হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ইস্যু ছাড়া রাজনীতি হয় না। সুরাজনীতির ক্ষেত্রে এমন ইস্যু হতে হয়, যা জনআকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আবার এমন সব ইস্যু যদি হয় যা কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, তবে তাতে জনসম্পৃক্ততা খুব একটা থাকে না। এমন ইস্যুতে জনগণ হয়তো কিছু আলোচনা করে, মন্তব্য করে, তারপর নিজ কাজে মন দেয়। কারণ এসব ইস্যু তাদের খেয়েপরে বেঁচে থাকার সাথে সম্পর্কিত নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাই ছিল এমন যে, এর সাথে সাড়ে সাত কোটি মানুষের শোষণহীন ও স্বাধীনভাবে বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ইস্যুটি জড়িত ছিল। পাকিস্তানী শাসকদের চরম বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক আচরণ এবং দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা থেকে মানুষ যে কোনো উপায়ে মুক্তি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল। তাদের এই সমন্বিত ইচ্ছা এবং উদ্যোগের কারণেই স্বাধীনতা এসেছিল। ত্রিশ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়ে বেঁচে থাকাদের মুক্তি দিয়েছিল। তখন ইস্যু ছিল একটাই, মুক্তি পেতে হবে। প্রতিটি প্রাণে এ ইচ্ছা প্রবল এবং হিমালয়সম হয়ে উঠে। এর ধাক্কা পাকিস্তানী শাসকরা সামলাতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার পথ পরিস্কার রাখার জন্য অসংখ্য ইস্যু জনগণ দেখেছে। এগুলোর কোনটার সাথে একাত্ম হয়েছে, কোনোটার সাথে হয়নি। যদি একটি কার্যকর ইস্যুর কথা বলতে হয়, তবে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের ইস্যুটাই প্রধানতম হয়ে উঠে। এরশাদের নয় বছরের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য দেশের মানুষ তখন অধীর হয়ে উঠেছিল। ইস্যু ছিল একটাই, এরশাদের বিদায়। রাজনৈতিক দলগুলোর এই ইস্যুর সাথে জনগণ এক হয়েছিল। ঢাকার রাজপথে লাখ লাখ মানুষ নেমে এসেছিল। পল্টনের মোড়ে ছাত্র ঐক্যের বিশাল মঞ্চকে কেন্দ্র করে মানুষ উল্লাসে মেতে উঠেছিল। মঞ্চে ছাত্রনেতাদের জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনতে তাদের সে কী আগ্রহ! এরশাদের যেদিন পতন হলো, রাজপথে মানুষের যে উল্লাস দেখা গেছে, স্বাধীন বাংলা এমন দৃশ্য আর কখনো কেউ দেখেনি। জনগণ এরশাদের উপর এতটাই ক্ষিপ্ত ছিল যে, সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, এজন্য এয়ারপোর্টে পর্যন্ত পাহারা বসিয়েছিল। এরশাদের কোনো মন্ত্রীর গাড়ি কোনো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, এমন কথা শোনা মাত্রই হই হই করতে করতে মানুষ সেদিকে ধেয়ে গেছে। অর্থাৎ এরশাদ ও তার মন্ত্রীদের পালাবার কোনো সুযোগ দিতে জনগণ নারাজ ছিল। এরশাদের পতনের পর জনসম্পৃক্ত এমন ইস্যু খুব একটা দেখা যায়নি, যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আন্দোলন বলতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি-হানাহানি হয়েছে। জনগণের কাছে এসব আন্দোলন ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়া হিসেবে গণ্য হয়েছে। এতে জনগণের ইস্যু খুব কমই প্রাধান্য পেয়েছে। জনগণ জ্বালাও-পোড়াও এবং গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেকটা ঘরবন্দি হয়েছিল। আন্দোলনে ছিল শুধু উভয় পক্ষের নেতা-কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে যা আন্দোলন হয়েছে, তা ছিল জনগণের জন্য ভীতিকর।
দুই.
বাংলাদেশের মানুষের মতো রাজনৈতিক সচেতন মানুষ বিশ্বে খুব কম দেশেই রয়েছে। রাজনীতি এ দেশের মানুষের খুব প্রিয় বিষয়। যতই অভাব-অনটনে থাকুক না কেন, রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক করতে পিছপা হয় না। তারা ইউরোপ-আমেরিকার জনগণের মতো নয় যে, কে ক্ষমতায় এলো আর গেলো, এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এদেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে খুবই চিন্তা-ভাবনা করে। এর মূল কারণ হচ্ছে, যুগের পর যুগ ধরে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে বসবাস করছে। আন্দোলন-সংগ্রামে সশরীরে এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। বলা যায়, রাজনৈতিক লিগেসি’র ধারাবাহিকতার মধ্যে তাদের বসবাস। ফলে যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে তারা সচকিত হয়ে উঠে এবং আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। বাস, ট্রেন, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে যেখানেই আড্ডা জমে সেখানেই নানা ইস্যুতে আলোচনা শুরু করে দেয়। জনগণের এই আগ্রহকে পুঁজি করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও সরব। এগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে রাজনীতি। তাদের বেশিরভাগ টক শো সাজানো হয় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। টক শোতে আগত সরকারি দল, বিরোধী দলের নেতাদের তর্ক-বিতর্ক এবং নাগরিক সমাজের নিরপেক্ষ ও উচিত কথা রাত জেগে মানুষ অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শোনে। জরিপ করলে দেখা যাবে, যেসব টকশো রাজনীতির বিষয় নিয়ে আয়োজিত হয়, সেগুলোই দর্শকপছন্দের শীর্ষে রয়েছে। দেশে যখন কোনো হট ইস্যুর সৃষ্টি হয়, তখন সবার দৃষ্টি থাকে টক শোগুলোর দিকে। এখানে কে কি বলেন, কীভাবে ইস্যুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন এগুলো মনোযোগ সহকারে শোনেন। কখনো কখনো এসএমএস, টেলিফোনে প্রশ্ন ও মতামত তুলে ধরেন। এখন যেমন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে রাজনীতিতে যে তোলপাড় চলছে, তা এখন মানুষের কাছে অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেলের টক শোতে পরিভ্রমণ করছেন। শুনতে চাচ্ছেন কার কি অভিমত। যারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আনন্দিত, তাদের যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি যারা নাখোশ তাদেরও সমান আগ্রহ রয়েছে। প্রত্যেকেই স্ব স্ব পক্ষের বক্তব্য আলোচনাকারীদের কাছ থেকে শুনতে চান। জনসাধারণের কাছে এই রায় এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। এই ইস্যুটা এমনই যে, এর সাথে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো যোগসূত্র নেই। ইস্যুটি সৃষ্টি হয়েছে আদালতের রায়ের মাধ্যমে। এতে সংক্ষুদ্ধ পক্ষ রাজনীতির যোগসূত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। কোত্থেকে কীভাবে কেমন করে এমন একটি রায় হলো, তা নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। ইতোমধ্যে তাদের কেউ কেউ রায়ের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। প্রধান বিচারপতিকে সরে যাওয়ার কথা বলেছেন। তা নাহলে আন্দোলনেরও হুমকি দিচ্ছেন। অন্যদিকে এ রায়ে যারা খুশি, তারা এর পক্ষ নিয়ে আদালতকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। উচ্ছ¡সিত হয়ে বলছেন, এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তবে এ রায়ের ফলে ক্ষমতাসীন দল যে চরম বিপাকে পড়েছে এবং তার ভীত কেঁপে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বলা যায়, ৫ জানুয়ারীর মতো ভোটারবিহীন একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেও ক্ষমতাসীন দল যেভাবে মেরুদÐ সোজা করে দাঁড়িয়েছিল এবং খোশ মেজাজে ছিল, এই প্রথমবারের মতো সে খুবই দুর্বল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনরা না পারছেন কিছু কইতে, না পারছেন সইতে। কারণ এটি বিরোধী দলের ইস্যু বা আন্দোলন নয় যে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন এবং দোষারোপ করে তুলোধুনো করবেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দলীয় নেতা-কর্মী নামিয়ে পিটিয়ে-ঝেটিয়ে ঠান্ডা করে দেবেন। এই ইস্যু এমন এক জায়গার, এমন এক ইস্যু যে তা হজমও করা যাচ্ছে না, আবার উগড়েও দেয়া যাচ্ছে না। এমন বিপাকে সরকার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে পড়েনি। আমরা দেখেছি, সরকার যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু এবং তা যত কঠিনই হোক না কেন বল প্রয়োগ করে হোক বা হামলা-মামলা করে হোক, তা অবলীলায় মোকাবেলা করেছে। এমনকি বিরোধী দলের আন্দোলন উল্টো পথে ঘুরিয়ে তার ফসল নিজেদের ঘরে তুলেছে। বিরোধী দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দৌড়ের উপর রাখতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে ব্যাপক প্রচার করে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ভাল করেই জানে, বিরোধী দলের আন্দোলন কীভাবে কোন পন্থায় নস্যাৎ ও দমন করা যায়। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে কখনোই চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। তবে বিরোধী দলকে কোনঠাসা করে রাখার মধ্যে যে আদালত থেকে এমন একটা রায় আসবে এবং উলট-পালট অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা হয়তো ক্ষমতাসীন দলের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। এ রায় বিরাট একটা বেøা হয়ে তার কাছে এসেছে। এতে শঙ্কা এবং অসম্মান দুটোই রয়েছে। ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সরকার একটু ঝিম মেরে ছিল। কয়েক দিন পর সরব হয়ে রায়ের কিছু কিছু অংশের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছে। এটা বোঝা যাচ্ছে, যতই দিন যাবে, এ রায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলবে। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিরোধী দলের আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে তাদের ইস্যুকে যেভাবে ভেনিশ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে, এ ইস্যু অত সহজে ভেনিশ করা সম্ভব হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আদালতের এ রায় সংসদে পাশ করার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে কিনা? এর আগে আমরা দেখেছি, আদালত যখন তত্ত¡াবধায়ক সরকার সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে, তখন সংসদ কাল বিলম্ব না করে তা দ্রæত পাশ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংশোধনী সংসদে পাশ করার বিষয়টি সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর। কারণ এই সংসদই ষোড়শ সংশোধনী পাশ করেছিল।
তিন.
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়টি নিয়ে জনগণের মধ্যে আলোচনা হলেও এ ইস্যু তাদের নিত্যদিনের সমস্যায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। আইনি বিষয় আইনের মাধ্যমে সমাধান হবে, এটা তাদের কামনা। এ ইস্যু নিয়ে ভাবার খুব একটা সময় তাদের নেই। তাদের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, কীভাবে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেয়া তাদের পক্ষে এখন কষ্টকর। তাদের জীবনের টানাপড়েন দিন দিন বেড়েই চলেছে। চালের দাম সেই কবে বেড়েছে, তা আর কমার নাম নেই। সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও চালের দাম কমাতে পারছে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হঠাৎ কেন খাদ্য সংকটে পড়ল, বিশ্বের চতুর্থ চাল উৎপাদনকারী দেশকে কেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হতে হলো, এ নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। শুধু চালের দাম নয়, অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। পেঁয়াজের দাম এক লাফে ২৫-৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এ দাম আশু কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং দিনকে দিন বাড়বে। পেঁয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আদা, রসুন। কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ভারতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। যে আদা, রসুন চীন থেকে আমদানি করা হয়, তার দামও সেখানে বেড়ে যাওয়ায় দেশে বেড়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, পেঁয়াজ, আদা, রসুন উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের পরদেশ নির্ভরশীল হয়েই থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, আদা, রসুনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই আমাদের আমদানি করে খেতে হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথাটি এক অর্থে শুভংকরের ফাঁকি। এই যে এত বড় একটি ইস্যু হয়ে রয়েছে, এ ইস্যুটি এখন চাপা পড়ে রয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলসহ সবার মনোযোগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের উপর। জনসাধারণ যে এক চরম দুঃসময়ের মধ্যে নিপতিত, তা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এর উপর যেভাবে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তাতে যে মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। লাখ লাখ মানুষের পানিবন্দি অবস্থায় থাকা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, খাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির অভাব, কর্মজীবীদের বেকার হয়ে পড়া থেকে শুরু করে রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বন্যা মোকাবেলায় সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারের নার্ভাস সময় কাটছে, বিরোধী দলগুলো সরকারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পুরো রাজনীতির এখন আলোচ্য বিষয় আদালতের রায়। সরকার ও মাঠের বিরোধী দলের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার বলছেন, আদালতের রায় নিয়ে রাজনীতি করে ক্ষমতায় যাওয়ার রঙ্গিন খোয়াব দেখছে বিএনপি। তাদের এ খোয়াব কর্পুরের মতো উবে যাবে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, তারা বেশ শংকিত অবস্থায় রয়েছেন। আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে ভয় তাড়ানোর এক ধরনের স্ট্র্যাটেজি নিয়েছেন তারা। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব বলে চলেছেন, এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। পদত্যাগ করে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া উচিত। দেখা যাচ্ছে, আদালতের বর্তমান ইস্যুটি নিয়েই ক্ষমতাসীন ও মাঠের বিরোধী দল রাজনীতিতে সরব। এর ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে যতই দিন যাবে এ ইস্যু যে অন্যান্য ইস্যুর মতোই ধীরে ধীরে চাপা পড়তে শুরু করবে এবং নতুন কোনো ইস্যু আলোচনায় আসবে, তা আগেভাগেই বলা যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সংসদে যে একটি বিরোধী দল আছে, তা যেন হারিয়ে গেছে। এ ইস্যুতে তার কোনো বক্তব্য বা ভূমিকা নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার হয়তো বলে দিয়েছে, এ ইস্যুতে সে যেন কোনো বক্তব্য বা ভূমিকা না রাখে। অবশ্য এ বিরোধী দল ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে, গ্রীক উপকথার অর্ধ মানুষ অর্ধ ঘোড়ার মতো। দলটি না জনগণের ইস্যু নিয়ে কথা বলছে, না সরকারের গঠনমূলক বিরোধিতা করছে। দলটি ব্যস্ত ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে। রাজনীতিতে দলটি যে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, তা এক প্রকার নিশ্চিত।
চার.
এটা পরিস্কার, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ পরিহার বা এক্সপাঞ্জ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল উঠেপড়ে লেগেছে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের জন্য এ পর্যবেক্ষণগুলো খুবই বিব্রতকর এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তারা আইনি পদক্ষেপসহ ন্যায়সঙ্গত অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ বিতর্কের অবসান যত দ্রæত নিষ্পত্তি করা যায়, দেশের জন্য তত মঙ্গল। কারণ অস্থিরতা নিয়ে কখনোই সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। সরকারের উচিত হবে, সাধারণ মানুষ এখন যেসব সমস্যা নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে, সেদিকে মনোযোগ দেয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষকে স্বস্তি দেয়া। বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রশাসনিক সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ কাজ সঠিকভাবে করতে না পারলে একদিকে যেমন লাখ লাখ মানুষ বিপন্ন হবে, তেমনি সরকারের ব্যর্থতার দিকটিও ফুটে উঠবে। বিরোধী দলগুলোরও উচিত জনসম্পৃক্ত ইস্যু নিয়ে কথা বলা এবং বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের রাজনীতির মূল ধারাটাই হয়ে উঠেছে ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়া নিয়ে। এতে জনসম্পৃক্ত ইস্যু খুব কমই থাকে। ক্ষমতাসীন দলের লক্ষ্য থাকে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা এবং বিরোধী দলের লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। এতে কারোই আপত্তি থাকতো না যদি এই পাওয়ার প্লে’র কেন্দ্রবিন্দু জনগণ হতো। ক্ষমতায় থেকে বা গিয়ে যদি জনগণের কল্যাণই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠত।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।