২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
দশ বছরের শিশু রুহিন। এই বয়সেও নিজের হাতে খেতে পারে না। চিবিয়ে খাওয়াও তার পক্ষে কঠিন। রুহিনের মা রুমা জানান, তার তিন ছেলে। রুহিন সবার বড়ো। অন্য দুটি ছেলে স্বাভাবিক হলেও রুহিন অন্য দশটি শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। বয়স বাড়লেও তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটেনি। সে এখন মোটামুটি হাটতে পারে, চলতে পারে, কিন্তু কথা বলতে পারে না। চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন- রুহিনের বিকাশজনিত সমস্যা আছে। এটা এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
আমাদের আশপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, অনেক পরিবারেই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। এ ধরনের শিশুদের নিয়ে পরিবারের চিন্তার শেষ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গড়ে পৃথিবীর যে-কোনো দেশের শতকরা ৩ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার অর্থ হলো, বয়স অনুপাতে শিশুর যে বুদ্ধি থাকার কথা তা মাত্রায় তুলনামূলকভাবে কম হওয়া। বুদ্ধি বা আইকিউ’র পরিমাণ কতটুকু কম তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবন্ধীত্বকে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
জন্মের পর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটা, বসতে শেখা, দাঁত ওঠা, কথা বলা ইত্যাদি কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। বয়স বাড়লেও তারা নিজে পোশাক পড়তে পারে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না, আকস্মিক বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। তারা রাস্তাঘাটে ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না, একা ছাড়লে বাড়িতে ফিরে আসতে পারে না।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের মস্তিষ্কের গড়ন, কাজ ইত্যাদি ধীর গতিতে হয়। অন্য সাধারণ দশটি শিশু থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের কথাবর্তা, চলাফেরা, শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও ব্যবহার সহজেই পৃথক করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজের সাধারণ দশটি শিশু থেকে আচরণগত ও বিকাশগত তফাৎ থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নির্ণয় করা যায়।
শৈশবে শিশুর কোনো ধরনের সংক্রমণ শিশুর ওপর ভয়াবহ প্রভাব সৃষ্টি করে তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলতে পারে। এ সংক্রমণ নানা ধরনের হতে পারে। মানবমস্তিষ্কে এবং স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাÐকে ঘিরে এক ধরনের আবরণী পর্দা রয়েছে, একে বলা হয় মেনিনজেস। ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল এবং প্রোটোজোয়াজনিত সংক্রমণের কারণে মানবমস্তিষ্কের সেই পর্দা আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মানবমস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মস্তিষ্ক বা নার্ভাস সিস্টেম গঠন এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেড়ে ওঠার জন্য যে পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন তা থেকে এ বিশাল জনগোষ্ঠী বঞ্চিত। তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আমিষ, শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবারের স্বল্পতার জন্য অল্প বয়সে অনেক শিশুই মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়ে থাকে। বংশগত বা জেনেটিক কারণেও ব্যক্তির মাঝে মানসিক প্রতিবন্ধিতা দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে-উইলসন্স ডিজিজ, ক্রমোজোমাল ডিজঅর্ডার, নিউরাল টিউবের সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কীয় সমস্যা ইত্যাদি।
মায়ের গর্ভ থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়ার সময় মস্তিষ্কে কোনো ধরনের আঘাত পেলে বাচ্চা মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। আবার অনেক বাচ্চা রয়েছে, যারা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই পৃথিবীর আলো দেখে। এ ধরনের বাচ্চার ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেসব শিশু এ সমস্যায় ভোগে তাদের স্নায়ুতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না। ফলে এরা পরে মানসিক প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয়। সমাজ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেও কোনো কোনো মানুষের মানসিক প্রতিবন্ধিতার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণে শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি হতে পারে।
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ব্যক্তির জন্ম ও পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধিতার মূল্যায়ন করা যায়, যেমন-শিশুর কর্মদক্ষতার বিশ্লেষণ, আইকিউ ও পেশি শক্তির বিকাশ, শিশুর ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা, কানে কম শোনা, দৃষ্টিশক্তিহীনতা, সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত ও অন্যান্য শারীরিক ও সাইকিয়াট্রিক অসামঞ্জস্যতা। শিশুর মেডিকেল ইতিহাস বা জন্ম নেয়ার আগে গর্ভাস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থা ও জন্মের পর থেকে শিশুর বিকাশজনিত বিভিন্ন সমস্যার বিস্তারিত ইতিহাস জানতে হবে। প্রসবকালীন বা গর্ভাবস্থায় কোনো জটিল সমস্যা, মায়ের কোনো বিশেষ রোগ, প্রসবের সময় বাচ্চার মস্তিষ্কে আঘাত, শিশুর সংক্রামক ব্যাধি, রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়র সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবায় অত্যন্ত আন্তরিক। প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের মূল ধারায় ধরে রাখতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের অন্য দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়, তাই তাদের জন্য নিয়োজিত শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এসব বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়াও প্রতিটি জেলায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে নাচ, গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ। ক্রীড়া ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমÐলে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ ক্রীড়া উৎসবে অংশগ্রহন করে বাংলাদেশের অনেক প্রতিবন্ধী শিশু দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে খুবই আন্তরিক ও তৎপর।
সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি আমাদের আন্তরিক হতে হবে। প্রতিবন্ধীদের যাতে কেউ সমাজের বোঝা হিসেবে ভাবতে না পারে সেজন্য তাদেরকে কোনো একটি বিশেষ কাজে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং কর্মমুখী পেশার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুর মাঝেও অনেক সুপ্ত প্রতিভা থাকতে পারে। তাই খেলাধুলা ও বিনোদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে ছবি আঁকা, গান, ক্রীড়া বা অন্য কেনো বিষয়ে দক্ষতা থাকলে তা যথাযথভাবে প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের ঠিকমত পরিচর্যা করতে পারলে এরা সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারে। আসুন সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেই। তাহলে প্রতিবন্ধী শিশুদের চলার পথ যেমন মসৃণ হবে তেমনি অভিভাবকদের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হবে।
আলম শামস
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।