Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাচীন হিন্দু সমাজে গরুর গোশত খাওয়ার প্রচলন ছিল

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর কোরবানী মিল্লাতে ইবরাহিমীর প্রতীকী নিদর্শন, যা ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির অন্যতম হজ্বেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ। কোরবানীর কথায় আসলে প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিলের কথা স্মরণ করতে হয়। দুনিয়াতে সর্ব প্রথম পশু কোরবানীদানকারী হাবিলের পশুটিই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল। জান্নাতে এটি (দুম্বা/ মেষ) চল্লিশ বছর চরে বেড়িয়েছিল বলে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন। স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে হজরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁর প্রাণ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)কে জবাই (কোরবানী) করতে উদ্যত হন ঠিক সে সময় আল্লাহ তার এ উদ্যোগে সন্তুষ্ট হয়ে জান্নাত হতে সে দুম্বাটিই প্রেরণ করেন এবং ইবরাহীম (আ.) ইসমাইলের স্থলে সেই দুম্বা জবাই করেন এবং ইসমাইল (আ.) বেঁচে যান এবং তিনি জবীহুল্লা উপাধিতে ভূষিত হন।
কোরবানী সম্পর্কে কয়েক প্রকারের বিতর্ক ইসলাম বিদ্বেষীদের পক্ষ হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব বিতর্কের মধ্যে ইহুদীদের সৃষ্টি করা বড় প্রশ্ন জবীহুল্লাহ কে ছিলেন? ওদের দাবী জবীহুল্লাহ ছিলেন হজরত ইসহাক (আ.) ইসমাইল (আ.) নন। ওদের এ অবাস্তব দাবির সমর্থনে রয়েছেন কিছু কিছু মুসলমান লেখক-পন্ডিত। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে গো পূজারীদের পক্ষ হতে মুসলমানদের গরু কোরবানীকে গোহত্যা আখ্যায়িত করা এবং গো-মাতার হত্যা বন্ধ করতে গিয়ে মুসলিমদের হত্যা করা এবং মুসলমানদের গরু কোরবানী নিষিদ্ধ করা যা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অতি পুরানা খায়েশ। এদুটি বিষয়ের ওপর আমরা আলাদাভাবে আলোকপাত করতে চাই।
উলামায়ে ইসলামের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, হজরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আ.), যিনি ছিলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সমগ্র মোমেন মুসলমানদের পিতা, স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে তার প্রাণ প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)কে কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন, ঠিক এই সময় আল্লাহর পক্ষ হতে একটি দুম্বা কিংবা মেষ তার ছোরাতলে এসে যায় এবং আল্লাহর নির্দেশে ইসমাইল (আ.) এর স্থলে দুম্বাটি জবাই হয়ে যায়। কোরআনে এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। ইহুদীরা এ ঘটনাকে তাদের পিতা ইবরাহীম (আ.) এর অপর পুত্র হজরত ইসহাক (আ.) এর সাথে মেলাতে চায় এবং তাদের এ দাবী প্রচার করতে থাকে। ফলে তাদের এ দাবির সমর্থনে কিছু লেখক-পন্ডিত এগিয়ে আসেন। আর এ ভ্রান্ত মতবাদের প্রভাব যুগে যুগে ছিল, আজো একেবারে বিলীন হয়ে গেছে দাবী করা যায় না।
কিন্তু উলামায়ে ইসলাম ও সত্যনিষ্ঠ মুসলিম লেখকগণ বিস্তর অকাট্য যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে ইহুদীদের দাবী নস্যাৎ করেছেন। ফলে তাদের দাবীটি কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। উলামায়ে ইসলামের বহু যুক্তি-প্রমাণের মধ্য হতে এখানে আমরা মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করতে চাই, যার প্রথমটি হচ্ছে, হজরত ইসমাইল (আ.) এর স্থলে জবাই হয়ে যাওয়া দুম্বার শিং। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, হজরত ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে জবাই হওয়ার জন্য যে দুম্বাটি জান্নাত হতে প্রেরিত হয়, তা চল্লিশ বছর পর্যন্ত জান্নাতে চরতে থাকে বলে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়। আরো বলা হয়ে থাকে, এটি ছিল সেই দুম্বা, হাবীল যা মানত হিসেবে পেশ করেছিলেন এবং আল্লাহর দরবারে যা কবুল হয়েছিল। এ দুম্বার শিং ইসমাইল (আ.) এর পক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
ইসলামের ইতিহাস হতে জানা যায় যে, হজরত ইসমাইল (আ.) এর বদলে যে দুম্বাটি আল্লাহতাআলা প্রেরণ করেছিলেন তার শিং সুদীর্ঘকাল খানা-ই কাবায় লাগানো ছিল এবং এ শিং-এর ওপর বনি ইসমাঈল অর্থাৎ কোরেশদের দখল (কব্জা) ছিল। কিন্তু হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.) ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফের মধ্যে যুদ্ধের সময় হাজ্জাজের আগুনে বোমা নিক্ষেপের ফলে খানা-ই কাবায় আগুন লেগে যায়, তখন বিভিন্ন আসবাব পত্রের সাথে এ শিং ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এবং ইমাম শাবী (রহ.) এ শিং এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এখানে স্মরণযোগ্য যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.) ছিলেন হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) এর পুত্র। ইয়াজিদ ইবনে মোআবিয়ার যুগে হিজরী ৬৪ সালের ২৩ রজব মক্কায় মুসলমানগণ বায়আত গ্রহণ করেন। তিনি হেজায ও ইরাকে ৯ বছর ২২ দিন খলিফা ছিলেন। তার বয়স হয়ে ছিল ৭২/৭৩ বছর। তাকে ৬ষ্ঠ খলিফা বলা হয়, যাকে শহীদ করা হয়।
আরো একটি বড় প্রমাণ জনৈক ইহুদী আলেমের সাক্ষ্য। মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর ইসলামে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। মোহাম্মদ ইবনে কাব কুজির বর্ণনা অনুযায়ী একবার আজীজ রহ. উক্ত ইহুদী ও মুসলিমকে জিজ্ঞাসা করেন, জাবীহ হজরত ইসহাক (আ.)? জবাবে ইহুদী আলেম বলেন, আমীরুল মোমেনীন ইহুদীরা ভালোভাবেই জানে, জাবীহ ছিলেন হজরত ইসমাইল (আ.)। কিন্তু তারা কেবল মুসলমান বিদ্বেষী হওয়ার কারণে এ ঘটনাকে হজরত ইসহাক (আ.) এর সাথে সম্পৃক্ত করতে চায়। কেননা তাকে তারা পিতা হিসেবে মেনে থাকে। নও-মুসলিম এ ইহুদী আলেমের এ সত্য ভাষণ পরবর্তী কালের লেখকগণ, যারা হজরত ইসহাক (আ.) কে জাবীহ মনে করেছেন তারাও ঐ ইহুদী আলেমের মত সমর্থন করেন, তাদের হয়তো এ কথা জানা ছিল না, জানলে তারা ইহুদী মতবাদ পছন্দ করতেন না।
বিখ্যাত আরব সাহিত্যিক এছমায়ী বলেন, আমি আবু আমর ইবনে আলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হজরত ইসমাইল (আ.) কি জবীহ ছিলেন, নাকি হজরত ইসহাক (আ.)? জবাবে তিনি বলেন, ইছমায়ী তুমি কি জান না, হজরত ইসহাক (আ.) মক্কায় কখনো এসেছিলেন? হজরত ইসমাইল (আ.) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মক্কায় ছিলেন এবং তিনিই পিতার সঙ্গে খানা-ই কাবা নির্মাণ করেছিলেন। এসব অখÐনীয় প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও হজরত ইসহাক (আ.) কে যারা জবীহ বলেন, তারা প্রকারান্তরে ইহুদীদের ভ্রান্ত দাবিরই সমর্থক।
এবার দ্বিতীয় বিষয়টির ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যাক। কোরবানী ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর অংশ বিশেষ, যা পবিত্র হজ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। মুসলমানদের এ কোরবানী প্রথার সূচনা বাবা আদমের পুত্র হজরত হাবিল হতে, দুনিয়াতে তিনিই পশু কোরবানী করেছিলেন এবং পরবর্তী কালে হজরত ইবরাহীম (আ.) পুত্র কোরবানী দিতে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের বদলে পশু কোরবানী করেন এবং সেই আত্মত্যাগের মহিমান্বিত ঘটনাকে চিরঞ্জীব ও অবিস্বরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামে কোরবানী প্রথার প্রবর্তন। সেই মিল্লাতে ইবরাহিমির নিদর্শন স্মৃতি এবং ইসলামের ঐতিহ্য প্রতীক।
কোরবানী ও নানা উপলক্ষে মুসলমানদের গরু জবাইকে হিন্দুরা নাম দিয়েছে ‘গোহত্যা’ হিসেবে। গাভী হচ্ছে তাদের ‘গোমাতা’। গাভীর দুধ তাদের প্রিয় খাদ্য এবং গরুর চামড়া তারা নানা কাজে ব্যবহার করলেও গোমাংসের গন্ধও তারা সহ্য করতে পারে না। খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আসলেই কি হিন্দুদের মধ্যে গোমাংস ভক্ষণ করার প্রচলণ ছিল না? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব তো তাদের বেদ গ্রন্থেই রয়েছে এবং ইতিহাসও তাই বলে। অর্থাৎ খোদ হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করতো। এ প্রসঙ্গে পন্ডিত আবনাস চন্দ্র দাস তার গ্রন্থে লিখেছেন, প্রাচীন আর্যদের এখানে গোমাংস ভক্ষণের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। (ঋদবেগ ২য় সংস্করণঃ ৯৭ পৃষ্ঠাঃ) শ্রী চিন্তামীথ ব্যউভেদী বলেন, বহুবেদমন্ত্রেও লেখা আছে যে, গোমাংস ভক্ষণ করা উচিত। অর্থবেদে লেখা আছে- গৃহবাসীরা গাভীর সুমিষ্ট দুধ এবং সুস্বাদু মাংস অতিথিকে না খাইয়ে খাবে না। হিন্দু পুরানগুলোতে এ সম্পর্কে আরো নানা উক্তি রয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার এক প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, যাতে প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীন কালে হিন্দুদের মধ্যে গোমাংস ভক্ষণের প্রচলন ছিল।
পূর্বে ভারতবর্ষে কেবল মুসলমান নয়, হিন্দুদের বিপুল সংখ্যক এবং ইংরেজরা সবাই গরুর গোশত খেতো বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। এ হালাল খাদ্য খাওয়া বিশেষত মুসলমানদের তামাদ্দুনিক অধিকারও বটে। ইতিহাস বলে, সিপাহী বিদ্রোহ তথা ১৮৫৮ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে মুসলমানদের গরু কোরবানীকে কেন্দ্র করে কোনো দাঙ্গা ফাসাদ হয়নি। তখনো গরু কোরবানি চালু ছিল এবং সবাই গরুর গোশত খেত। জানা যায়, ১৮৩৯ সালে আজমগড়ে গরু কোরবানি উপলক্ষে বিরাট দাঙ্গা ফাসাদ হয়েছিল, এ ধরনের এটি ছিল প্রথম দাঙ্গা। অতঃপর বিখ্যাত কংগ্রেসী নেতা মি. তিলক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় গরু জবাই বিরোধীদের একটি সমিতি। এরপর থেকে কংগ্রেসী নেতৃবর্গ সর্বদা গোরক্ষার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সমস্যাটি সৃষ্টি করা হয় কেবল মুসলমানদের ঐতিহ্য-স্বাতন্ত্র মুছে ফেলার জন্য। এ সমস্যা পরবর্তী কালে যুগে যুগে নতুন পাখা বিস্তার করতে থাকে এবং বর্তমানে তার ধারাবাহিকতায় গোহত্যা বন্ধের নামে মুসলমান হত্যা চলছে।
গোহত্যা বন্ধের তিলক আন্দোলন ভারতে কখনো হ্রাস পায়নি, বরং যুগে যুগে নানা স্থানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রাচীন ভারতের হিন্দু সমাজে যে গোমাংস ভক্ষণ করা বৈধ ছিল এবং গরু জবাই করা মুসলমানদের জন্য নিষেধ ছিল না, সেই হিন্দু সমাজের মধ্যে বহু হিন্দুদের মধ্যে গরুর গোশত খাওয়ার প্রচলন রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তা সত্তে¡ও গোমাতা, গোপূজারী যারা মুসলমানদের গরু জবাইকে হত্যা বলে এবং জবাইয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করে এবং কোরবানীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তারা গোদুগ্ধ কেন পান করে, কেন দধি খায় এবং কেন গোচর্ম ব্যবহার করে?
বিগত শতকের গোড়ার দিকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যখন গোহত্যা নিষিদ্ধ করার জন্য আইন পাশ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছিল, তখন শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) মন্তব্য করেছিলেন: যখন কোনো সরকার এমন কোনো কাজকে নিষিদ্ধ করে যা ধর্মে হালাল, তখন তা না করা পাপ। দ্বিতীয়ত, গরু জবাই করা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই জরুরী। তৃতীয়ত, প্রত্যেক ব্যক্তির তামদ্দুনিক অধিকার হচ্ছে, সে যে খাদ্য ইচ্ছা খাবে, মুসলমান কেন তার অধিকার ছেড়ে দেবে, যার নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। চতুর্থত, কেবল মুসলমানই নয় যারা গরুর গোশত খায় বরং হিন্দুদের এক বিরাট দল এবং ইংরেজরা সবাই গরুর গোশত খায়। সম্ভবতঃ এমন কোনো হিন্দু নেই, যে তার গোমাতার চামড়া কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার করে না। হজরত মাদানী (রহ.) এর এ মন্তব্য হতে গরু জবাই ও কোরবানী সম্পর্কে সে সময়কার বিরূপ হিন্দু মানসিকতা ও গরু জবাই করার উপকারের কথা জানা যায় এবং হজরত মাদানী (রহ.) এর সে বক্তব্য আজো সমান ভাবে প্রযোজ্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গরু

২৪ জুন, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন