Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

থমকে আছে চীনা বিনিয়োগ

আনোয়ারায় শিল্পজোন ও মিরসরাইয়ে বিদ্যুৎপ্রকল্প

শফিউল আলম : | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন স্থাপনের কাজ কিছুদূর এগিয়ে ফের স্থবির হয়ে পড়েছে। এ প্রকল্পের সড়ক ব্রিকসলিন পর্যন্ত আংশিক তৈরি হয়েছে। কিন্তু শিল্পপ্লট স্থাপনের মূল কাজই এখনও শুরু হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষের (বেজা) উদ্যোগে দেশের লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে মিরসরাইতে বৃহত্তম অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। তবে সেখানে চীনের উদ্যোগে বিদ্যুৎপ্রকল্প স্থাপনে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। আনোয়ারা এবং মিরসরাইয়ে থমকে আছে চীনের বিনিয়োগ। এ বছরের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত উভয় প্রকল্পকে ঘিরে যে সম্ভাবনা বজায় থাকে গত কয়েক মাসে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চীনা শিল্পোদ্যোক্তারা পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্যে প্রকল্পের অর্থ ছাড় করতে গিয়ে অঘোষিত ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করছে। এতে করে চীনা বিনিয়োগে প্রকল্প দুটি কবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা এখনও অনিশ্চিত। বিশেষত ভিত্তিফলক উদ্বোধনের পর এক বছর অতিক্রান্ত হলেও আনোয়ারায় ‘চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ স্থাপনের কাজ থমকে গেছে। এ কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগ সম্ভাবনা হোঁচট খাওয়ার মুখোমুখি। কেননা এ বছরের গোড়াতেই এই মেগাপ্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০২০ সালে সম্পন্ন হওয়ার টার্গেট রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের স¤প্রসারণ, সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ-সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ (বেজা) চীনা বিনিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, চীন আগের দেয়া আশ্বাস থেকে সরে আসেনি। ফলে প্রকল্প নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি।
বন্দরনগরীর অদূরে কর্ণফুলী নদীর ওপারে আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন মেগাপ্রকল্পটি হচ্ছে দেশের প্রথম একক বৃহৎ বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্প। যা প্রথম জি-টু-জি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগপুষ্ট (এফডিআই) প্রকল্প। সেখানে চীনের শতভাগ বিনিয়োগের আশ্বাস রয়েছে। এতে সরকারের ৩০ শতাংশ এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে। গতবছর ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শি জিনপিং যৌথভাবে কয়েকটি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন। এর অন্যতম হচ্ছে আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন। চীনা সিংহভাগ ঋণ সহায়তায় অপর মেগাপ্রকল্প কর্ণফুলী টানেল থেকে শিল্পজোনের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ২৮ কিমি। মোট ৭৭৪ একর জমিতে এ প্রকল্প গড়ে উঠছে। এতে ভ‚মি উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে পুঁজি বিনিয়োগ হবে আরও ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এই মেগাপ্রকল্পের উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ চালিয়ে আসছে। চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালে মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন এবং শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উৎপাদন শুরু করার কথা।
আনোয়ারা উপজেলার ঝিওরী, হাজীগাঁও, বটতলী, বৈরাগ ও বেলচুড়া মৌজায় বিস্তীর্ণ ভূমিতে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন গড়ে তোলা হচ্ছে। এরমধ্যে সরকারি খাস জমি রয়েছে ২৯২ দশমিক ৯৭৫ একর। বন্দোবস্তিকৃত জমি ৩২৩ দশমিক ৫৪০ একর এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ১৫৮ একর। ইতোমধ্যে ২৯১ একর খাসজমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আরো ৪৮৪ একর জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেখানে ৩৭১টি শিল্প-কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোনে গড়ে তোলার কথা ফার্মাসিউটিক্যাল, কেমিক্যাল, গার্মেন্টস, প্লাষ্টিক, টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন, রাসায়নিক দ্রব্য, অটোমোবাইলস, ডিজিটাল যন্ত্রপাতি, ইলেট্রনিক্স, চিকিৎসা-অপারেশনের যন্ত্রপাতি ও আইটিসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা। প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের আওতায় ইতোমধ্যে কালাবিবি দীঘির মোড় ও ফকিরখীল এলাকায় দুইটি প্রশস্ত সড়কে ব্রিকসলিনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সড়ক পাকা করার কাজ শুরু হয়নি।
জানা গেছে, বর্তমানে মেগাপ্রকল্পের মাস্টার প্ল্যানের মূল কাজের প্রক্রিয়া অনেকটাই আটকে আছে। মাস্টার প্ল্যান সম্পন্ন হলে ভ‚মি উন্নয়ন শেষ করে শিল্পপ্লট স্থাপনের কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। সমগ্র অবকাঠামো উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজের জন্য গত ১৫ জুন চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি. এবং বেজা’র মধ্যকার শেয়ার হোল্ডার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী এবং চায়না হারবারের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেন চোয়ান সোং নিজ নিজ সংস্থার পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে চীন সফরকালে সেদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন স্থাপনের জন্য বিগত ১৬ জুন ২০১৬ইং বেজা ও চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যা চূড়ান্তভাবে শেয়ার হোল্ডার চুক্তিতে উপনীত হয়। এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পুরোপুরি নির্ভর করছে চীনের শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের উপর। সেখানে চীনে কুনমিং প্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিল্পোদ্যোক্তারা শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং রি-লোকেট অর্থাৎ চীনের শিল্প-বাণিজ্য এই শিল্পজোনে স্থানান্তর ও সম্প্রসারণের টার্গেট রাখা হয়।
এদিকে উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বেজার উদ্যোগে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার কাজ চলছে। সেখানে ৪ হাজার ৮শ’ একর জমির উপর গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা বিশেষত রফতানিমুখী খাতগুলো। আগামী ১৫ বছরে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ইছাখালীর চর থেকে ফেনীর সোনাগাজী পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থনৈতিক জোনের অভ্যন্তরে বা পাশে একটি বড় ধরনের বিদ্যুৎপ্রকল্প স্থাপনের জন্য গভীর আগ্রহ ব্যক্ত করেন চীনের বেসরকারি উদ্যোক্তারা। এ প্রকল্পে ২ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগের লক্ষ্য রেখে গতবছর পর্যন্ত কয়েক দফা সফর করে চীনা ও দেশীয় বিশেষজ্ঞ দল। বিদ্যুৎ প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করে বিনিয়োগে আগ্রহী চীনা প্রতিষ্ঠান জিনদুন কর্পোরেশনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। সেখানে কয়েক ধাপে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প স্থাপনের ব্যাপারে চীন আগ্রহ ব্যক্ত করে। চীনা বিশেষজ্ঞরা জানান, মিরসরাইয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্পটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও উন্নত প্রযুক্তিতে স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক জোনে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে চট্টগ্রামেও চাহিদা পূরণ। এর মাধ্যমে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দিকও উঠে আসে। চীন ছাড়াও সেখানে জাপান ও থাইল্যান্ডের বিনিয়োগকারী মিশন পরিদর্শন করেছে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ যাবত অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন এবং মিরসরাইতে বেজার উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক জোনের অভ্যন্তরে চীনের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎপ্রকল্প (জিনদুন কর্পোরেশন) উভয়ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন নির্ভর করছে দেশটির বিনিয়োগকারী বা শিল্পোদ্যোক্তাদের মর্জির উপর।



 

Show all comments
  • Nazib ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১:০৬ এএম says : 0
    চীনকে আমরা সোনাদিয়ায় বন্দর নির্মাণ করতে না দেয়ায় তারা এখন আর এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। এখানে তৈরি জিনিস তো আর তারা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রফতানি করতে পারবেনা করব ওটার এখনই ক্যাপাসিটি নেই, তাই ওরা চেয়েছিল সোনাদিয়া দিয়ে রফতানি করতে নিজেদের দেশে এবং বাইরে। শুধু তাই নয় তারা রাস্তা তৈরী এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও একটা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরী করতে চেয়েছিল শেনজেন এর মত করে কিন্তু হল না। তারা এখন বিনিয়োগ করছে বার্মায়। ওখানে গ্যাস আছে। উল্টো মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত এখন রোহিঙ্গা নিয়ে তারা বার্মার পক্ষ নিয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • বাদশা ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৪৯ পিএম says : 0
    চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি করা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • তামান্না ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৫৬ পিএম says : 0
    প্রয়োজনে দেশীয় বিনিয়োগে প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • মাসুদ ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১:৫৯ পিএম says : 0
    দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ