Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণপরিবহনে নৈরাজ্য

| প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীর গণপরিবহনে বিরাজ করছে সীমাহীন নৈরাজ্য। সিটিং, গেইটলক, বিরতিবিহীন সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছামত ভাড়া আদায় চলছে সমানে। গণপরিবহনে শৃংখলা বিধানের জন্য গৃহীত উদ্যোগ এক শ্রেণীর মালিকের কারসাজিতে নস্যাৎ হয়ে গেছে। বিআরটিএ’র তরফে মোবাইল কোর্টের অভিযান শুরু হলে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে কৃত্রিম বাস-মিনিবাস সংকট সৃষ্টি করা হয়। এতে যাত্রীসাধারণ চরম দুর্ভোগে পড়ে। বিআরটিএ তার অবস্থান থেকে সরে আসে। সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। এই সঙ্গে গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ এবং সিটিং সার্ভিসে শৃংখলা আনতে ৮ সদস্যের একট্ িকমিটি গঠন ক’রে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলে। কমিটি এখনো তার রির্পোট দিতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফায় সিটিং সার্ভিসের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ঈদুল আজহার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। গত জুনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি রাজধানীর সিটিং সার্ভিস বিষয়ে যে নিরীক্ষা চালিয়েছে তাতে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ গাড়ি চলাচল করছে সিটিং সার্ভিসের লোগো লাগিয়ে। এগুলোতে আদায় করা হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, নর্দা থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। যাত্রীদের ভাড়া দিতে হচ্ছে ২৫ টাকা। মিরপুরের কালশীর ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার পর্যন্ত দূরত্ব ১ কিলোমিটার। বিআরটি এর হিসাব অনুযায়ী ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। যাত্রীদের দিতে হচ্ছে ২৫ টাকা। মিরপুর ১ নম্বর থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১৫ টাকা। বাংলা কলেজ থেকেও একই ভাড়া দিতে হচ্ছে। কল্যাণপুর টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বরে ভাড়া ১০ টাকা। মিরপুর ১২ নম্বর পর্যন্তও একই ভাড়া। মালিবাগ আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অথচ ভাড়া বড়জোর ১০ টাকা হওয়ার কথা। এভাবেই সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। যাত্রীরা অসহায়, তাদের সংঘশক্তি নেই, তাই করারও কিছু নেই।

বর্তমানে ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। বিআরটি, এর তথ্যমতে, ১১৬ দশমিক ৮ বর্গমাইল আয়তনের এই শহরে ১২২টি রুটে চলাচল করে প্রায় ৫ হাজার বাস-মিনিবাস। জনসংখ্যার তুলনায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা এত কম হওয়ায় যাত্রীসাধারণের যাতায়াতে অপরিসীম ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাস-মিনিবাসগুলোর অধিকাংশের অবস্থা ভালো হয়। বয়সসীমা অনেক আগে পার হয়ে যাওয়া বাস-মিনিবাসও দিব্যি চলাচল করছে। চলাচলযোগ্যতা হারানো বাস-মিনিবাস নানা বিড়ম্বনার কারণই নয়, মাঝে মধ্যেই এগুলো দুর্ঘটনাও ঘটিয়ে থাকে। পুরানো বাস-মিনিবাসের বিরুদ্ধে অতীতে অভিযান চালানো হয়েছে। ফল পাওয়া যায়নি। অভিযানের সময় এগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরে রংচং দিয়ে আবার রাস্তায় নামানো হয়েছে। ক’দিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, হিউম্যান হলারের আকৃতি সম্প্রসারণ করে মিনিবাস জানানো হয়েছে এবং সেই মিনিবাসও এই শহরে চলছে। হিউম্যান হলার বড়জোর ২৫ জন যাত্রী বহন করতে পারে। হিউম্যান হলার থেকে রূপান্তরিত মিনিবাসে ৪০-৪৫ জন যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। অথচ দেখার কেউ নেই। বলা যায়, বিভিন্ন রকম ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের এই শহরে চলাচল করতে হচ্ছে। গণপরিবহন হিসাবে ট্যাক্সি ক্যাব ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। জানা যায়, এত বড় শহরে ট্যাক্সি ক্যাবের সংখ্যা মাত্র সাড়ে ৪শ’ এবং অনুমোদিত অটোরিকশার সংখ্যা সাড়ে ১১ হাজারের মতো। এদের ভাড়ারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ট্যাক্সি ক্যাব ও অটোরিকশা মিটার চলার কথা। কিন্তু মিটারে চলেনা। চালকরা ইচ্ছামত ভাড়া দাবি করে এবং দায়গ্রস্ত যাত্রীদের সেই দাবি মিটিয়েই যাতায়াত করতে হয়। ঢাকাকে বলা হয় রিকশার শহর। এই শহরে বৈধভাবে কত কিরশা চলে আর কত চলে অবৈধভাবে, কেউ চলতে পারে না। রিকশাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের চলাচলের বাহন হিসাবে গণ্য করা হয়। সেই রিকশার ভাড়াও আকাশ-ছোঁয়া। ৩০-৪০ টাকার কমে রিকশায় কোথাও যাওয়া যায় না। মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করবে, তারও উপায় নেই। রাস্তা-ফুটপাত নির্বিচারে দখল হয়ে যাওয়ায় ফুটপাত বা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এরকম নানা বিশংখলা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে রাজধানীবাসী দিশাহারা।
গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নানা উদ্যোগ-পদক্ষেপের কথা আমরা শুনেছি; তা কার্যকর হতে দেখিনি। ছোট ছোট যানবাহন সরিয়ে বড় বড় যানবাহন আনা হবে, রিকশা কমানো হবে, ক্যাব-অটোরিকশা বাড়ানো হবে, প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা সীমিত করা হবে ইত্যাদি অনেক কিছুই বলা হয়েছে। এসব কথা এখনো কথার কথা হয়ে আছে। বিআরটিসি’র সার্ভিস একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে পড়েছে। এর বাসগুলোর একাংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। নামকাওয়াস্তে কিছু বাস বিভিন্ন রুটে চলছে। আর বিপুলসংখ্যক বাস যান্ত্রিক ত্রুটির নামে ডিপোতে ফেলে রাখা হয়েছে। বিআরটিসি গণপরিবহনে যে বড় রকমের ভূমিকা পালন করতে পারতো, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সেটা করতে পারছে না। এখানেও কোনো জবাবদিহিতা নেই। গণপরিবহনের স্বল্পতা, ভাড়া নৈরাজ্য প্রভৃতি কারণে নগরবাসীর নাকাল অবস্থার কবে অবসান ঘটবে, কেউ বলতে পারে না। বিআরটিএ’র উদ্যোগে যে কমিটি গঠিত হয়েছে সেই কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে, সিটিং সার্ভিস ও নন সিটিং সার্ভিসের গাড়ির রং আলাদা করতে হবে, সিটিং সার্ভিসের ভাড়া ও রুট নির্ধারণ করে দিতে হবে, গণপরিবহনের মালিকনা কমিয়ে চার-পাঁচটি কোম্পানী করতে হবে, সিটিং সার্ভিসের স্টপেজ আলাদা করতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগাতে হবে ইত্যাদি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে গণপরিবহন ব্যবস্থায় কতটা শৃংখলা ফিরে আসবে, যাত্রী সাধারণ কতটা সুবিধা পাবে এবং তাদের যাতায়াত কতটা মসৃন হবে, আমরা জানিনা। তবে কাজটি শুরু করতে হবে কোথাও না কোথাও থেকে। বিশ্বের অন্যান্য রাজধানী শহরের উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার আদলে এখানে যথোচিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি মহাপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সমন্বয়। এ ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমরা কামনা করি। রাজধানীতে বাস্তবোচিত ও সুশৃংখল পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া নাগরিকদের যাতায়াত দুর্ভোগ মোচনের কোনো উপায় নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন