হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বার্ধক্যের মধ্যে এক অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করে তাঁর ‘পালামৌ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।’ বার্ধক্যের প্রতি সঞ্জীববাবুর শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসার অভিব্যক্তি এ সুন্দর বাক্যটি, বার্ধক্যকে আরও বিশেষভাবে সুন্দর করেছে। বৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তিবশতই সঞ্জীববাবু এ কালজয়ী উক্তিটি করেছেন। সঞ্জীববাবু যে যুগের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন, সে যুগের বৃদ্ধরা পরিবার, সমাজ, জীবনের সর্বস্তরে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে মানুষের হƒদয়ে বিরাজ করতেন। বৃদ্ধরা নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তার ভার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সুরক্ষিত জেনে, সন্তানদের সুখ-স^াচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতেন সাধ্যাতীত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে। এটি ছিল সনাতন আদর্শের অমোঘ নিয়ম, অলিখিত নির্দেশ। সেসব দিন আজ অপসৃত।
আজকের বার্ধক্যের কুৎসিত-বিভৎস রূপটি বিশ্ববাসীকে রীতিমতো শঙ্কিত করে তুলেছে। জরাগ্রস্ত বৃদ্ধরা আজ মানব সভ্যতাকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। সঞ্জীব বাবু যদি আজকের বৃদ্ধদের এ দুরবস্থা দেখে যাবার সুযোগ পেতেন, তাহলে তাঁর এ উক্তিটি হয়তো অন্য রকম হতো। মূল্যবোধের শানবাঁধানো রাস্তায় বার্ধক্যকে এসব সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি কোনদিন। আমাদের সনাতন আদর্শের আমাদের বার্ধক্যকে নিশ্চিন্তেই রেখেছিল এতদিন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের। আজ যেন সেসব সমস্যার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমাদের সমাজ জীবনেও পড়তে শুরু করেছে।
বার্ধক্য মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রকৃতিই মানুষের জীবনের এ অমোঘ পরিণতি নির্ধারণ করে রেখেছে। জীববিজ্ঞান বলে, পঁচিশ বছর বয়সেই পরিপূর্ণ বিকাশের পর আমাদের সকলের দেহ বার্ধক্যের পথে যাত্রা শুরু করে। দেহ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। জীবকোষের সংখ্যা কমতে আরম্ভ করে। বয়সের সঙ্গে পেশির ক্ষয় সাধিত হয়। নার্ভ সেলের সংখ্যাও কমতে থাকে। আমাদের ব্রেনের আকার ও ওজন দুটিই হ্রাস পায়। পঁচাত্তর বছর বয়সে অরিজিনাল ব্রেনের ওজন শতকরা ৫৬ ভাগ মাত্র অবশিষ্ট থাকে। দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি চল্লিশ বছর থেকেই কমতে আরম্ভ করে।
সে সময়টায় মানুষের জীবনে মানসিক ও শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই আসে নানা পরিবর্তন। নৃতত্ত¡বিদরা বলেন, মানুষ বৃদ্ধ হয় দু’ভাবে: প্রাইমারি এজিং (বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে বার্ধক্য আসে) ও সেকেন্ডারি এজিং (অসুখ-বিসুখের ফলে যে বার্ধক্য ত্বরান্বিত হয়)। বার্ধক্যকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা, মানসিক বার্ধক্য, সামাজিক বার্ধক্য এবং বায়োলজিক্যাল বার্ধক্য। কোন বার্ধক্যই একা আসে না, কোনও না কোনও বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। কাজেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, বার্ধক্য কীভাবে সব দিক থেকে মানুষকে এক দুঃসহ অবস্থার আবর্তে ঠেলে দেয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রকে অসহায় করে তোলে। এসব সমস্যায় সমাবৃত হয়ে জীবন হয়ে ওঠে বিড়ম্বিত। দেহকে জরা গ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতা গ্রাস করে মানসিক স্থিতাবস্থা।
সংসারের ওপর নিজের সুকঠিন নিয়ন্ত্রণ হতে থাকে শিথিল। আর্থিক স্বচ্ছলতায় আসে সীমাবদ্ধতা, ফলে পারিবারিক ব্যয় সংকোচন হয়ে ওঠে অনিবার্য। সাংসারিক দায়দায়িত্ব সমাপনান্তে সঞ্চিত অর্থভাÐার ক্রমে হয় নিঃশেষিত। অর্থের অপ্রতুলতা ধীরে-ধীরে নিঃস্ব করে জীবনের অনিন্দ্য স্বাদ। সন্তানরা পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যে দায়বদ্ধ হলে মানসিক পীড়া কিছুটা লাঘব হয় বটে, অন্যথায় নিজেকে ভবিষ্যতের পায়ে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর থাকে না। সে এক ভয়াবহ সময়, এক অসহনীয় অবস্থা। সে সময় মানুষ পুনরায় দ্বিতীয় শৈশবে ফিরে আসে। শিশু যেমন এ বিরাট ব্রহ্মান্ডে মায়ের সান্নিধ্য ছাড়া অসহায়বোধ করে, বৃদ্ধরাও সে সময়টাতে প্রিয়জন সান্নিধ্য ছাড়া অসহায় বোধ করতে থাকেন। বার্ধক্যে প্রয়োজন হয় একান্ত আপনজনের নৈকট্য ও তাদের সহযোগিতা। বার্ধক্যের সনাতন ঐতিহ্য অনুসারেই এসব মূল্যবোধের সাহচর্য পেয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। এ সাহচর্য, সান্নিধ্য তাকে চেয়ে পেতে হয়নি কোনদিন। পেয়েছে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অনুসারেই। এ অমূল্য মানসিকতাগুলো এতদিন পাশ্চাত্যের কাছে ঈর্ষার বস্তু হয়েই ছিল। আজ ওরা আমাদের সগোত্রে দীক্ষিত করতে পেরে আনন্দই উপভোগ করে।
আমাদের সমাজ জীবনে এ অবক্ষয় শুরু হয় একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যাবার সময় থেকে। লোভ-লালসার যে বীজ দীর্ঘদিন আমাদের মানসিকতার অন্দরমহলে সুপ্ত ছিল, সে বীজ লোভের লালসায় সিক্ত হয়ে একান্নবর্তী পরিবারের প্রাচীরে অজান্তেই জন্ম দিয়েছিল এক বিষবৃক্ষের। সে বিষবৃক্ষ ধীরে ধীরে প্রাচীরের গায়ে শিকড় বিস্তার করে তাতে ফাটল ধরায় ও কালক্রমে সে ফাটল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।
একদিন সে বিষবৃক্ষের শিকড় মূল্যবোধের শক্তপোক্ত প্রাচীরটাকেই চৌচির করে ফেলে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে সংসারের এক পকেট সংস্করণের মানসিকতা আমাদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে। সেদিন থেকেই পরিবারে-পরিবারে বৃদ্ধরা অপাঙক্তেয় হতে থাকেন। মাতা-পিতা পরিবারে আবর্জনার মতো বর্জনীয়, সে মানসিকতার জন্মও সেদিন থেকেই।
এ প্রক্রিয়াটা আরও দ্রæততর হয় পাশ্চাত্যের হƒদয়হীন সংস্কৃতি সংযোজিত হওয়ার পর। বিশ্বায়নের বিষাক্ত নিঃশ্বাস আমাদের প্রাচ্যের বার্ধক্যকে আরও জটিল আবর্তের মধ্যে ঠেলে দেয়। হƒদয়হীনতাই যে সংস্কৃতির মূল তথ্য, সে তথ্যের বাজারজাতকরণে খুব একটা সময় ব্যয় করতে হয়নি আমাদের। পাশ্চাত্যের এ উচ্ছিষ্ট মানসিকতা তিলে তিলে গ্রাস করতে থাকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় (শংকর) তাঁর ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ নামক গ্রন্থে পাশ্চাত্যের বার্ধক্য স¤পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ নানা মর্মান্তিক বর্ণনা তুলে ধরেছেন। সে দেশের সন্তানরা তাঁদের পিতা-মাতার প্রতি কতটুকু নিষ্ঠুর তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে গ্রন্থটির অনেকগুলো পাতা জুড়ে। তারা সমাজে আবর্জনা বিশেষ। তাঁদের দাবি অফুরন্ত। কিন্তু সমাজকে দেবার ক্ষমতা নেই কানাকড়ি। পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষের বিচার করে উৎপাদনের নিরিখে। হƒদয়ের সেখানে কোনও স্থান নেই। তাদের দৃষ্টিতে বৃদ্ধ আর বেতো ঘোড়ার মধ্যে কোনও ফারাক নেই। বেতো ঘোড়ার কাজের ক্ষমতা নেই কিন্তু আহার জোগাতে হয় আমৃত্যু। বৃদ্ধদের বেলাতেও তাই খাটে, সে বাবা-মা যে-ই হোক না কেন। এতটাই তাদের নিষ্ঠুর মানসিকতা। ওরা বলে, যাদের কাজ করার ক্ষমতা কমে গিয়েছে, কথা বলার ইচ্ছা বেড়ে গেছে, তাদের উপর নির্ভর করলে দেশের অগ্রগতি রুদ্ধ হতে বাধ্য। যৌবনের উদ্ভাবনী শক্তি ও পেশীশক্তিতেই সমাজ এগিয়ে চলে। পাশ্চাত্যের উদ্ধত যৌবন বার্ধক্যের প্রতি এতটাই নির্মম যে তারা বলে, দরিদ্র দেশগুলোতেই শুধু বৃদ্ধদের সম্মান বেশি। সেসব দেশে শিল্পের প্রগতি তেমন দ্রæত নয় বলে বৃদ্ধরা রাতারাতি কাজকর্মের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েন না, অথচ পশ্চিমে বিজ্ঞানের এমন দ্রæত উন্নতি হচ্ছে যে তার সঙ্গে তাল রেখে চলা বুড়োদের পক্ষে বেশ কষ্টকর। প্রতিযোগিতার দৌড়ে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী, বৃদ্ধ ইঞ্জিনিয়ার, বৃদ্ধ কারিগর সবাইকে পথ ছেড়ে দিতে হয় নতুনদের। তার ফলেই একজন মানুষ জীবদ্দশায় গাড়ি থেকে মহাকাশচারী রকেটের বিবর্তন দেখে যেতে সক্ষম হচ্ছে। তাছাড়া শিল্প-সভ্যতায় এগিয়ে যাবার প্রতিযোগিতা এত কঠিন যে অন্যের দিকে তাকানোর সময় থাকে না। নিজের স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়ে সামলানোই যথেষ্ট কাজ। তার উপর বাবা-মা ঘাড়ে চাপলে জীবনে আনন্দ বলে কিছু থাকে না। সুতরাং যে যার ঘর সামলাও। তবেই প্রগতির রথ এগিয়ে চলবে।
মতবাদ হিসেবে যুক্তিগুলো মন্দ নয়। প্রগতির এটাই হয়তো শর্টকার্ট রাস্তা। কিন্তু যে প্রগতিতে বৃদ্ধ পিতা-মাতার কোনও স্থান নেই, স্থান নেই স্বজন-সুহƒদদের, স্থান নেই মায়া-মমতার মতো মানবিক বৃত্তিগুলোর, সে প্রগতি কাদের জন্য? প্রগতির জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য প্রগতি? প্রশ্নটা আজ না হোক কাল মানুষকে ভাবতেই হবে। সে প্রগতি পাশ্চাত্যের হƒদয়হীন প্রগতিবাদীদের কাম্য হলেও, আমাদেরও কি কাম্য? প্রশ্নটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও লক্ষ টাকার প্রশ্ন। প্রগতির প্রতি আমাদের কোনও ছুঁতমার্গ নেই। আমরাও তো আমাদের সন্তানদের জগতের এ আনন্দযজ্ঞে অংশীদার করাতে চাই। আমরাও চাই আমাদের সন্তানরা একদিন আলোর ঠিকানায় পৌঁছে উপভোগ করুক জীবনের অনিন্দ্য স্বাদ, যে স্বাদ সুখের, সমৃদ্ধির, কল্যাণের। কিন্তু সে প্রগতিকে আমরা কি মেনে নিতে পারি যে প্রগতির রথের চাকা যাত্রাপথে আমাদের আশা-আকাক্সক্ষাকে নির্মমভাবে পিষে দিয়ে যাবে? খুন করবে আমাদের বার্ধক্যকে অসহায়তার সুযোগ নিয়ে? আমরা এগিয়ে যাওয়ার পরিপন্থী নই, কিন্তু তাই বলে মানবিক গুণগুলোকে মাড়িয়ে যাবার মতো উদারপন্থীও নিশ্চয় আমরা নই।
এ তথ্যটাই এতদিন প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের একটা মৌলিক পার্থক্য সৃষ্টি করে রেখেছিল। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। বৃদ্ধদের মতবাদও আজ জরাগ্রস্ত, কাজেই সেসব মতবাদকে উপেক্ষা করে পাশ্চাত্যের প্রগতির সূত্র অনুসরণ করেই আলেয়ার পিছনে ছুটে চলেছে, সে আলোর নিচে রয়েছে ঘনঘোর অন্ধকার; সে অন্ধকারে কত বীভৎস জীবননাট্য অভিনীত হচ্ছে তার প্রকৃত সংবাদ আমরা অনেকেই রাখি না। যা কিছু চক্চক্ করে তাই সবসময় সোনা হয় না। সেসব দেশে প্রগতির ঘোড়া দুর্দমনীয় বেগে ছুটে চলেছে। অন্যদিকে সৃষ্টি করে চলেছে ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। দিনের পর দিন সে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সমস্যার সূতিকাগারে এক সমস্যা অন্য সমস্যার জন্ম দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
পশ্চিমের দেশগুলোতে যাদের বয়স ৬৫ বছরের উপর তাদেরই বৃদ্ধ বলে চিহ্নিত করা হয়। সিনিয়র সিটিজেন, এ ছেলে ভোলানো সম্মাননা আজকাল আমাদের দেশেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। সেসব দেশে হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন বৃদ্ধ অর্থাৎ তাদের বয়স ৬৫ বছরের উপর, কাজেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে দেশের একটা বিরাট অংশ আজ বার্ধক্যের কবলে। সে হারে প্রতি বছর আরও নতুন সদস্য সংযোজিত হচ্ছে। সে বিপুল সংখ্যক বৃদ্ধকে নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলো আজ হিমশিম খাচ্ছে। নৃতত্ত¡বিদরা বার্ধক্যের এ ভয়াবহ সমস্যার সামাজিক সমাধান খোঁজে জীবনপাত করে চলেছেন, ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি ডলার। সমাধান সূত্র আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পশ্চিমের শিল্প বিপ্লব যে শুধু বার্ধক্যের অশেষ ক্ষতি সাধন করেছে তাই নয়, সামাজিক পরিকাঠামোটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। আর এ বিবেকহীন বিপ্লবের পথে চলে সমস্যার মূলে ওরা কোনদিনই পৌঁছতে পারবে না। কেবল সৃষ্টি হবে নতুন নতুন হোম বা বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধদের গিনিপিগ করে প্রতিনিয়ত চলবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা। উঠে আসবে নতুন নতুন তথ্য। সবকিছুর যোগফল দাঁড়াবে শূন্য। পশ্চিমীদের এ হোম বা নির্বাসন কেন্দ্রগুলোর সত্যিকারের চেহারাটা কী তা একবার দেখা যাক। প্রতিটা হোমে জরাগ্রস্ত, রোগাক্রান্ত, অথর্ব মানুষগুলো মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছেন। সমাজে ওরা চ‚ড়ান্তভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত। সে দেশের যৌবন এসব বৃদ্ধ মানুষদের সম্মান দিতে রাজি নয়। পরিবর্তে চলে মানসিক নির্যাতন। বার্ধক্যের প্রতি ওরা শুধু নিষ্ঠুরই নয়, হিংস্রও বটে। সর্বক্ষণ ওরা বৃদ্ধদের মৃত্যু কামনাই করে। বৃদ্ধ শব্দটা সেসব দেশে গালাগালের নতুন সংযোজিত একটি প্রতিশব্দ মাত্র।
সন্তানদের ক্রমাগত অবহেলা, প্রতিটি বৃদ্ধের জীবনকে করে তোলে বিতৃষ্ণ, বিবর্ণ। অপমান, অবহেলা সহ্য করতে হয় দিনের পর দিন মাসের পর মাস। এসব নিয়েও বেঁচে থাকতে হয়, মৃত্যু আসে না বলে। এর চেয়ে দুঃখদায়ক বাঁচা কিছু হতে পারে কি? অথচ এসব বৃদ্ধদের একদিন সমাজে ছিল প্রতাপ, কেউ ছিলেন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী, কেউ বা দার্শনিক, জজ, অর্থনীতির পন্ডিত, কেউ বা মিলিটারির বড় অফিসার আবার কেউ সেনেটর। আজ জরাগ্রস্ত তাদেরকে দেহমন নিয়ে বাধ্য হয়ে তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়েছে। পুত্র-কন্যারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, কেউ বাবা-মার খোঁজ নেবার প্রয়োজন অনুভব করে না। কোনও দায়বদ্ধতা নেই, মায়া-মমতার প্রশ্ন তো আসেই না।
কিছু সংখ্যক বৃদ্ধ সরকারের আনুক‚ল্যে জীবন কাটালেও সকলেই আর্থিক দিক থেকে তেমন স্বচ্ছল নন। অর্থ সব সময় জীবনের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। প্রয়োজন হয় আপনজনদের। আপনজনের সান্নিধ্য ছাড়া জীবনের বিশেষ করে শেষ জীবনের সব প্রয়োজন মেটানো কিছুতেই সম্ভব নয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সকলেই প্রায় অক্ষম। কেউ বা বাতব্যাধিতে অচল, কারও দৃষ্টি ক্ষীণ, কেউ বা বধির, শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন বহুদিন, কেউবা আলজাইমার্সে আক্রান্ত, আবার কেউ বা বার্ধক্যজনিত অন্য কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে চলৎশক্তি রহিত। নিজেদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। ঔষধ-পথ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাদের সব থেকেও আজ কিছু নেই। তদুপরি একাকিত্ব মানুষকে আরও অসহায় করে তোলে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয় তাদেরকে।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন। কেউ আসে না, হতাশায় বুকের পাজরে গভীর ক্ষতের জন্ম হয়, প্রায়শই সে ক্ষতে রক্ত ক্ষরণ হয়। দীর্ঘদিনের হতাশায় জন্ম নেয় মানসিক অবসাদ। অনেক সময় মানসিক বিকৃতির লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেসব দেশে প্রকাশ্যে চোখের পানি ফেলা অসভ্যতা। তাই সভ্যতার ভান করে নিজেদের নিঃশেষ করতে হয় নিঃশব্দে। ফাইন, গ্রেট, গেÐারিয়াস, বিউটিফুল বা থ্যাংকস সভ্যতার মোড়ক লাগানো এসব শব্দের সাহায্যে নিজেকে আড়াল করতে হয় প্রতিনিয়ত। দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতন সহ্য করে একদিন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কেউ কেউ ডা. ডেথ এর শরণাপন্ন হন। মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ২৬ ফেব্রæয়ারি, ২০০৪ ‘ডক্টর ডেথ’ এর শিরোনামে লন্ডনের একটা দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ডক্টর হ্যারল্ড শিপম্যান নামের এক নরঘাতক লন্ডনে বহু বৃদ্ধকে এ মৃত্যু উপহার দিয়েছিলেন। অর্থাৎ উভয়ের সম্মতিক্রমে রোগীকে বিষ মিশানো ইনজেকশন প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ড. শিপম্যান ঠিক কত জনকে এভাবে ‘মৃত্যু’ উপহার দিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব না পাওয়া গেলেও গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুসারে দীর্ঘ ৩০ বছরের চিকিৎসক জীবনে সক্রিয় সহযোগিতায় মৃত্যু ঘটানোর সংখ্যা দেড় হাজারের কম নয়। যাদের সংসার হতে ভোগবাসনা চলে গেছে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, পরিবারে অনাদর-অবহেলার শিকার হয়ে জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ, তাদের মৃত্যু ত্বরান্বিত করাই ছিল ড. শিপম্যানের কাজ। ‘ডক্টর ডেথ’ অভিধায় ভ‚ষিত আর একজন মৃত্যুর রূপকার ডা. জ্যাক কেভরকিয়ান। তাঁর হাতে ‘মৃত্যু’ প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শেষ পর্যন্ত ডা. শিপম্যান কারাকক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। আর সিরিয়াল কিলার জ্যাক কেভরকিয়ান, ২৫ বছরের কারাদÐে দÐিত হয়েছিলেন। এ মৃত্যু বা ‘ইউথ্যানাসিয়া’ নিয়ে একটা বিতর্ক কিন্তু রয়েই গেছে। কাজেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, কী অসহনীয় অবস্থায় পড়লে মানুষ এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পাশ্চাত্যের হƒদয়হীন শিল্প বিপ্লব সেসব দেশের বৃদ্ধদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আজ যারা প্রগতির অগ্রদূত, শৌর্য-বীর্যে সম্মানে প্রতিপত্তিতে সমাজের চ‚ড়ামণি, কাল কিন্তু তারাও পুরনো হয়ে আবর্জনার মতো নিক্ষিপ্ত হবেন যথাস্থনে। যাঁরা প্রগতির প্রবাদ পুরুষদের জন্ম দিয়েছেন মাত্র কদিন আগে স্নেহ, মায়া, মমতায়, হƒদয় নিংড়ানো ভালবাসায় বড় করেছেন তিলে তিলে, রোগ শয্যায় শিয়রে বসে হাত বুলিয়েছেন সর্বাঙ্গে, কল্যাণ কামনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে করুণা ভিক্ষা করেছেন কায়মনোবাক্যে, নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে তৈরি করেছেন প্রগতির অগ্রদূতদের, তাঁরাই আজ সমাজে অপাঙতেয়, উপেক্ষিত হয়ে আবর্জনার মতো অন্তিম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছেন। কী মর্মান্তিক! এরই নাম প্রগতি? আমরা যদি এখনও পাশ্চাত্যমুখী সর্বনাশা চিন্তাধারার মোহমুক্ত হতে না পারি, সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ডা. ডেথই হয়তো হয়ে উঠবে আমাদের পারেনি।
লেখক: সহ-সভাপতি, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, সিলেট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।