Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাতখুন মামলার আপিলের রায়

| প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অবশেষে বহুল আলোচিত সাতখুন মামলার ডেথ রেফারেন্সের রায় প্রদান করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি দ্বৈতবেঞ্চের রায়ে অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে নিম্ন আদালেতের দেয়া ফাঁসির দন্ড প্রাপ্ত ২৬ জনের মধ্যে ১৫ জনের দন্ড বহাল রাখা হয়েছে। ১১জনের ফাঁসি থেকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৯ জনের নিম্ন আতালতের দেয়া বিভিন্ন মেয়াদের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় নারায়ণগঞ্জে সাতখুনের ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে গণ্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত একতরফা জাতীয় নির্বাচনের সাড়ে তিন মাসের মাথায় ২৭ এপ্রিল নারায়নগঞ্জের জেলা জজ আদালত এলাকা থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭জনকে অপহরণ করার পর নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এবং লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। ঘটনার তিনদিন পর নদীতে লাশ ভেসে উঠলে সাতখুন গণমাধ্যমে ও সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত বিষয় হয়ে দাড়ায়। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে, এই মামলায় এলিটফোর্স র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ। এলিটফোর্স র‌্যাবের কতিপয় সদস্যের সম্পৃক্ততার কারণে পুরো বাহিনীকেই বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে আসা এলিটফোর্সের কর্মকর্তা এবং সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাতাসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ২৫ জনের সম্পৃক্ততা প্রমানিত হওয়ার পর এই মামলার বিচার নিয়ে জনমনে এক ধরনের সংশয় দেখা দিলেও অবশেষে ১৫ জনের ফাঁসি ও ১১ জনের যাবজ্জীন সাজা বহাল রেখে ডেথ রেফারেন্সের রায় ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সব সংশয়ের আপাত অবসান ঘটল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রভাবশালী মহলের যোগসাজসে সংঘটিত হত্যাকান্ডের এই রায় একটি বড় বিচারিক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল।
গত কয়েক বছরে দেশে শত শত মানুষ গুম-অপহরণ ও অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে নদীতে ও মহাসড়কের পাশে হাতপা বাঁধা, বস্তাবন্দি, গুলিবিদ্ধ অথবা গলাকাটা লাশ পাওয়া গেছে। গুম-অপহরণের শিকার হওয়া অনেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ধারি ব্যক্তিদের হাতে অপহৃত হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভ‚য়া পরিচয়ধারি অপরাধিচক্রের কিছু সদস্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে কিছু অপরাধপ্রবণ সদস্য ও কর্মকর্তা রয়েছে। তাদের কারণে পুরো বাহিনীর বদনাম হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব অপরাধি সদস্যের বেআইনী কর্মকান্ডের সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধিচক্র। তারা র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবি’র ভ‚য়া পরিচয় ব্যবহার করে অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং টার্গেটেড কিলিংএ জড়িত রয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভেসে না উঠলে নারায়নগঞ্জের সাতখুনের ঘটনাও হয়তো অন্যান্য শত শত নিখোঁজ বা অপহরণের ঘটনার মত এখনো একটি অনিশ্চিত ও অনিস্পন্ন মামলা হিসেবে ঝুলে থাকতো। ভুক্তভোগিরা বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দেশে একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে সমাজকে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে গুম-হত্যাকান্ডসহ প্রভাবশালীদের বড় বড় দুর্নীতি ও অপরাধের অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সাতখুনের ঘটনার প্রায় চার বছর পর এ সংক্রান্ত মামলাটি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্সের রায় নিস্পত্তি হল। বাদি ও ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যরা মামলার রায় দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। অন্যদিকে আসামীপক্ষ সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করতে পারে বলে তাদের আইনজীবীরা জানিয়েছেন। প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফেরত আনা এবং রাজনৈতিক প্রভাব পাশ কাটিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে অভিযুক্ত ও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার এই রায় দেশের বিচারিক ইতিহাসের এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। এই রায় প্রমান করল আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা ও সদিচ্ছা থাকলে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে আরো দ্রুততম সময়ে যে কোন ধরনের অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়। এখনো দেশের শত শত মানুষ গুমের শিকার হয়ে নিখোঁজ রয়েছে। ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যরা তাদের সম্পর্কে সন্দিহান হয়েও বছরের পর বছর ধরে ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভ’মিকা হতাশাজনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা জীবিত অথবা মৃত নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে সব ঘটনা চাক্ষুস তথ্য-প্রমানের ভিত্তিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারনা লাভ করছে, সে সব ঘটনাই দ্রুত বিচারের আওতায় আসছে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কৃতিত্ব এখানে প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে সমাজকে মুক্ত করে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ বহু মানুষের নিখোঁজ হওয়ার কারণসহ তথ্য উদঘাটনের দায়িত্ব দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। সাতখুনের ডেথ রেফারেন্সের রায়ের পর্যবেক্ষণেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। কিছু অপরাধি সদস্যের দায় পুরো বাহিনীর উপর না বর্তালেও সামগ্রিকভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ ধরনের অপরাধের দায় এড়াতে পারেনা। বিশেষত: অর্থের বিনিময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেআইনী কর্মকান্ড বন্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুততম সময়ে সাতখুন মামলার অবশিষ্ট আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে দন্ড কার্যকর করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন