Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়ঙ্কর অপরাধী সোর্স

নিরীহ মানুষকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত

| প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : রাজধানীর কোতোয়ালী থানা এলাকার ঘটনা। তাঁতীবাজার মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছিলেন এক এসআই ও তার সাথে থাকা পুলিশ সদস্যরা। একজন মোটরসাইকেল নিয়ে চেকপোস্ট পার হলেন। গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম। দুই কাঁধে এসআই মর্যাদার বেজ। কোমরে রিভলবার। বুকে নেমপ্লেটে লেখা ‘হাবিব’। মোটরসাইকেলের পেছনে সাদা পোশাকে একজন বসা। তার হাতে পুলিশের লাঠি। চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় ডিউটিরত কনস্টেবল ওই এসআইকে সালামও দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়্যারলেসে বার্তা। “হাজারীবাগ থানা এলাকায় পুলিশের বেশে একজন মোটরসাইকেল ছিনতাই করেছে। তাকে গ্রেফতারে এলার্ট থাকুন সবাই।” ওই এসআই অনুমান করলেন এই সেই ছিনতাইকারী। চেকপোস্ট থেকে মোটরসাইকেলে পিছু নিলেন তিনি। কিছুদুর গিয়ে যখন মোরসাইকেল আরোহীকে চ্যালেঞ্জ করলেন তখন সে নিজেকে পুলিশের এসআই বলে দাবি করে। পারেনি শুধু আইডি কার্ড দেখাতে। এই নকল এসআইয়ের আসল নাম রাজা। একসময় গোয়েন্দা পুলিশের সোর্স ছিল। পোশাক-আশাক, ভাব-ভঙ্গি দেখে কারও বোঝার উপায় নেই যে, সে নকল পুলিশ। বুঝতে পারেননি মোটরসাইকেলের মালিক একটি বেসরকারি কলেজের ছাত্রও। পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার কাছে থেকে মোটরসাইকেলটি কৌশলে ছিনিয়ে নেয় রাজা। পুলিশ জানায়, সোর্স রাজা বিভিন্ন নামে পুলিশ সেজে আগেও চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ একাধিক অপরাধ করেছে।
যাত্রাবাড়ীর সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে ইয়াবাসহ আটক করা হয় কলেজ পড়–য়া এক ছাত্রকে। উদ্বিগ্ন হয়ে থানায় ছুটে যান ওই ছাত্রের অভিভাবক। ৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক ওই ছাত্রকে কোনোভাবেই ছাড়তে চায় না পুলিশ। এক পর্যায়ে তার অভিভাবকের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। ছাত্রটি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জানায়, পুলিশের সাথে থাকা সোর্স ডেঙ্গু রতন তার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়েছে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মালিক সমিতির এক নেতার ভাতিজা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রক্ষা মেলে ছাত্রটির।
কদমতলীর ধোলাইপাড় এলাকার আব্দুল্লাহ ফিলিং স্টেশনে ফার্নিচার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে সোর্স আল আমীন। কিন্তু উপস্থিত লোকজন পুলিশের সামনে সোর্সের কারসাজি ধরে ফেলে প্রতিবাদ জানায়। জনতার প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পান ওই ব্যবসায়ী।
রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় সোর্স নামধারীরা বড়ই ভয়ঙ্কর। সাধারণ মানুষ এদেরকে দেখলেই আঁতকে ওঠে। এরা সাধারণত পুলিশের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায়। আবার কখনও কখনও নিজেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সাজে। এরা কখনও একা, কখনও সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাই, অপহরণ, খুন, গুমসহ নানা অপরাধ করে। এর বাইরে অধিকাংশ সোর্সই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তথ্য গোপন করার নামে এরা মাদক ব্যবসায়ীসহ দাগী অপরাধীদের সাথে আঁতাতও করে। জানা গেছে, শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘সোর্স’। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাকরিচ্যুত সেনা, পুলিশ, র‌্যাব সদস্যদের নিয়ে সোর্সদের একাধিক চক্র আছে। কথাবার্তা, চলন-বলনে তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মতোই স্মার্ট। কোনো গাড়ি বা ব্যক্তিকে থামাতেই তাদের হাতের ওয়াকিটকি ও হ্যান্ডকাফ দেখেই ঘাবড়ে যান টার্গেট করা মানুষ। এরপর মিথ্যা অভিযোগে তল্লাশি এমনকি থানায় বা ডিবি ও র‌্যাব অফিসে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে আদায় করে মোটা অংকের টাকা।
ভুক্তভোগি কয়েকজনের সাথে কথা বলে এরকম বেশ কিছু ঘটনা জানা গেছে। জুরাইন এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, মাঝে মধ্যেই মুরাদপুরে পুলিশের গাড়িতে এরে এসে সোর্সরা রাস্তার উপর বøক রেইড দেয়া শুরু করে। সে সময় যাকে পায় তার শরীর তল্লাশি করে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখে। মানুষজন তখন যে কতো অসহায়, বিশেষ করে সোর্স পকেটে কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয় কি না সে আশঙ্কায় মানুষ তটস্থ থাকে। শনিরআখড়া বাজারের এক দোকানদার জানান, কয়েক দিন আগেও আরএস টাওয়ারের কাছে সোর্স এক তরুণকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়। অথচ ওই ঘটনার কয়েক মিনিট আগে সোর্সসহ দুজন পুলিশ পাশ্ববর্তী একটা ওষুধের দোকান থেকে ইয়াবাসদৃশ্য কয়েকটা ট্যাবলেট কিনতে দেখেছেন কয়েকজন। সেই ট্যাবলেটকেই ইয়াবা বলে নিরহীহ তরুণকে ফাঁসানো হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। গত সপ্তাহে দনিয়া পোস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে দেখা গেছে ওই এলাকার সোর্স মুন্নাকে। তাকে দেখে অনেকেই আতঙ্কিত। ভুক্তভোগি একজন বলেন, এই মুন্না দোলাইরপাড় ডিপটির গলিতে নিজেই ইয়াবার ব্যবসা করে। তার সাথে আছে খোকন ও শাকিল নামে আরও দুজন। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে মুন্না ইয়াবা নিয়ে পুলিশের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। কদমতলী থানা এলাকায় এরকম আরও বেশ কয়েকজন সোর্স আছে। এর মধ্যে আল আমীন, কামাল, আনু, আকবর, দেলোয়ার, টাইগার, পিস্তল কামাল, শাহীনের নাম অনেকেরই জানা। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় আছে ডেঙ্গু রতন, লালন, হায়দার, লেলিন, দেলোয়ার, হানিফ, টেম্পু শাজাহান, সোহেল, টিপু, কালা শাহীন, টাক শাহ আলম, আলতাফ, নুর ইসলামসহ আরও কয়েকজন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব সোর্সদের বেশিরভাগই মাদক ব্যবসা করে। পুলিশের সাথে থাকে (ওদের ভাষায় ডিউটি করে) বলে এদের বাধা দেয়ার সাহস কেউ করে না। বাধা দিতে গেলে উল্টো পুলিশের রোষানলে পড়তে হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, সোর্সদের বিরুদ্ধে কিছু বলার খেসারত দিতে গিয়ে তার পরিচিত একজন এলাকাছাড়া হয়েছে। অনুসন্ধানে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার বেশ কয়েকজন সোর্সের নাম জানা গেছে। যারা পুলিশের নাম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা, মাদক দিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়াসহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। এরা হলো, আলমগীর হোসেন সাজু, কাইয়ুম, সেলিম, শহীদুল, জাকারিয়া, বিপ্লব, হান্নান, বাদল, লিটন, মোস্তফা, নুর ইসলাম, মেহেদী হাসান, সোহেল, রিয়াজ ফকির, আরিফুজ্জামান, সেলিম, আকতার হোসেন, সুমন, সজল হাওলাদার, নান্নু মিয়া, সোহেল রানা, আরিফ হোসেন, সাইফুল ইসলাম, রতন হাওলাদার, মজিবুর রহমান, রাকিবুল হাসান তপু, মোহাম্মদ আলী, রিপন, আবুল খায়ের, মনির, অনিক, ইকবাল, রুবেল, সুমন, মেহেদী হাসান, কবির, তোফাজ্জল, কালিপদ, নজরুল, জাকির হোসেন সুমন, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে রনি, আলামিন, ইকবাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, সিরাজ হাওলাদার, আবুল হোসেন, শাহাবুদ্দিন, ফরহাদ গাজী, আবদুস সামাদ, তারা মিয়া, আরিফ, হুমায়ুন কবির, রাসেল, সোহেল রানা, কামাল পারভেজ, মুন্না, করিম, রুবেল, রবিউল ইসলাম, আবদুর রহমান মুন্সি, ফাহিম ওরফে আলামিন, ইউসুফ হাওলাদার, সাব্বির মোহন, জাহাঙ্গীর আলম, সিরাজুল ইসলাম, সাইদুর রহমান শিমুল, বজলুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম জিন্নাত ও আবদুর রাজ্জাক। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এদের সহযোগি শতাধিক সদস্য রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় তৎপর রয়েছে। এরা র‌্যাব, ডিবি এমনকি পুলিশ পরিচয়ে অপরাধ সংগঠনের সময় একাধিকবার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সোর্স

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ