Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনে আবারো প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন শি জিনপিং সামরিক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ়

| প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টাইমস অব ইন্ডিয়া : চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আসন্ন নেতৃত্ব নির্বাচনে ক্ষমতায় তার নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করতে রবিবার এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ্য প্রচারণার উদ্বোধন করেন। তার বক্তৃতা ও প্রচারণার সাথে রয়েছে গত সপ্তাহে এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বহিষ্কার যার উদ্দেশ্য গত দু’দশকে চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হিসেবে তাকে সমর্থন করার জন্য কর্মকর্তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি।
পিপলস লিবারেশন আর্মির কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ঘন সবুজ রঙের ইউনিফর্ম পরিহিত শি ১২ হাজার সৈন্যের কুচকাওয়াজ এবং ট্যাংক, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক ও অন্যান্য অস্ত্রের প্রদর্শনী ও জঙ্গি বিমানের উড়াল দেখেন।
মাও সে তুং বলেছিলেন, বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। শি ইঙ্গিত দেন যে শরতে কম্যুনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে তিনি যখন নতুন নেতৃত্ব বিন্যাস করবেন তখন সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ আনুগত্যের আশা করবেন।
বেইজিং থেকে ২৭০ মাইল উত্তরপশ্চিমে ইনার মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে এক ধূলি ধূসরিত প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে শি বলেন, সমগ্র সামরিক বাহিনীর সৈন্যগণ! সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র পার্টি নেতৃত্বের কঠোর নীতি সমুন্নত রাখতে আপনাদের অবশ্যই অবিচল থাকতে হবে। তিনি বলেন, সব সময় পার্টিকে মেনে চলুন। পার্টি যেখানে বলে সেখানে যান ও যুদ্ধ করুন।
সরকারীভাবে এ প্রদর্শনী হচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ-র ৯০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন। কিন্তু একই সাথে তা হচ্ছে এক রাজনৈতিক নাট্য সপ্তাহ যা অনন্য রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শি’র উত্থানকে তুলে ধরেছে। গত বছর কর্মকর্তাগণ কতৃৃক চীনের মূল নেতা হিসেবে তার উন্নয়নের অনুমোদন পার্টি কংগ্রেসে অনুমোদিত হতে হবে।
চলতি বিষয় নিয়ে ভাষ্য রচনাকারী বেইজিংয়ে পার্টির সংবাদপত্রের সাবেক সম্পাদক দেং ইউয়েন বলেন, এ সামরিক কুচকাওয়াজ এক নিয়মিত, প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় হতে পারে, তবে এ বছর এর বিশেষ অর্থ রয়েছে। এর অর্থ এই যে সামরিক বাহিনীর উপর শি জিনপিংয়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আছে এবং কারোরই তাকে চ্যালেঞ্জের দুঃসাহস থাকা উচিত নয়।
কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিতভাবেই ৬৪ বছর বয়স্ক শি’কে পাঁচ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় দফায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণকারী কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করবে। তার অধীনে কাজ করার জন্য নতুন দল নিয়োগ করা হবে।
কংগ্রেসের জন্য কোনো তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। আগামী বছরের গোড়ার দিকে আইন পরিষদের বার্ষিক বৈঠকে শি’কে আরো পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নিয়োগ এক রকম নিশ্চিত।
কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা যে এ সব মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও শি ক্ষমতায় থাকতে চাইতে পারেন যদিও সংবিধান বলছে তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। তবে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের জন্য সর্বোচ্চ মেয়াদের ব্যাপারে কঠোর কোনো নিয়ম-কানুন নেই।
লাইনের বাইরে থাকা কর্মকর্তাদের প্রতি পরিষ্কার হুঁশিয়ারিসহ শি ঐক্যের দাবি জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি কংগ্রেসে পদোন্নতির এক সময়কার প্রতিদ্ব›দ্বী সুন জেনকাই-এর আকস্মিক বহিষ্কার দেখেছেন। মধ্য জুলাইতে বহিষ্কার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ৫৩ বছর বয়স্ক সুন দক্ষিণপশ্চিম চীনের চংকিং শহরের পার্টি সম্পাদক।
পার্টি ২৪ জুলাই ঘোষণা করে যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সাধারণত দুর্নীতি বোঝাতেই শৃঙ্খলা শব্দটি বলা হয়। সুনকে তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় মিডিয়া কাঠের শাস্তি কাঠামোতে (পিলোরি) চড়িয়ে দেয়। পদোন্নতি লোলুপ অনেকেসহ প্রাদেশিক নেতারা সভা ডেকে বাঘ বা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা হিসেবে সুনের নিন্দা করেন।
হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিং জুয়েলিয়ান বলেন, এ পর্যায়ে আমরা নিশ্চিত নই যে পার্টি কংগ্রেস শুরু হওয়ার আগে তিনিই টেনে নামানো সর্বশেষ বড় কর্মকর্তা। আমরা জানি না, অন্য নেতারাও জানেন না।
এ মুহূর্তে শি তার দ্বিতীয় মেয়াদে তরুণ অনুগতদেরসহ নতুন পঙ্ক্তি বিন্যাস নিশ্চিত করতে চাইছেন বলে মনে হয় যারা আগামীতে তার ও তার নীতিকে সমর্থন করবেন। কয়েকজন পলিটব্যুরোতে যোগ দেবেন। ২৫ জন ঊর্ধতন কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও সামরিক নেতাকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত। পলিটব্যুরো স্থায়ী কমিটির ৫ জন সদস্যসহ পলিটব্যুরোর ১১জন কর্মকর্তা কংগ্রেসে অবসর নিতে পারেন। স্থায়ী কমিটি ৭ সদস্য বিশিষ্ট অধিকতর শক্তিশালী অঙ্গ।
নতুন পঙ্ক্তি বিন্যাসের আলোচনা হয়েছে গোপনে। কিন্তু প্রচারণা ও হুঁশিয়ারির উদ্দেশ্য ছিল শি কাদের রাখবেন ও কাদের পদত্যাগ করতে হবে তার সে ইচ্ছানুযায়ী চলার জন্য কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি।
বহু পর্যবেক্ষকের ধারণা যে দেং জিয়াওপিংয়ের পর শি চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নেতা। দেং ১৯৯৭ সালে মারা যান। দিং বলেন, চীনের সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে সরাসরি বেশী কিছু বলার না থাকলেও শি’র দীর্ঘায়িত কর্তৃত্বের জন্য তাদের সমর্থন অত্যাবশ্যক।
দিং টেলিফোনে বলেন, শি অন্য যে কোনো নেতার চেয়ে সামরিক বাহিনী বিষয়ে বেশী সময় কাটিয়েছেন। তিনি এটা পরিষ্কার জানেন যে যদি তাকে ক্ষমতায় থাকতে হয়, যদি তিনি ক্ষমতা আরো বেশী সুসংহত করতে চান তবে সেনাবাহিনীকে তার পক্ষে রাখতে হবে।
জাতীয় নেতা হিসেবে শি’র সাম্প্রতিক পূর্বসূরী জিয়াং জেমিন হু জিনতাও জোর প্রচারণার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব লাভের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু শি’কে ঘিরে প্রশংসা প্রচন্ড রকম প্রশস্তিমূলক। শি ক্ষমতা লাভের বিষয়টিকে তাদের চেয়েও ব্যক্তিগত করে ফেলেছেন।
শুক্রবার ‘স্টাডি টাইমস’ নামক দলীয় একটি সংবাদপত্রে, যেটি কর্মকর্তারা ব্যাপক ভাবে পাঠ করেন, প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে প্রেসিডেন্ট শি’র প্রশংসা করে একটি প্রোফাইল ছাপা হয়। তাতে বলা হয় যে তিনি ‘লাল’ শিক্ষাদীক্ষার আশির্বাদপুষ্ট হয়ে বিশেষ সাহসী নেতা হিসেবে গড়ে ওঠেন। এতে মাও-এর দ্বারা নিপীড়নের শিকার বিপ্লবী যোদ্ধার পুত্র হিসেবে তার ব্যাপক পরিপক্কতার কথা স্মরণ করা হয়। ঐ নিপীড়ন ছিল কম্যুনিস্ট স্বার্থের জন্য তার পরিবারের আনুগত্যের পরীক্ষা। বলা হয়, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তিনি ধূলিধূসরিত-দারিদ্র্য কবলিত গ্রামীণ এলাকায় ৭ বছর কাজ করেছিলেন।
দলীয় সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইটগুলোতে ব্যাপকভাবে এ প্রোফাইল প্রচার করা হয় এবং এর অজ্ঞাতনামা লেখককে ‘বিশেষ ভাষ্যকার’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যেসব নিবন্ধ উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন পায় সাধারণত সে সবের ক্ষেত্রেই এ ধরনের আখ্যা দেয়া হয়।
সাবেক সম্পাদক ও স্টাডি টাইমসের কাজ করা ব্যক্তি দেং বলেন, জিয়াং জেমিন ও হু জিনতাও-এর জন্য আমি এ রকম কিছু দেখিনি। তারা এ রকম সমর্থন পাননি।
প্রোফাইলে তার বিপ্লবী পশ্চাৎপট ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলা হয়েছে, শি লাল ঘরানার ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠেন। তিনি কঠিন বিপর্যয় ও দুর্ভোগের শিকার হন এবং জটিল আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে নিজেকে ইস্পাত দৃঢ় করে তোলেন।
এতে চীনের প্রসঙ্গে বলা হয়, প্রাচ্যের সিংহ জেগে উঠেছে। কিন্তু সে বাঘ ও নেকড়েদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন এবং এমনকি বেশীমাত্রায় কৌশলগত বেষ্টন, সংঘর্ষ ও অনধিকার চর্চার শিকার।
প্রোফাইলে আরো বলা হয়, শি তার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ব্যক্তিগত ভাবে বিরোধিত দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ পূর্বক সামরিক স্থাপনা তৈরিসহ কঠিন ও বিতর্কিত নীতি পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেন।
এতে বলা হয়, তিনি ব্যক্তিগতভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ ও প্রবাল প্রাচীর সুসংহত করার সিদ্ধান্ত নেন। শি দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিরক্ষার লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় শক্তিশালী কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি এবং কার্যকর ভাবে সাগরে একটি গ্রেট ওয়াল নির্মাণ করেছেন।
শি’র ক্ষমতা ইতোমধ্যেই তার সমালোচকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছেন যার মধ্যে দলীয় লোকেরাও রয়েছেন। তাদের উদ্বেগের কারণ হল তিনি সমন্বিত নেতৃত্বের রীতিনীতি অস্থিতিশীল করে তুলেছেন যা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে মন্থর করতে পারে এবং কেউ বিপজ্জনক ভাবে টেক্কা দিতে চাইলে তাকেও প্রতিহত করবে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের চীনা নীতি বিষয়ক সাবেক উপ সহকারী মন্ত্রী সুসান এল. শার্ক কুচকাওয়াজের আগে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ক্ষমতার প্রতি এই অতিরিক্ত মাত্রায় কর্তৃত্ব আসলেই আপনাকে সমস্যায় ফেলে দিতে পারে, আমি বিশেষ করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির কথা ভাবছি।
এক নতুন নেতৃত্ব অনুমোদনের পাশাপাশি কংগ্রেস পেশ করা একটি রিপোর্টও অনুমোদন করবে। এই পার্টি দলিলের শুষ্ক ভাষ্যে শি’র পরবর্তী পাঁচ বছরের বিশদ লক্ষ্য ব্যক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সমাপ্ত দু’দিনের সভায় তিনি বলেন যে এ রিপোর্টটিতে চীনের আগামী কয়েক বছরকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে।
দলের সরকারী সংবাদপত্র পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, তিনি কর্মকর্তাদের বলেন, বিভিন্ন ঘটনা দেখুন যেগুলো আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ভালো ফলাফলের জন্য কাজ করুন, পাশাপাশি খারাপের জন্য প্রস্তুত হোন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিন।



 

Show all comments
  • মহিউদ্দিন ২ আগস্ট, ২০১৭, ১:২৭ এএম says : 0
    শি জিনপিং এর জন্য রইলো আগাম শুভেচ্ছা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ