Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তুফান-মতিনের উত্থান যেভাবে...

| প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তুফানের ফাঁসির দাবিতে বগুড়ায় ঝাড়– মিছিল : সর্বদলীয় ব্যবসার বিস্ময়কর উত্থান : বাপুজী ও ভাইজানের আকস্মিক পতন : দিনভর মতিনের গ্রেফতারের গুজব
মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে : বগুড়ায় তরুণী সোনালী আক্তার ধর্ষণ ও মা মেয়েকে শারীরীক নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ, সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে তুফান মতিন গংদের বিস্ময়কর উত্থানের ভয়ংকর কাহিনী। বলাবলি হচ্ছে তাদের আকস্মিক পতন নিয়েও। সবাই চাচ্ছে শুধু তুফান / মতিন নয় বগুড়ার অপরাধ জগতের নেপথ্য গড ফাদারদের ধরেও বিচার করা হোক ! তাদেরও সরকারি দল থেকে বহিষ্কার করা হোক।
এদিকে অন্যান্য দিনের মতো গতকাল ববহিষ্কৃত শ্রমিকলীগ নেতা ধর্ষক তুফান সরকারের ফাঁসির দাবিতে ঝাড়– মিছিল করেছে বগুড়া মহিলা দল। বেলা ১টায় তুফান সরকারের ফাঁসির দাবিতে ঝাড়– হাতে মহিলাদলের কর্মীরা মিছিল নিয়ে বগুড়া জেলা বিএনপি অফিস থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র সাত মাথার দিকে অগ্রসর হলে নবাব বাড়ি মোড়ে পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করে। অনুমতি ছাড়া কেন মিছিল বের করা হল জানতে চেয়ে পুলিশ বাধা দিলে মিছিলটি সেখানেই শেষ হয়। এসময় মিছিরকারী মহিলা দল কর্মীদের সাথে হাতাহাতি হয়েছে পুলিশের। মহিলা দলের মিছিলে পুলিশ বাধা দিলেও অন্যান্য সংগঠনের কর্মসুচিতে বাধা দেয়নি পুলিশ। তাই একই দিনে বগুড়া শহরের সাতমাথায় নারী মুক্তি কেন্দ্র বগুড়া জেলা কমিটির উদ্যোগে বগুড়াতে মা- মেয়েকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় ধর্ষক তুফান সরকার, কাউন্সিলর রুমকি সহ নির্যাতন কারীদের দৃষ্টান্ত মুলক শান্তির দাবীতে মানববন্ধন কর্মসুচী পালন করে। উক্ত মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন উপস্থিত ছিলেন নারী মুক্তি সংসদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড সালেহা সুলতানা, সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পাটি বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক,সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ। একই স্থানে জাসদ ( রব ) সহ অন্য কয়েকটি সংগঠনও বিনা বাধায় তাদের কর্মসুচি পালন করেছে।
বগুড়ার আব্বাজান বাপুজী ও ভাইজান
সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় এবং বিরোধীদলের সাথে সু-সম্পর্ক রেখে পরিবহন সেক্টর করায়ত্ব করে মতিন ও তুফান সরকার ভ্রাতৃদ্বয় অল্পদিনেই বগুড়ায় জিরো থেকে হিরোতে পরিণ হন। শুরুতে মতিন সরকার যুবলীগের প্রাক্তন সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মোহনের বিশ্বস্ত ক্যাডার হিসেবে নিজেও অল্পদিনের মধ্যেই নেতৃত্ব গুনে হোমরা / চোমরা হয়েওঠে। ঘনিষ্টতা বাড়ে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের একছত্র অধিপতি পৌর কাউন্সিলর সামসুদ্দিন শেখ হেলালের সাথে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চোরাচালান / মাদক ব্যবসার কর্তৃত্ব ক্রমশ মতিন গংদের হাতে চলে যায়। আর্থিক সক্ষমতা বাড়তে থাকায় পৈতৃক পেশা গরুর মাংস ও চামড়া ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব নিতে বিএনপি নেতা ও কোটিপতি ব্যবসায়ী মোঃ শোকরানার সাথে আপোষ করে তাকে সভাপতি রেখে নিজে সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। এছাড়া পুরো চামড়া ব্যবসার সিন্ডিকেড নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরো কমিটিতে নিজের পছন্দের লোকদের বসিয়ে দেয় মতিন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পুণঃপ্রাপ্ত হলে অর্থে বিত্তে¡ ফুলে ফেঁপে মতিন কলাগাছ থেকে বটগাছে পরিণত হয়। এই সময় বগুড়ার জামায়াত পল্লী খ্যাত জামিল নগর এলাকার জামায়াতি ভুমিদস্যু চক্রের হোতারা নিজেদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে হেলাল, মতিন ও তাদের আরেক পার্টনার আব্দুল মান্নানের (ফেম মান্নান) সাথে যৌথ ব্যবসা শুরু করে। ফলে বিএনপি জামায়াত ও আওয়ামী ব্যবসায়ী চক্রের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে রাতারাতি এত অগাধ অর্থ বিত্তে¡র অধিকারী হয়ে ওঠে মতিন।
এদিকে একাধিক হত্যা, হত্যা চেষ্টা, অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামী হিসেবে পুলিশী হয়রানী থেকে বাঁচতে অবশেষে নিজের গুরুকে ত্যাগ করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পক্ষপুটে চলে যায় মতিন। মাঝে একবার র‌্যাবের এএসপি সুমিত চৌধুরী মতিনকে আটক করলে মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সামস উদ্দিন শেখ হেলাল তার পক্ষে শ্রমিকদের রাজপথে নামিয়ে চরম বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরী করে। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সুমিত চৌধুরীকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বগুড়া থেকে অনত্র বদলি করা হয়। মতিনকে নিয়ে আন্দোলনের এই সফলতা শ্রমিকদের জাতীয় নেতাদের কাছে সামস উদ্দিন শেখ হেলালের গুরুত্ব বেড়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই ট্রাক মালিক সমিতিও দখলে চলে যায় মতিনের।
এরপর হিন্দি ফিল্মের কায়দায় বগুড়ায় শ্রমিক নেতা ও পৌর কাউন্সিলর হেলালকে মতিন আব্বাজান বলে ডাকলে ক্রমে সবার কাছেই হেলাল হয়ে ওঠেন ‘‘আব্বাজান ”। কিছুদিন পর মতিন নিজের লোকদের কাছে পরিচিত হয়ে ্ওঠেন ‘‘বাপজী ’’বলে। আর মতিনের ছোট ভাই তুফান নিজেই নিজেকে ‘‘ ভাইজান ’’ বানিয়ে একশ’ মটর বাইকের ক্যাডার গড়ে তুলে বগুড়ায় গড়ে তোলে তুফানী রাজত্ব।
তবে অপ্রতিরোধ্য পাপে সোনালীর মতো অনিন্দ্য সুন্দরী তরুনীকে বøাক মেইলকরে ধর্ষণের তার স্ত্রী আশামনি স্ত্রীর বোন পৌর কাউন্সিলর রুমকি ও রুমকির মা রুমি খাতুনের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশের তরিৎ পদক্ষেপ আর মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব। রাতারাতি ধ্বসে পড়েছে তুফানদের তুফানী রাজত্ব। যে গড ফাদার তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে, যারা টাকা খেয়েছে, যেখানেই তুফানরা গিয়েছে রাজার মতো সম্মান পেয়েছে। কিন্তু তুফান যখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, উকিলদের উদ্দেশ্যে বলেছে কত টাকা লাগবে নাও ... কিন্তু লোকলজ্জার ভয় বা বিবেকের দংশনে কোন উকিল তাদের পক্ষে দাঁড়াইনি। যে দল তাদের ক্ষমতার উৎস, সেই দল বগুড়ার বাপুজি ও ভাইজান খ্যাত মতিন / তুফানকে দ্রুত বহিষ্কার করেছে।
যাতে খুশি হয়েছে বগুড়ার মানুষ। তবে সবার বক্তব্য, শুধু মতিন তুফান নয় বগুড়ার অপরাধ জগতের সব গডফাদারেরই মুখোশ খুলে দিয়ে সরকারি দল থেকে তাদের বহিষ্কার করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হোক।
দিন ভর মতিনের গ্রেফতারের গুজব ঃ
জাতীয় শোকদিবসের কর্মসুচির প্রথমদিনের শোক মিছিলে মতিনের অনুগত বিপুল সংখ্যক লোক অংশগ্রহনের পর গত মঙ্গলবার রাতে যখন তাকে যুবলীগের বহিষ্কারের সংবাদ প্রচারিত হল তখন থেকেই মতিনের আখড়া লোক শুণ্য হয়ে পড়ে। রাতেই বগুড়ার সর্বত্র গুজব রটে যায় গ্রেফতার হয়েছে মতিন। গতকাল দিনভরও একই গুজব চলতে থাকে। এবার শোনা যায়, হিলিতে নাকি গ্রেফতার হয়েছে মতিন !
ফের দুদিনের রিমান্ডে তুফান ঃ
আদালত সূত্রে জানা যায়, জবানবন্দি দিতে রাজী না হওয়ায় গতকাল পুলিশ গ্রেফতারকৃত তুফান, তার স্ত্রী আশামনি, শাশুড়ি রুমি, সহযোগি দীপুকে আদালতে হাজির করে ৭দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত তুফান, দীপুর ২দিন, অন্যান্যদের ৪দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। অপরদিকে যে নাপিতকে দিয়ে ধর্ষিতা তরুণী ও তার মায়ের চুল কাটা হয়েছে সেই নাপিত জীবন রবিদাস গটনার বর্ননা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ