Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চরম আবহাওয়ায় বাড়ছে দুর্যোগ

বৃষ্টিপাত বন্যা ঢল ঘূর্ণিঝড় বজ্রপাত পাহাড়ধস বৃদ্ধি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চরম-ভাবাপন্ন, এলোমেলো ও বৈরী উঠেছে আবহাওয়া-জলবায়ু। এরফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে ক্রমেই বিপর্যস্ত। বেড়ে গেছে বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাতেও ব্যাপক অসঙ্গতি হচ্ছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে বন্যা পাহাড়ি ঢল ও ধস, ঘূর্ণিঝড় টর্নেডো বজ্রপাত। অথচ মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের উত্তর জনপদ। পাহাড়ি অঞ্চলে অতিবৃষ্টি-ধস বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনও দুর্বল।
যদিও এরজন্য আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোঃ রিয়াজ আখতার মল্লিক নিবিড় গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বৃষ্টিপাতের পারিমাণ বেড়ে গেছে। যা বার্ষিক গড়ে অন্তত ২৫০ মিলিমিটার। তিনি ইনকিলাবকে জানান, সীমিত জায়গা বা এলাকায় হঠাৎ কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে অতি বর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বেড়ে চলেছে জনদুর্ভোগও। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহর-নগরে পানিবদ্ধতা ও দুর্ভোগের এটি প্রধান কারণ ও দিক। এদিকে গত পর পর চার মাসে দেশে স্বাভাবিক হার ও পরিমাণের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে বেশি। গত আগস্ট মাসে ৩২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি ঝরেছে। এবার পুরো ভাদ্র মাসটা তথা শরৎ ঋতুর অর্ধেকটাই গতকাল (শুক্রবার) শেষ হয়েছে বর্ষাকালের মতো অতিবৃষ্টির মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল এমনকি চীনেও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে বেড়েছে দুর্যোগ-দুর্ভোগের মাত্রাও।
বাস্তবেই বাংলাদেশের আবহাওয়া-জলবায়ুর আবহমানকালের চিরচেনা রূপ ও বৈশিষ্ট্যের বদল ঘটছে। এলোমেলো হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। ক্রমাগত অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবহাওয়া। বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। নিত্যনতুন দুর্যোগ, দুর্ভোগ ও সংকট তৈরি হচ্ছে। ফল-ফসলের উৎপাদন ব্যাহত এবং উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্বাভাবিক মতিগতি এবং চরম ভাবাপন্ন রূপে দেখা দিচ্ছে আবহাওয়া। চিরায়ত ষড়ঋতুর আদি চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্জিকার ছকে ‘বর্ষা’য় বৃষ্টি ঝরে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অকালে’ অঝোর বর্ষণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। বছর বছর অনাবৃষ্টি ও খরার প্রকোপ বেড়ে গিয়ে মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে বরেন্দ্রভূমি সমেত দেশের সুবিশাল উত্তর জনপদ। অন্যদিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘন ঘন প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ও অতিবর্ষণে ভাসছে। ছোট ছোট জলোচ্ছ¡াসের প্রকোপ বাড়ছে। গ্রীস্মের খরতাপ যেন মরুর আগুনের হলকা। অসহনীয় ‘গরমকাল’ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, কিন্তু শীতের দাপট চলে অল্প কিছুদিন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত আলাদা করে জনজীবনে তেমন আর অনুভূতি জাগায় না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া-জলবায়ু হয়ে উঠছে রুগ্ন খেয়ালী বৈরী এমনকি রুদ্র রুক্ষ প্রলয়ংকরী। অনেক সময়েই পূর্বাভাসের সাথে মিলছে না। মানুষের বান্ধব নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন জটিল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আবহাওয়ার বিরূপতা জীবনযাত্রায় চরম অনিষ্ট ও দুর্ভোগ ডেকে আনছে। এরফলে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে মানবসম্পদের সার্বিক উৎপাদনশীলতা। কমছে সক্ষমতার হার। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি ও করাল গ্রাসে বসতি হারিয়ে প্রতিবছর পিছু হটে মূল ভূখন্ডের দিকে ধেয়ে আসছে উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চলের ভূমি ও বসতি হারা অভাবী মানুষজন। সাগরের উপরতল ফুলে-ফেঁপে উঠছে। উপর্যুপরি সতর্ক সংকেত দেখানো হচ্ছে সমুদ্র বন্দরসমূহকে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামায় চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া জেঁকে বসেছে।
অতিসা¤প্রতিক পর্যবেক্ষণ অনুসারে, আবহাওয়া-জলবায়ুর অন্যতম প্রধান নিয়ামক ও সূচক বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ব্যাপক অসঙ্গতি হচ্ছে। গত কয়েক মাসেই সারাদেশে সামগ্রিকভাবে গড় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তবে এলাকাভেদে কম-বেশি বৃষ্টি বা তারতম্য ঘটেছে। অথচ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কমই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত ৮ মাসের আবহাওয়ায় সারাদেশে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিক হারের চেয়ে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি ছিল। বাতাসের আর্দ্রতায়ও খুব হেরফের হচ্ছে। এতে করে অনুভূত হচ্ছে অসহনীয় ভ্যাপসা গরম। বছরের বছরের অধিকাংশ সময়ই গুমোট হয়ে থাকছে আবহাওয়া। এ কারণে নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে নৌ দুর্ঘটনাও। মারাত্মক ভাঙন বিস্তৃত হচ্ছে সমুদ্র উপকূল ও নদ-নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায়। বৈরী জলবায়ু পরিবেশের মুখে ক্ষতির শিকার গৃহস্থ অসংখ্য মানুষ হারাচ্ছে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু, চাষবাসের জমি, এদের বলা হচ্ছে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। ‘মোরা’ ‘সিডর’ ‘নার্গিস’ ‘আইলা’, ‘কোমেন’র মতো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, টর্নেডো ও ভূমিধসের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
হিসাব করে দেখা গেছে, চলতি বছরে এ যাবৎ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি (তাছাড়া গভীর সঞ্চারনশীল মেঘ, মৌসুমী বায়ুচাপে তারতম্যে আধিক্য) ইত্যাদি কারণে সতর্কতা সংকেত দেখাতে হয়েছে ৫৮ দিন। ঘন ঘন লঘুচাপ, নিম্নচাপ সৃষ্টির কারণে আশান্ত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও উপকূল। বিরূপ আবহাওয়ায় মাছ শিকারের উপায় নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ার কারণে দেশের ৭১৫ কি.মি. বিস্তৃত উপকূলভাগ চর ও দ্বীপাঞ্চলের অন্তত ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে এমনটি আশংকা বিশেষজ্ঞ মহলের।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর আদি বৈশিষ্ট্যগুলোর ওলট-পালটের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার নাভিমূলে বঙ্গোপসাগরের কিনারাজুড়ে, হিমালয়ের ভাটিতে ভৌগোলিক বিশেষ অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে এর ক্ষতিক্ষর প্রভাব বেড়েই চলেছে। অধিক জনবহুল অথচ দারিদ্রপীড়িত এ দেশের জনবসতি, কৃষি-খামার, জীবিকা, জনস্বাস্থ্য, উন্নয়ন কর্মকাÐসহ জনজীবনের নানামুখী ক্ষেত্রে গিয়ে পড়ছে এর কমবেশি ধকল। আকস্মিক ও অসময়ে বন্যা, পাহাড়ী ঢল, খরা, হঠাৎ অতিবৃষ্টি, পানিতে আর্সেনিক ও লবণাক্ততার আগ্রাসন মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাদুর্ভাব ঘটছে অতিআর্দ্র ও উষ্ণতা, মৌসুমী ভাইরাসজনিত (ট্রপিক্যাল) হরেক রোগ-ব্যাধি যেমন সর্দি কাশি প্রদাহজনিত জ্বর, বাতজ্বর, ফ্লু, পেটের পীড়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও ট্রপিক্যাল রোগ। রোগ-বালাই প্রতিরোধক ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকুল হারিয়ে ফেলছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। বাড়ছে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের সংক্রমণ। কৃষিজ খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে কম, পুষ্টিমানও লোপ পাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরীয় পরিবেশের গবেষক অধ্যাপক মোঃ ইউনুস হাসান আবহাওয়া-জলবায়ু বিরূপ পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১ শতাংশ হারে ভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় প্যারাবনের আকার-আয়তন কমে যাচ্ছে। জনজীবনে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। উপকূলীয় বাসিন্দারা বাস্তুহারা হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের মাঝে দারিদ্রের হার বাড়ছে। নৌপথে পরিবহন হচ্ছে ব্যাহত, বাড়ছে ঝুঁকি। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক মাছের বিচরণ বিঘিœত হচ্ছে। মাছের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। সাগরে মাছসহ প্রাণিজগতের খাদ্য-শৃঙ্খল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চরম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ