চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অঞ্চলিক, গোত্রীয় ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পোশাকের রয়েছে নানা ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য। মানুষের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধ ফুটে ওঠে পোশাকের মাধ্যমে। মানুষ যেমন নিজে উন্নত পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করে, ঠিক তেমনি প্রিয়জনদেরও উত্তম পরিচ্ছেদ পরাতে ভালোবাসে। শুধু প্রিয়জন কেন, প্রিয় বস্তুটিকেও ভালো মানের কাপড়ে আবৃত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে বস্তুটি যত প্রিয় সেটির গায়ে তত উন্নত ও মূল্যবান আবরণ হতে হবে- এটাই হয় মনের চাহিদা ও দীলের তামান্না। বস্তুটি যদি হয় সবার প্রিয় ও সম্মানের কোনো কিছু, তা হলে তো কাথাই নেই। তখন প্রিয় বস্তুটির সাথে সাথে সেটির আচ্ছাদনটির প্রতিও মানুষের মায়া জড়িয়ে যায়।
প্রিয় বাইতুল্লাহ শরীফ, এর ভালোবাসা কার হৃদয় স্পর্শ করে না? ছোট-বড় সবার দীলের বাইতুল্লার প্রতি মুহাব্বত যেন স্বভাবগত। এর প্রতি ভালোবাসার কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। বাইতুল্লাহর ভালোবাসার কারণে এর গিলাফও সকলের কাছে পরম প্রিয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পবিত্র কাবার গিলাফের রঙ কালো। এজন্য আমাদের অনেক আকাবির-আসলাফ কালো রঙের জুতা পরিধান করতেন না। আনেক জিন্দা বুজুর্গকেও এর উপর আমল করতে দেখা যায়। এইতো সেদিন, প্রসিদ্ধ আলেম ঘরানার এক বিয়ের মজলিসে একটি শিশু থেকে বাইতুল্লাহর গিলাফ নিয়ে যে অনুভূতি প্রকাশ পেল, তাতে অন্তত আমার মধ্যে একথা বদ্ধমূল হয়েছে, এর প্রতি ভালোবাসা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। ছেলেটি মধ্যপ্রাচ্য প্রবসী, বাবা-মা’র সাথে থাকে ওখানে। সে সুবাদে বেশ ভালো আরবীও বোঝে, বলতেও পারে বেশ ভালোই। দেখতে ফর্সা নয়। তবে কালো বললে ছোট্ট মনে কষ্ট পায়। আমাদের দেশের একজন মশহুর আলেম সম্পর্কে তার দাদা। তিনি তার মন খারাপ করার বিষয়টি জানাতে পেরে বিয়ের মজলিসে কথার ফাকে ছোট্ট নাতীকে লক্ষ্য করে বললেন, পবিত্র কুরআনের হরফ কালো, বাইতুল্লার গিলাফও কালো বর্ণের, তাহলে তোমার গায়ের রঙ কালো হলে অসুবিধা কি? কথাটি শোনার পর ছোট্ট মুখে ভাবনার ছাপ পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে অজানা এক আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত হল শ্যম বর্ণের মুখটি। হয়তো সে নিজের মধ্যে খুঁজে পেল প্রিয় বাইতুল্লাহর গিলাফের সাদৃশ্য। এরপর থেকে কেউ তাকে কালো বললে মন খারাপ করে না।
ছোট্ট সেই শিশুটির মত আমাদের সবার কাছেও আল্লাহ তাআলার প্রিয় ঘরের গিলাফ সীমাহীন মুহাব্বত ও সম্মানের। প্রিয় এই বস্তুটি কখন থেকে পবিত্র কাবাকে আবৃত করে আসছে এবং কোন সৌভাগ্যবান মানুষটি পবিত্র কাবার গায়ে প্রথম চাদর জড়িয়ে দিয়েছেন, আরো কারা খোশ নাসীব হয়েছেন একাজটি করে- আমরা তার কিছুটা জেনে নিলে মন্দ কি। যে ঘরের মালিকের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবী থেকে যে ঘরের পানে ছুটে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ, হজের সেই পূর্ণময় মাসে সে ঘরের পোশাক-আশাক ও সাজ-সজ্জার বন্দনা করেই না হয় কিছুটা সময় পার করলাম আমরা।
কাবা শরীফের গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেছেন অনেকেই। তবে আংশিক হলেও সর্বপ্রথম কাবা শরীফের গিলাফ পারানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। জাহেলী যুগেও বেশ গুরুত্বসহকারে পবিত্র কাবার গিলাফ পরানো হতো। হিজরত পূর্বে ২২০ সালে সর্বপ্রথম কাবা শরীফের পূর্ণঙ্গ গিলাফ পরানো হয়। তুব্বা আবু কারাব মালিক সর্বপ্রথম কাবা শরীফের গায়ে পূর্ণাঙ্গ গিলাফটি চড়িয়ে দেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ কুসাই বিন কিলাবের যুগে কুরাইশ গোত্রের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একবার পবিত্র কাবা গৃহের গিলাফ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন প্রত্যেকটি উপগোত্র আনুপাতিক হারে এর ব্যয় ভার বহন করতো। কুরাইশ গোত্রের সকল শাখাগোত্র পূর্ণময় এ কাজে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু কুরাইশ ধনপতি আবু রবী‘আ ইবনুল মুগীরা মাকযুমী প্রচলিত এই নিয়মে বাধ সাধলো। সে বলল, “এক বছর শুধুমাত্র আমি একা কাবার গিলাফ পরাবো, পরের বছর গোটা কুরাইশ মিলে কাবার গিলাফ চড়াবে।” সে তার কথা বস্তবে রূপ দেয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত সে এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ইসলাম প্রাক্কালে পবিত্র কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হতো আশুরার দিন। এরপর এ কাজের জন্য ধার্য করা হয় কোরবানির ঈদের দিন।
নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাবা শরীফের গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের জননী নুতাইলা। নিজের কৃত মান্নত পূর্ণ করার জন্য তিনি তা করেন। শিশুপুত্র আব্বাস হারিয়ে গেলে তিনি মানত করেন, ছেলেকে ফিরে পেলে নিজ হাতে পবিত্র কাবাঘরে গিলাফ পরিয়ে দেবেন তিনি। পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি খুঁজে পেলেন নুতাইলা এবং কাবার গায়ে শুভ্র রেশমের গিলাফ পরিয়ে নিজের মানত পুরা করলেন। এভাবেই তিনি নারী হিসেবে সর্বপ্রথম পবিত্র কাবার গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইতুল্লাহর গিলাফ পরিয়ে দেন। গিলাফটি ছিলো ইয়ামানী কাপড়ে তৈরি। বাইতুল মাল থেকে এর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা হয়। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাযি-এর খেলাফতকালে শুভ্র মসৃণ কাপড় বিশেষ দ্বারা পবিত্র কাবার গিলাফ পরানো হতো। মিশরের একটি নগরীতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় উক্ত গিলাফ তৈরি হতো।
হযরত মু’আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাযি.)-এর শাসনামলে বছরে দুই বার কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হতো। প্রথমবার হতো আশুরার দিন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতিমূলক রমজানের শেষ দিন আরেকবার নতুন গিলাফ পরানো হতো। হযরত মু’আবিয়া (রাযি.), হজের মৌসুম ৬ রজব সর্বপ্রথম পবিত্র কাবা ঘরে সুগন্ধি লাগিয়ে দেন। উমাইয়া শাসকবৃন্দ পবিত্র কাবার গিলাফের ব্যাপারে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিতেন। হযরত মু’আবিয়া (রাযি.)-এর শাসনামলে শুরু হওয়া গিলাফ পরিবর্তনের ধারাটি তারা অব্যাহত রাখেন। তখন পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরি হতো দামেষ্কে। মূল্যবান কাপড়ে মনোরম কারুকার্য খচিত গিলাফ বছরে দু’বার পরিয়ে দেয়া হতো কাবা শরীফের গায়ে।
আব্বাসী শাসনামলে কোনো কোনো বছর তিনবার পর্যন্ত কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তন করা হতো। শুভ্র ও রক্তিম বর্ণের মোটা-পাতলা নানা ধরনের রেশমী কাপড়ে তৈরি হতো পবিত্র কাবার গিলাফ। বিশেষ করে খলীফা মামুন বছরে তিন বার গিলাফ পরিবর্তন করতেন। তারবিয়ার দিন প্রথম বার। এ গিলাফটি হতো লাল রেশমী কাপড়ে তৈরি। রজব মাসের শুরুতে দ্বিতীয়বার। এ গিলাফটি হতো মিশরী রেশমে তৈরি। শেষবার পরানো হতো ঈদুল ফিতরের দিন। শুভ্র রেশম কাপড়ে তৈরি গিলাফটি ঈদের দিন থেকে পবিত্র কাবা গৃহে শোভা পেতো। পারস্য, ইয়ামেন, মিশরসহ নানা দেশ থেকে আমদানী করা হতো পবিত্র গিলাফগুলো। বর্তমানে পবিত্র কাবার গিলাফ কালো রেশমী কাপড়ে তৈরী হয়। গিলফের উপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’, ‘আল্লাহু জাল্লা জালালুহু’, ‘সুবহানাল্লাহু ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম’, ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেন্টি মিটার প্রস্থ ৪১টি বস্ত্রখ- জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয় গিলাফটি। চার কোণায় সুরা ইখলাস স্বর্ণসূত্রে বৃত্তাকারে শোভা পায়। রেশমী কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়রের লাইনিং থকে। একটি গিলাফে ব্যবহৃত রেশমী কাপড় ও স্বর্ণের ওজন যথাক্রমে ৬৭০ কিলেগ্রাম এবং ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরিতে ১৭ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল ব্যয় হয়।
বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সউদ মক্কা ও মদীনা শরীফের দুই পবিত্র মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ১৩৪৬ হিজরীতে কাবা শরীফের গিলাফ তৈরির জন্য একটি বিশেষ কারখানা স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। ওই বৎসরই মাঝামাঝি সময়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করে পবিত্র মক্কার দক্ষ শিল্পীদের মাধ্যমে তা সুন্দর নকশায় সুসজ্জিত করে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করা হয়। ১৩৫৭ হিজরী পর্যন্ত এই কারখানাটি গিলাফ বা ‘কিসওয়াহ’ তৈরি অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ১৩৮১ হিজরীতে সৌদি হজ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষ সৌদি কারিগর দ্বারা রেশমী ও সোনালী সুতা দিয়ে গিলাফ তৈরি করে কাবার গায়ে পরিধানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩৮২ হিজরীতে বাদশাহ ফয়সাল ইবনে আব্দুল আজিজ নতুন ডিক্রি জারির মাধ্যমে নতুন করে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। খাঁটি প্রাকৃতিক রেশমী রং এর সাথে কালো রং-এর কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি বৎসর হজের ঠিক আগে কাবা শরীফের গিলাফ সরিয়ে তা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হাজীদের ইহরামের শ্বেতশুভ্রতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাদা গিলাফ পরানো হয়। হজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১০ জিলহজ্জ তারিখে নতুন গিলাফ পরানো হয়। পুরোনো গিলাফটি খ- খ- করে মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের উপহার দেয়া হয়।
প্রতি বছর দুটি করে গিলাফ তৈরি করা হয়। একটি মূল এবং অপরটি সতর্কতার জন্য তৈরি করে রাখা হয়। একটি গিলাফ হাতে তৈরি করা হয়, যেটা তৈরিতে সময় লাগে আট-নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। গিলাফ তৈরি করার পর তা কাবা শরিফের চাবির রক্ষক বনি শাইবা গোত্রের মনোনীত খাদেমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সবার সহযোগিতায় গিলাফ কাবা শরিফের গায়ে চড়ানো হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।