পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী পুরুষ নায়ক রাজ রাজ্জাক ৭৫ বছর বয়েসে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয় ইন্না ইলাইহে রাজিউন। গত সোমবার সন্ধ্যা ৬.১৫ মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন এই মহানায়ক। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ঊর্দূ চলচ্চিত্র এবং পশ্চিম বাংলার বাংলা সিনেমার একচেটিয়া বাজার থেকে বাংলাদেশের বাংলা সিনেমাকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে নায়ক রাজ্জাক অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহনকারি রাজ্জাক শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে সেখানকার টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রে নিজের স্থান করে নিতে না পেরে ভাগ্যান্বেষণে ষাটের দশকে ঢাকায় পদার্পণ করেছিলেন। পিতৃমাতৃহীন রাজ্জাক একজন শরনার্থী হিসেবেই বাংলাদেশে হাজির হয়েছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এবং এদেশের দর্শকরা শুরুতেই রাজ্জাককে আপন করে নিয়েছিলেন, রাজ্জাকও আজীবন সে ভালবাসার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করে গেছেন। সেই ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের বেহুলা সিনেমায় নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশের সবচে জনপ্রিয় নায়ক ও অভিনয় শিল্পীতে পরিনত হন। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রে যখন মহানায়ক উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনদের একচেটিয়া বাজার রুখে দিয়ে রাজ্জাক-শাবানা, কবরী,সুচন্দা,শবনম, ববিতাদের নিয়ে জুটি গড়ে নিজস্ব জগৎ নির্মান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্র ও বিনোদন পত্রিকা চিত্রালী সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী নায়ক রাজ্জাককে এক সময় নায়করাজ উপাধিতে ভ’ষিত করলে পুরো জাতি তা’ সাদরে গ্রহণ করেছিল। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বেড়ে ওঠার সাথে রাজ্জাকের নিবিড় যোগসুত্র স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
নায়করাজের মৃত্যুতে এ দেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শিল্পের শিল্পী, কলাকুশলী, পরিচালক, প্রযোজক মহল যেন একজন পিতৃতুল্য অভিভাবককে হারিয়েছেন। গতকাল সকালে প্রথম নামাজে জানাজার জন্য রাজ্জাকের মরদেহ এফডিসি চত্বরে নেয়ার পর সকলে একবাক্যে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সেখানে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের নবীণ-প্রবীণ অনেককেই আবেগ ও অশ্রুময় হয়ে পড়তে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে রাখা বিদেহি রাজ্জাকের প্রতি সর্বস্তরের হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের দৃশ্য থেকে আবারো বোঝা গেল এ দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তিনি কতটা গভীর ভালবাসায় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। বনানী আজাদ মসজিদে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। এই মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মরহুমের পরিবার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নানামুখী সংকট অতিক্রম করছে, ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প সংশ্লিষ্টরা যখন রাজপথে নেমে এসেছেন তখন নায়ক রাজ্জাকও তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পাশে দাড়িয়েছিলেন। চলচ্চিত্রে রঙ্গিন জগতে নায়ক-নায়িকাদের নানাবিধ স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। পঞ্চাশ বছরের সক্রিয় অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনার জীবনে রাজ্জাককে কখনো কোন স্ক্যান্ডাল বা পঙ্কিলতা স্পর্শ করতে পারেনি। নায়করাজ উপাধি এবং মানুষের ভালবাসার মর্যাদা তিনি আমৃত্যু সমুন্নোত রেখেছেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ৩শ সিনেমায় অভিনয় করেছেন, ১৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন এবং কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেছেন। তিনি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। অভিনয় পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনে একজন পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়ী ও স্বচ্ছ মানুষ হিসেবেও তিনি চলচ্চিত্র শিল্পের সকলের অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন।
চলচ্চিত্রের রঙ্গিন জগত রাজ্জাকে চোখকে কখনো ধাঁধিয়ে দিতে পারেনি। জীবনের শুরু থেকেই রাজ্জাক নিজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আপস করেননি। বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাসট্রিতে জায়গা করে নিতে বোম্বের ইউসুফ খান চল্লিশের দশকে দিলিপ কুমার নাম ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কলকাতায় জন্ম হলেও শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে আব্দুর রাজ্জাকের সেখানে স্থান হয়নি। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তাকে শরনার্থী হয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। জীবনের এই রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি কখনো ভুলে যাননি। গত বছর রাজ্জাকের ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিবিসি বাংলাতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের অতীত ভুলিনা। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি, স্ট্রাগল করেছি। না খেয়েও থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনদিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি।’ আজকে আমাদের সমাজকে যখন নানামুখী অবক্ষয়ের সংকটে পড়তে দেখছি। দেশের যুব সমাজে ক্রমবর্ধমান হারে মাদকাসক্তি ও নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা গ্রাস করছে, তখন চলচ্চিত্র শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ধারক বাহকদের এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। সত্তুর ও আশির দশকে বাংলাদেশের চলচিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগে নায়ক রাজ্জাকের দ্বারা লাখো তরুণ অনুপ্রানীত হতো। প্রতিটি সিনেমাহল দর্শকের পদচারনায় মুখরিত থাকতো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মর্যাদার আসনকে অলঙ্কৃত ও উচ্চে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও নায়করাজ রাজ্জাকের অবদান অসামান্য। আজ বাংলা চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনে রাজ্জাকের অন্তিম যাত্রায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হল তা’ কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আমরা নায়ক রাজ্জাকের স্মৃতির প্রদি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।