Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুদীপ্তের খুনিরা চিহ্নিত!

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

‘এখন ছাত্রলীগই ছাত্রলীগের রগ কাটে খুন করে’
 ‘আগে দেখতাম ছাত্রশিবিরের ছেলেরা ছাত্রলীগের রগ কাটতো, খুন করতো এখন দেখছি ছাত্রলীগই ছাত্রলীগের রগ কাটে, খুন করে’- নিজের ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. গাজি সালেহ উদ্দিন। চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটে মহানগর ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস রুবেল হত্যার প্রেক্ষিতে দেয়া তার এ স্ট্যাটাসকে সমর্থন করেছেন অনেকে। অনেকে নিজেদের অভিমতও তুলে ধরেছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছাত্রলীগের শত্রু এখন ছাত্রলীগ। আদর্শিক লড়াই নয়, স্বার্থের দ্ব›েদ্ব নিজেরাই নিজেদের নেতাকর্মীদের হত্যা করছেন তারা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘাট নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে দলীয় পদ-পদবি ভাগিয়ে নিতেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দলীয় কোন্দলের জেরে অন্তত ১০ নেতাকর্মী খুন হয়েছে। এ হত্যাকান্ডের সর্বশেষ শিকার সুদীপ্ত বিশ্বাস। অন্য হত্যাকান্ডগুলোর মত এ ঘটনায়ও খুনীরা কেউ ধরা পড়ছে না। শুক্রবার সকালে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সুদীপ্তকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গতকাল (রোববার) সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, সুদীপ্তের খুনীচক্রের সদস্যরা চিহ্নিত হয়েছে। তারা এখন পুলিশের জালে। সবুজ সংকেত পেলেই তাদের পাকড়াও করা হবে।
নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সুদীপ্তের খুনীদের পেছনে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন নেতা। এ কারণে খুনীদের পাকড়াও করা যাচ্ছে না। সরকারি দলের তরফে সবুজ সংকেত পেলেই তাদের যেকোন সময় পাকড়াও করা হবে। তিন দিনেও খুনীদের কেউ ধরা না পড়ায় হতাশ সুদীপ্তের পরিবারের সদস্যরা। তার রাজনৈতিক সহকর্মী ও বন্ধুরা বলছেন, অন্য হত্যাকান্ডের মত সুদীপ্তের খুনের ঘটনাও চাপা পড়বে। খুনীরা থেকে যাবে আড়ালে। চট্টগ্রামে দেড় বছরে ছাত্রলীগের চারজন নেতা খুন হলেও প্রতিটি হত্যাকান্ডে জড়িত মূল ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ায় বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির নেতারা। এজন্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভেদকে দুষছেন তারা। ওইসব মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশও চাপে রয়েছে। প্রতিটি খুনের পেছনে বড় নেতাদের মদদ থাকায় খুনীদের ধরার সাহস পায় না পুলিশ। ফলে বিচার পাচ্ছে না নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা।
শুক্রবার সকালে নগরীর নালাপাড়ায় নিজের বাসার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। তার বাবা স্কুল শিক্ষক বাবুল বিশ্বাস ওইদিন রাতে সদরঘাট থানায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। নিহত সুদীপ্ত মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে দলীয় কলহের জেরে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। হত্যা মিশনে যারা ছিল তাদের চিহ্নিতও করেছে পুলিশ।
নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খুনের মোটিভ পরিষ্কার, খুনীরাও চিহ্নিত। যেকোন সময় তাদের পাকড়াও করা হবে। খুনীরা যত প্রভাবশালীই হোক তাদের গ্রেফতারে কোন বাধা বা চাপ নেই বলে দাবি করে তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনার আমাদের সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এদিকে সুদীপ্তের সহপাঠীদের অভিযোগ, সিটি কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর শিকার হয়েছেন তিনি। জানা যায়, বিগত কয়েক দশক ধরে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তার বিপরীতে একটি অংশ দাঁড়িয়েছে। তাদের একাংশের নেতৃত্বে আছেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতি, যিনি বর্তমানে নগরীর একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার অনুসারীরাই সুদীপ্তকে পিটিয়ে মেরেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ছাত্রলীগের মধ্যকার বিভেদ নিয়ে সুদীপ্ত ফেইসবুকে লেখালেখি করতেন। তাতেই ওই অংশের নেতারা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হন বলে মনে করছেন অনেকে। সুদীপ্তের সহপাঠী ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, সুদীপ্তের সাথে ছাত্রলীগের কারো ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকেও সুদীপ্ত দূরে ছিল। তবে সুদীপ্ত সবসময় ছাত্রলীগের আদর্শের প্রতি অটল ছিলেন। এ কারণে তিনি সবার সামনে সত্য বলতেন। সম্প্রতি তার ফেসবুকে দেয়া কয়েকটি স্ট্যাটাস তার জন্য কাল হয়েছে বলে দাবি করেন তার সহপাঠীরা। তাদের দাবি, ছাত্রলীগের কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পোস্ট দিয়েছিলেন সুদীপ্ত, সেজন্যই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ সূত্র ধরে তদন্ত এগিয়ে নিলে খুনীদের ধরা সহজ হবে বলে জানান তারা। আর তা না হলে দিয়াজ, সোহেল ও আরাফাতের মত সুদীপ্ত খুনের ঘটনাও চাপা পড়ে যাবে।
গত ফেব্রুয়ারী মাসে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার গ্রহণকালে মহানগর ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ইয়াছিন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ওই ঘটনায় জড়িতরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইয়াছিনের বন্ধুদের অভিযোগ, খুনীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা এখন প্রকাশ্যে ঘুরছে। অথচ পুলিশ তাদের ধরছে না। মামলা তদন্তও থেমে আছে। তার আগে ২০ নভেম্বর নিজের বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজ ইফরান চৌধুরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ২৯ মার্চ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হন ছাত্রলীগের নগর কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য নাছিম আহমেদ সোহেল। তাদের মধ্যে দিয়াজ ও সোহেল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের এবং সুদীপ্ত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী ছিলেন।
সোহেল খুনের ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে খুনিদের শনাক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন তার বাবা। ওই ভিডিওতে মো. ইব্রাহীম ওরফে সোহান নামে এক যুবককে সোহলকে ছুরিকাঘাত করতে দেখা যায়। নাছিম আহমেদ সোহেলকে ছুরিকাঘাতকারী ইব্রাহীম ওরফে সোহান গ্রেফতার হয়নি দেড় বছরেও। পুলিশ মামলার বেশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতার করলেও মূলহোতারা আড়ালে থেকে গেছে। সোহেল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার এসআই মো. শাজাহান বলেন, মামলাটি এখনও তদন্ত পর্যায়ে আছে। তদন্ত পুরোপুরি শেষ হলে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।
দিয়াজ ইরফান হত্যা মামলাটিও থমকে আছে। লাশ উদ্ধারের পর দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তখন দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ কাজের দরপত্র নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম ময়নাতদন্তের পর ২৩ নভেম্বর চিকিৎসকরা ‘আত্মহত্যা’র কথা বলেন। এরপর ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন বাদী হয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। তার আপত্তিতে লাশের পুনঃময়নাতদন্ত হয়। পুনঃময়নাতদন্তে প্রমাণ হয় দিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামশেদুল আলম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী প্রক্টরকে আসামি করা হয়। জামশেদ, টিপুও আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এখনো পর্যন্ত এ হত্যাকান্ডে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় কোন্দলে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী খুন হন। তাদের মামলাও ঝুলে আছে। দলীয় কোন্দলে খুন হন যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত, মেহেদী হাসান বাদলসহ আরও কয়েকজন। এসব মামলার তদন্ত এখন হিমাগারে।



 

Show all comments
  • md abdullh ৯ অক্টোবর, ২০১৭, ২:১৯ পিএম says : 0
    ছাত্রলীগ সংগটন টার মধ্য আদর্শ বলতে কিছু আছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা.... মানুষ রাজনীতি করে দেশের জন্য অতচ ছাত্রলীগ...করেনা এমন উপকর্ম একটাও নাই....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছাত্রলীগ

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ