। পাকিস্তান সামরিক জান্তার অবস্থা বুঝতে পেরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আজকের দিনে এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই বিমান চলাচল বন্ধের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ। একই বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের সমর্থন কামনা করা হয়। বিবৃতিতে চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকাসহ শক্তিশালী দেশগুলোকে তাদের সরবরাহ করা অস্ত্রের দ্বারা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর প্রয়াস বন্ধ করারও আবেদন জানায়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনার সরেজমিন তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি দলীয় তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামে পাঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকায় বিমান বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এদিন সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর তেজগাঁও এবং মহাখালীতে নিরস্ত্র ট্রাক আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রাতে পাকিস্তান সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয়, ‘১৯ মার্চ সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট হাউসে আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে আবার তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ইরনা এলিজাবেথ নামের জাহাজটি গতিপথ বদল করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগের রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য জাতির জনকের ৩২ নম্বরের বাসা নীরব থাকলেও সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মিছিল-সেøাগানে প্রকম্পিত হয়ে ছিল এ ভবনের চারপাশ।
এছাড়া আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কয়েক শত লোক মিছিল সহকারে এসে এইমর্মে অভিযোগ করেন যে, গত কয়েকদিন যাবত সেনাবাহিনীর সদস্যরা যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকার মহাখালী এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর জোর-জুলুম করে মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা এবং দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, কোনোরূপ উস্কানিমূলক আচরণ যে মহলই করুক না কেন তা সহ্য করা হবে না এবং এর দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে। এদিকে নিউজ পেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের লক্ষ্যে সকল বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রস্তুত হওয়ার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফিরে দেখা স্বাধীনতার মাস


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ