Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পাশে নেই কেন

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করায় সরকারী মহল যথেষ্ট বিব্রত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে বলে যারা এতদিন সমস্বরে কোরাস গেয়েছেন তারা অনেকটা লাজওয়াব হয়ে গেছেন। তারপরও ওই যে কথায় বলে, মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবোনা! সুর পাল্টে তারা বার বার একথা বলার ও বুঝানোর চেষ্টা করছেন, ভারত এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে। এরপর যখন বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ভারত ত্রাণ পাঠালো তখন তারা তাদের কণ্ঠকে উচ্চগ্রামে তুলে জানান দিলেন, এই তো ভারত বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা যাই বলুন, যত আত্মপ্রসাদই লাভ করুন না কেন, পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা গরু মেরে জুতো দানের প্রকৃষ্ট নজির। ভারত মিয়ানমারের অবস্থান সমর্থন করা থেকে বিন্দুমাত্র সরে এসেছে, এর কোনো প্রমাণ নেই। বরং আগের মতই সে মিয়ানমারের অবস্থানের প্রতি দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমারের পাশে থাকবে ভারত। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে সেই অঙ্গীকারই পুনর্ব্যক্ত করেন। মিয়ানমার- নেত্রী অং সান সুচির সঙ্গে তার যে বৈঠক হয় সেখানে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ানমারের পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন। ওই বৈঠকে মোদি রোহিঙ্গা গণহত্যা, গণনির্যাতন, ও গণবিতাড়ন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করেন। অং সান সুচি ভারতের এই মনোভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এই মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে, দু’দেশ একযোগে সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে পারবে। আমাদের জানা মতে, ভারত এখনো রোহিঙ্গা গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের নিন্দা জানায়নি। বাংলাদেশে যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে টু শব্দটি উচ্চারণ করেনি। উল্টো ভারতে আশ্রয় নেয়া ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এখন নতুন-পুরানো মিলে ১০/১১ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এতে বাংলাদেশ যে বড় রকমের একটা সংকটে পতিত হয়েছে সে ব্যাপারে তার কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বন্ধু হিসাবে এই সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের পাশে থাকা তার উচিৎ ছিল। এ কথাটি যেন সে ভুলেই গেছে।
সুসময়ে নয়, অসময়েই বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এই অসময়ে ভারত বন্ধুর পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কি ভারতের কাছে কমে গেছে? বাংলাদেশ ভারতের জন্য, ভারতের স্বার্থে কি না করেছে! ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের দমনে নিজের নিরাপত্তাস্বার্থ উপেক্ষা করেও সহযোগিতা করেছে। ট্রানজিট-করিডোর-বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিতে সম্মত হয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ভারতের স্বার্থে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এসবের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। সামান্য তিস্তার পানিচুক্তি পর্যন্ত হয়নি। বলা যায়, বাংলাদেশের কাছে যা কিছু চাওয়ার ও পাওয়ার ছিল, ভারত তার সবকিছুই অবলীলায় পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের যা কিছু চাওয়ার ও পাওয়ার ভারত তার কিছুই দেয়নি। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো কোনো কিছু না পেয়েই আমাদের ক্ষমতাসীনরা বেজায় খুশী। এর কিঞ্চিৎ জবাব রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন। বাংলাদেশের অবস্থাকে ভারত বিন্দুমাত্র গ্রাহ্যে আনার গরজ দেখায়নি।
রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের সৃষ্টি নয়। এটা সম্পূর্ণই মিয়ানমারের সৃষ্টি। বাংলাদেশ পরিস্থিতির শিকার। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীরা রাখাইনে নৃশংস গণহত্যা, বর্বর নির্যাতন ও দমনপীড়ন চালাচ্ছে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা এক বাক্যে স্বীকার করেছে ও করছে। হত্যা-নির্যাতনের একটি লক্ষ্য যে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া, সে ব্যাপারেও কোনো দ্বিধা বা সংশয় নেই কারো। গত মাসাধিককালে ৬/৭ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ এর প্রমাণ বহন করে। এখনো দলে দলে রোহিঙ্গারা আসছে। রাখাইনে মাইকিং করে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে। এর অর্থ পরিষ্কার, ‘হয় গুলিতে-নির্যাতনে নিহত হও, না হলে পালাও।’ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এই বোঝা ঘাড়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ মুহূর্তে ‘বন্ধুদের’ সমর্থন ও সহযোগিতা বাংলাদেশের খুবই প্রয়োজন। অথচ, ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিবেশী এবং শক্তিধর দেশগুলো, যারা কিনা বাংলাদেশের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত, সরে দাঁড়িয়েছে। তারা পক্ষ নিয়েছে মিয়ানমারের। বাংলাদেশ কার্যত বন্ধহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেরই অভিমত, বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে তাদের স্ট্রাটেজিক এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজিকে স্বার্থ রয়েছে। তাদের সমস্বার্থ বাংলাদেশেও রয়েছে। অথচ তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে, বাংলাদেশকে নয়। এটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কি বলা যায়! এই দেশত্রয় বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। বাংলাদেশেও তাদের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারকেই তারা অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ পুর্বাপর সচল ও সক্রিয় থাকলে এমনটি নাও হতে পারতো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারের অবস্থান সমর্থন করলেও এক ধরনের সর্তকসংযম সে অনুসরণ করছে। পক্ষান্তরে ভারত ও রাশিয়া আগ বাড়িয়ে মিয়ানমারের অবস্থানের পক্ষে কাজ করছে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা, রোহিঙ্গা ইস্যু এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে মিয়ানমারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। এমুর্হূতে গণহত্যা বন্ধ ও গণনির্যাতন রহিত করা জরুরি। এজন্য মিয়ানমারের ওপর কঠিন চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই। সেটা জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী দেশসমূহই করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারত, চীন ও রাশিয়া বিমুখ; বাকীরা সোচ্চার। বাকীরা যতই সক্রিয় হোক, তেমন ফলপ্রসু কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রশ্ন হলো, রাখাইনে হত্যা-নির্যাতন বন্ধ এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বসহ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবাসিত হতে পারবে কি? যদি না পারে, বাংলাদেশকে অনির্দিষ্টকাল ধরে এই সংকটের নিগড়ে আটকে থাকতে হবে। বাংলাদেশ যদি এখনো ভারত, চীন ও রাশিয়াকে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়, তাহলে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সহজ হবে। বাংলাদেশ কি সেটা পারবে এবং তারাও কি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে?
ভারত, চীন ও রাশিয়া তাদের নিজস্ব স্বার্থকেই প্রধানত আমল দিচ্ছে। ন্যয়নীতি, মানবিকতা ও বিশ্ব জনমতকে তারা বিবেচনায় আনার তাকিদ বোধ করছে না। ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে মিয়ানমার এবং বিশেষ করে রাখাইন রাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। রাখাইনকে ভিত্তি করে বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং আন্ত:রাষ্ট্রীক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। চীন সেখানে সমুদ্রবন্দর, গ্যাস পাইপ লাইন, রেল ও সড়ক যোগাযোগসহ বিভিন্ন প্রকল্পে সংযুক্ত আছে। রাশিয়া আছে অস্ত্র বিক্রীর তালে। মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্র রফতানির একটা বড় ক্ষেত্র। এখন যুদ্ধ বিমানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রীর সে ফিকিরে আছে। অন্যদিকে ভারত সমুদ্রবন্দর, গ্যাস আমদানি, কালাদান প্রকল্প, ত্রিদেশীয় যোগযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পে অংশীদারিত্ব করছে। তারা তাদের এই স্বার্থের বাইরে যেতে নারাজ। তারা মিয়ানমারকে কোনো ভাবেই চটাতে চাইছেনা। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশে কি তাদের কোনো স্বার্থ নেই? বাংলাদেশ কি এতই ফ্যালনা?
ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অবস্থান এক বরাবর। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক দেশ এবং মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রান্তিক দেশ। পূর্ব-পশ্চিম সংযোগের ক্ষেত্রে দুটি দেশই সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশ একে অপরের প্রতিবেশী। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই যে, বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা এই দুটি দেশের অধিকারভুক্ত। মিয়ানমার আকারে বাংলাদেশের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বড়। এর সম্পদ-সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। তাই বলে বাংলাদেশও সম্পদশূন্য দেশ নয়। বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের বিপুল বিনিয়োগ আগ্রহই এর প্রমাণ বহন করে। বাণিজ্যের দিক দিকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশ ১৬/১৭ কোটি মানুষের একটি বাজার। আর মিয়ানমার পাঁচ-সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের বাজার। চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখানে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীন আরো বিনিয়োগ করতে চায়। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় ৩৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা। তাছাড়া বাংলাদেশ চীনা পণ্যের একটি বড় বাজার। চীনের মতো ভারতও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এখানে সে চীনের প্রতিদ্ব›িদ্ব হিসাবে নিজেকে প্রদর্শন করতে চায়। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে দুটি চুক্তির মাধ্যমে ভারত মোট ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। ক’দিন আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঢাকা সফরের সময় আরও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। চীনের প্রতিশ্রত বিনিয়োগের তুলনায় এটা তেমন কিছু না হলেও কোনো দেশের সঙ্গে এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় ঋণচুক্তি। ভারতের পণ্যবাণিজ্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বৈধভাবেই সে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬০/৬৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানী করে। চোরাই পণ্যের তো কোনো লেখা-জোখা নেই। রাশিয়ায় সঙ্গেও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক একেবারে হেলাফেলার মতো নয়। রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের একটি চুক্তি রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে। আরও নানা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিকে সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই তিন দেশের বাংলাদেশকে সমর্থন না করা তাকে উপেক্ষা করা কিনা কিংবা আমাদের ব্যর্থতা কিনা সেটা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি।
এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান অন্য দু’দেশের তুলনায় খোলাখুলি। শুরু থেকেই ঘোষণা দিয়ে ভারত মিয়ানমারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। সেটা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে যেমন অনুধাবন করা যায় তেমনি ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ঠেলে দেয়ার প্রক্রিয়া, তাদের সঙ্গে আইএস’র সম্পর্ক আছে বলে অভিযোগ করা এবং সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপসহ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করার ঘটনা থেকেও বুঝা যায়। বিদেশী গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে কদিন আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায়, ভারত রোহিঙ্গাদের প্রবেশ রোধে তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করছে। তার অংশ হিসাবে সীমান্তে মরিচ ও স্ট্যান গ্রেনেড ব্যবহার করছে। বিএসএফ’র একজন কর্মকর্তা সাফ জানিয়েছেন, প্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের আমরা মারাত্মকভাবে আহত করতে বা গ্রেফতার করতে চাইনে; তবে ভারতের মাটিতে তাদের সহ্য করবো না। পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হলে আমরা গ্রেনেড ব্যবহার করবো। এর পরপরই ত্রিপুরার সীমান্তে দিয়ে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি ভারতের এই মনোভাব ও আচরণের পর যখন তাকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে দেখা যায় তখন তা প্রহসনের নামান্তর বলেই প্রতিভাত হয়। এই দ্বিচারিতায় বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
ভারত বাংলাদেশের নয়, মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে, তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ তাই বলছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবালের অভিমত স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি পূর্ব-পশ্চিম সংযুক্তি, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যাÐ-ত্রিদেশীয় মহাসড়ক, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিছিন্নতাবাদীদের দমন, মিয়ানমারে চীনা প্রভাব হ্রাস করে ভারতের প্রতাব সম্প্রসারণ ইত্যাদির জন্য মিয়ানমারের পাশে থাকতেই সরকারকে উপদেশ দিয়েছেন। পরিষ্কার বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দেখা উচিত নয়। তার আরো অভিমত, বাংলাদেশ যদি ভারতের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বেশি কিছু আশা করে, ভুল করবে। ঢাকাকে বুঝতে হবে, দিল্লীর পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি ভারতে আশ্রিত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা কিভাবে ভারতে ঢুকতে পেরেছে, সেই প্রশ্ন রেখে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সিল করে দিতে বলেছেন। অপ্রসঙ্গকিভাবে তিনি দাবি করেছেন ২ কোটি বাংলাদেশী নাকি ভারতে বসবাস করছে। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, তাদের বিষয়টি সামনে আনা ভারত সরকারের উচিৎ। উল্লেখ করা যেতে পারে, কানওয়াল সিবাল কেবল সাবেক পররাষ্ট্র সচিবই নন, বর্তমান বিজেপি সরকারের অন্যতম পরামর্শকও। বলা হয়, তার মতামতে বিজেপির অভিমতই প্রতিফলিত হয়। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, যে কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী মোদি বা তার সরকারের কেউ বলতে পারছেন না, সে সব কথাই কানওয়াল সিবাল লিখে বলে দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকার এখনো কানওয়াল সিবালের কথার বাইরে যায়নি। ভারতের সাবেক কূটনৈতিক ও বাংলাদেশে সাবেক হাই কমিশনার পিনক রঞ্জন চক্রবর্তী বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করা বাংলাদেশের ঠিক হবে না। তিনি আরো বলেছেন, রোহিঙ্গা তাদের সদস্য নয়। এ সমস্যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার। তিনি বাংলাদেশকে চীনের সহায়তা নিতে বলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বর্তমানে দিল্লী সফরে রয়েছেন। তাকে এর মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দু’ই ভারতের বন্ধু। অতএব, কারো পক্ষ নিয়ে ভারত আক্রমনাত্মক হতে পারবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরৎ নিতেও সে মিয়ানমারকে বলতে পারবে না।
সরকারী মহল থেকে যে যাই বলুন না কেন, বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু ভারতের এই ভূমিকাকে সহজভাবে নিচ্ছে না। এদেশের মানুষ সরকারেরও আগে গণহত্যা ও গণনির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এই ভ্রাতৃবোধ ও মানবতার প্রতি অঙ্গীকার বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব আঁচ করেই ঋণের ডালি নিয়ে অরুণ জেটলি বাংলাদেশে আসেন এবং মোটা অংকের ঋণ চুক্তি করেন। এতে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে সৃষ্ট ক্ষত উপশম হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার এই ভূমিকাকে এদেশের মানুষ কখনো ভুলে যাবে না।

 



 

Show all comments
  • খালেদ ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ৩:৫৩ পিএম says : 0
    ভারত তাদের নিজ স্বার্থ ছাড়া এক চুল পরিমাণও নড়ে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Gazi Rumi ৭ অক্টোবর, ২০১৭, ৪:৫০ পিএম says : 0
    কারন পাশে থাকলেও কোন কাজ হবেনা । যেহেতু চিন ,রুশ এখন এক সাথে ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ