Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ড্রেজার ক্রয় ও নদী খননে শম্বুক গতি

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

একের পর এক বন্যার গ্রাসে সয়লাব হয়ে পড়ছে দেশ। হাজার হাজার কোটি টাকার ফসলহানি এবং কোটি মানুষের দুর্ভোগ বয়ে আনা বন্যার নেপথ্য কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে নদীগুলো ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়াকে। এমন কি নদনদীগুলোর অতিমাত্রায় ভাঙ্গনপ্রবণ হয়ে পড়ার কারণও পলিমাটিতে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া। ভারতের ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধের কারণে পদ্মা-যমুনা, তিস্তাসহ অসংখ্য শাখানদীতে বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় পানিশূন্য থাকলেও বর্ষার আগে উজানের বাঁধগুলোর সব সুইস গেট খুলে দিয়ে কার্যত পরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক নদীতে এক তরফা বাঁধ নির্মাণ বা পানি প্রত্যাহারের বৈধতা না থাকলেও ভারত কোন আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশনের তোয়াক্কা করছে না। বাংলাদেশ সরকার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, একইভাবে নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণেও এখনো কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। স্বাধানতাত্তোর বাংলাদেশে ফারাক্কার চরম প্রতিক্রিয়ার শুরু থেকেই পদ্মানদীর নাব্য রক্ষাসহ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্যতম কৌশল হিসেবে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ এবং নদনদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং-এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন দেশি-বিদেশি নদী বিশেষজ্ঞরা। সরকারও নীতিগতভাবে এসব পরামর্শ মেনে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নদী ড্রেজিং এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ ইস্যুকে সামনে আনলেও আদতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোন অদৃশ্য সুতোর টানে যেন সবকিছু আটকে যায়।
প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের নদনদীগুলোতে অন্তত ১৩৮ কোটি টন পলি জমা আছে। চলতি বছরের বন্যায় হয়তো আরো কয়েক কোটি টন পলি জমা হয়ে থাকবে। ভাটি বা অববাহিকার দেশ হওয়ায় দেশের নদীগুলোকে নাব্য ও পানিধারণক্ষম রাখতে বাংলাদেশকে নদী ড্রেজিং ও পানি ব্যবস্থাপনায় বছরে শত শত কোটি টাকা খরচ করতে হবে, এটা নিশ্চিত। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর জাতীয় বাজেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও নদী শাসন, ড্রেজিং, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থতার খতিয়ান অনেক দীর্ঘ। এর ফলে কোটি কোটি মানুষকে একদিকে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার হতে হয়, অন্যদিকে খরিপ মওসুমে পানির অভাবে বড় বড় সেচ প্রকল্পগুলোর বিশাল অংশ অকার্যকর হয়ে থাকতে হয়। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহার না ঘটলে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত থাকলে নদীবাহিত পলিমাটি এতটা নৌপথে জমে ভরাট হতনা। সুপরিকল্পিত নদীশাসন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং নদী থেকে উত্তোলিত পলিমাটিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি উন্নয়নে কাজে লাগানোর ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আছে। নদী ড্রেজিং এবং পলি উত্তোলনের মহাপরিকল্পনা নিয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলো শুধুমাত্র পরিকল্পনা, প্রত্যাশা ও সম্ভাব্যতার মধ্যেই বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সারা বিশ্বের নদনদীগুলো যে পরিমাণ পলিমাটি বহন করে তার এক-পঞ্চমাংশ বা ২০ ভাগ জমা হয় বাংলাদেশের নদীগুলোতে। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে নদীগুলোর নাব্য ঠিক রাখতে বছরে ৩ কোটি ঘনমিটার পলি অপসারণ করা প্রয়োজন। অথচ কাগজে কলমেই আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজিং সক্ষমতা বছরে মাত্র ৫০ লাখ ঘনমিটার। অতএব বছরে আড়াই কোটি ঘনমিটার পলিমাটি নদীবক্ষেই জমা হচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশে ব্যাপক ভিত্তিক নদী খনন একটি স্থায়ী এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের নদীগুলো বছরে কোটি কোটি টন পলিমাটি ধারণ করে নাব্য হারালেও সরকার বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের যেন এ সম্পর্কে কোন ভ্রক্ষেপ নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে নাব্য ধরে রাখতে কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং-এর মত প্রকল্প গ্রহনের পর দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়ন না হওয়া রহস্যজনক। একইভাবে বুড়িগঙ্গার দুূষণ রোধ এবং নদীতলদেশে জমে ওঠা আবর্জনা অপসারণ ও নাব্য বৃদ্ধি কল্পে সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহন করলেও বাস্তব ফলাফল খুবই সামান্য। বিশেষত: জরুরী ড্রেজিং কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রেজার সংগ্রহ করতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নদনদীগুলোর নাব্য পুনরুদ্ধারে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর পরিকল্পনা গ্রহন করেছিল ২০১০ সালে। নদী খনন প্রকল্পের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ২১টি ড্রেজার, ৯টি টাগ বোট, দুইটি ইনস্পেকশন বোটসহ প্রয়োজনীয় ড্রেজিং যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ১৩০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২ বছরের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। প্রকল্পের এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য বেঁেধ দেয়া সময় সীমা পেরিয়ে আরো ৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও এই ৭ বছরে পাউবো মাত্র ৫টি ড্রেজার সংগ্রহ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। সংগৃহিত ড্রেজার নিয়েও নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান ড্রেজিং প্রকল্পগুলোও চলছে অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিতভাবে। ড্রেজিং করার পর উত্তোলিত পলি সংরক্ষণের কোন সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকায় তা আবারো নদীতেই চলে যাচ্ছে। অথচ দেশের ভ’মি উন্নয়ন, উপকুলীয় বেড়িবাধ নির্মান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তা নির্মানে ড্রেজিং করা পলিমাটি ব্যবহারে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। এমনকি সমুদ্রোপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলের উন্নয়নেও ড্রেজিং করা পলিমাটি বড় ধরনের ভ’মিকা রাখতে পারে। পলিমাটির ব্যবহার যেভাবেই হোক, নদী খনন, নদী শাসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি ও ব্যর্থতার কারণে বহুবিধ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ, অক্ষম ও ব্যর্থ কর্মকর্তাদের অপসারণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন