Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্র তালিবানের সাথে কথা বলবে ফাতাহ আল-শামের সাথে নয় কেন

আনাদোলু এজেন্সি : | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ২১ আগস্ট আফগানিস্তানে ইসলামপন্থীদের সাথে যোগাযোগ করার বিরল সম্মতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে তার প্রশাসন তালিবানের কিছু লোকের সাথে কথা বলতে আগ্রহী। ট্রাম্পের অবস্থান, তার সমস্ত বক্তৃতা তার জনপ্রিয় গা জ¦ালা করা কথাবার্তার মতই আলাদা। ট্রাম্প সে রাতে যা বলেন তাতে তার ডেপুটি বিতর্কিত সেবাস্টিয়ান গোরকা (যিনি কয়েকদিন আগে বরখাস্ত হন) প্রেসিডেন্টকে তার আফগানিস্তান বক্তৃতায় উগ্রপন্থী ইসলামী সন্ত্রাসীদের কোনো উল্লেখ না করার জন্য দায়ী করেন।
পরদিন আফগানিস্তানে আমেরিকার দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তা জেনারেল নিকলসন ও বিশেষ দূত হুগো লোরেন্স ট্রাম্পের বক্তৃতায় তালিবানের সাথে আলোচনার বিষয়ে পুনরায় ব্যাখ্যা করে বলেন, এখনই তালিবানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলার এবং ১৬ বছরের যুদ্ধ শেষ করার সময়।
এখানে যা সিরিয়ার প্রশ্ন নিয়ে আসে, যেখানে মার্কিন নীতি বিশে^র যে কোনো স্থানে তাদের নীতির চেয়ে অধিকতর ধর্মনিরপেক্ষ, তা হচ্ছে সিরিয়া বিষয়ক শান্তি সম্মেলনগুলোতে উপস্থাপনকৃত বিভিন্ন দলিল। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ^ রাষ্ট্রগুলোর দাবি সিরিয়ার যে কোনো সরকারকেই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। অথচ এ দাবি ওয়াশিংটনের নিজের ক্ষেত্রেই খাটে না যেখানে সরকার অসাম্প্রদায়িক নয় কিংবা ধর্ম নিরপেক্ষও নয়। হোয়াইট হাউস ক্রিসমাস ট্রি ও হানুক্কাহ মেনোরা আলোকসজ্জিত করে। মার্কিন নির্বাহী ম্যানসন রমজানে একদিন ইফতারের আয়োজন করে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাকে একটি শিয়া ধর্মীয় সরকার ও আফগানিস্তানে একটি সুন্নী আমিরাত মেনে নিতে পারে তাহলে সিরিয়ায় কেন অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্ম অ-নিরপেক্ষ সরকারের পাশাপাশি একটি ইসলামী আমিরাত মেনে নিতে পারবে না? এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি দীর্ঘদিনের চরম শত্রæ তালিবানের সাথে কথা বলতে পারে তাহলে কেন সে সিরিয়ার ফাতাহ আল-শাম এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মত চরমপন্থী নয় এমন অন্যান্য গ্রæপের সাথে কথা বলতে পারবে না?
ফাতাহ আল শাম হচ্ছে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সন্ত্রাসী শত্রæ আল কায়েদার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা সিরিয়ার ইসলামপন্থী গ্রæপ জাবহাত আল- নুসরার উত্তরসুরি। এ সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো যতদিন আন্ত সীমান্ত সন্ত্রাস বা আন্তর্জাতিক সহিংসতা বন্ধ রাখবে ততদিন সন্ত্রাসের ব্যাপারে আমেরিকার নীতি নমনীয় থাকবে বলে উপলব্ধি করে আল-নুসরা আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। অনেকেই যখন বলছেন যে এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু নামমাত্র তখন এটা স্মরণ করা ভালো যে আল-কায়েদা নিজেও স্বাধীন গ্রæপগুলোর সংগঠন যাদের সম্পর্ক শুধু কাগজে।
তালিবানের মত ফাতাহ আল শামও একটি সরকারের জন্য দুঃস্বপ্ন যে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় না এবং জনগণের উপর কঠোর শাসন চাপিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি পাশ্চাত্যের আলোকিতকরণের নীতি ছড়িয়ে দেয়ার কাজ না করে অথবা এ সব সরকারের উপর মানবাধিকারের শাশ^ত ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং উন্নত দেশগুলোর মত নারী অধিকার প্রদানের জন্য কূটনৈতিক বা অন্যান্য উপায়ে চাপ সৃষ্টি না করে তাহলে ফাতাহ আল শামকে শত্রæ করার কোনো যুক্তি ওয়াশিংটনের নেই।
যদি মার্কিন আলোচনাকারীরা ফাতাহ আল শামকে আল কায়েদা থেকে আলাদা করতে পারেন এবং নিশ্চিত করতে পারেন যে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে একটি ইসলামী আমিরাত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের জন্য একটি নিরাপদ ক্ষেত্র হবে না তাহলে এ প্রশ্ন করতে হয় যে কেন আমেরিকান কূটনীতি তালিবানের কাছে পৌঁছাতে পারলে ফাতাহ আল শামের কাছে পৌঁছতে পারবে না?
এরও কোনো যুক্তি নেই যে যুক্তরাষ্ট্র যদি আফগানিস্তানে ইসলামপন্থীদের সাথে আলোচনা করতে পারে তাহলে সিরিয়ার ইসলামপন্থীদের সাথে কেন আলোচনা করতে পারবে না।
অন্যদিকে মনে হয়, ট্রাম্প উপলব্ধি করেছেন যে না তার না তার দলের জনপ্রিয় আন্দোলনকারীদের কারো আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বা বিদেশী সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সে অভিজ্ঞতা আছে। তারপর গত কয়েক মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার প্রশাসনের প্রথম নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পরিবর্তন করছেন ও তাদের জায়গায় জেনারেলদের বসাচ্ছেন। এ জেনারেলরা কোনো রুপার বুলেট নন যারা আমেরিকার ও ট্রাম্পের সকল সমস্যা দূর করতে পারবেন। ট্রাম্প প্রশাসনের জেনারেলরা হচ্ছেন আমেরিকার নেতৃত্ব অটোপাইলটের হাতে তুলে দেয়ার সমতুল্য, অন্যদিকে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের কর্মসূচির একমাত্র লক্ষ্য দ্বিতীয় মেয়াদে পুননির্বাচিত হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন।
আমেরিকাকে অটোপাইলটের উপর রেখে ট্রাম্প কার্যকর ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব গ্রহণ ঘটতে দিয়েছেন। ইরাকে আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্ট নীতি প্রথম স্থানে প্রণীত হয়েছে জেনারেলদের দ্বারা। এতে রয়েছে ইরাকে মধ্যপন্থী আল কায়েদা নেতাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্য চরমপন্থীদের কাছ থেকে তাদের সরিয়ে আনা এবং চরমপন্থী ও তাদের শাসনকে পরাজিত করার জন্য মধ্যপন্থীদের সাহায্য করতে মার্কিন সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গ্যাস পেডালের উপর থেকে তার পা তুলে না নেয়া পর্যন্ত ইরাকে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি নীতি কাজ করেছে। ওবামা অকালে ইরাকে আমেরিকার সুন্নী ত্রিদের ত্যাগ করেন এবং তাদে শিয়া প্রতিদ¦›দ্বীদের তাদের উপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ দেন। আমেরিকার সৈন্য বৃদ্ধি করে এ ক্ষতিটি করা হয়। ওবামা ইরাককে আবার এক করার জন্য সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির উল্টোটা করেন ওবামা। কিন্তু ইরানের কারণে ওবামা ব্যর্থ হন। ইরান ইরাকের সুন্নীদের উন্নয়নের বিরোধিতা করেছে। এভাবে ওবামা পিছিয়ে যান। ওবামা ইরাকে যে ইরানি নীতির কাছে নতি স্বীকার করেনঃ তা হচ্ছে শিয়াদের উপর সুন্নীদের কর্তৃত্ব করতে দেয়া।
২০১০ সালে ওবামা আফগানিস্তানে ইরাকি নীতি অনুসরণ করেন। কাবুল তালিবানকে হটিয়ে দেয়ায় এবং অধিকাংশ শহর ও গ্রাম এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় এ পরিকল্পনা স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করে। এ সময় মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করে। দুর্নীতি ও আফগান রাজনীতির ঝগড়াটে বৈশিষ্ট্যের কারণে আফগান সৈন্যবৃদ্ধি জনিত সুফল উল্টো ফল দেয় যা আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণিকে দেশের প্রধানের অবস্থান থেকে সংকুচিত করা শুরু করে কাবুলের মেয়রের পর্যায়ে নামিয়ে আনে।
উপজাতি ও আফগান জনগণের ঝগড়াটে স্বভাবের কারণে আমেরিকার জন্য আফগানিস্তানকে একসাথে করা, একটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দেশটিকে তুলে দেয়া প্রায় অসম্ভব বলে বাস্তবতা উপলব্ধি করে মার্কিন জেনারেলরা নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হন। তা হচ্ছেঃ ইসলামপন্থীদের সাথে শান্তি স্থাপন করা যতক্ষণ না জঙ্গি বে-সরকারী গ্রæপগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন রার্ষ্টের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত এলাকাগুলো আমেরিকা অথবা বিশ^ব্যাপী তার স্বার্থগুলোতে হামলা চালাতে ইচ্ছুক সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত না করছে।
এ রকমই ছিল তখনকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সিনেটর বারাক ওবামার চিন্তাভাবনা যখন তিনি ২০০৮ সালে সিনেট পররাষ্ট্র নীতি কমিটির শুনানিকালে ইরাকে তৎকালীন দুই মার্কিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস ও রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রোকারকে জিজ্ঞেস করেন যে ইরাক পুনর্গঠন অথবা সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বাদ দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা যদি নেয়া হয় যাতে আমেরিকানরা সম্মানজনক ভাবে সেখান থেকে চলে আসতে পারবে , তাহলে কি হবে।
আজকের আফগানিস্তানে ২০০৯-এ যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যা করেছিল তার অনুসরণ করা হচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের সাথে কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা হ্রাস পেয়েছে যেহেতু বিদেশে অধিক সৈন্য পাঠানো এখন রাজনৈতিক ভাবে বেশী ব্যয়বহুল। এখন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত একটি তালিবান আমিরাতের ব্যাপারে মনে কিছু করবে না, এমনকি যদি সে আমিরাত মানবাধিকার ও নারী অধিকার নীতি অনুসরণ নাও করে তবুও না যদি সে আমিরাত পাশ্চাত্য বিরোধী সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয় না হয়। আরেক পন্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের নাগরিকদের তাদের সরকার পদ্ধতি বেছে নিতে দেবে যদি তা দেশ কিভাবে শাসিত হবে সে ব্যাপারে পশ্চিমা আদর্শ নিশ্চিত নাও করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তালিবান


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ