Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

| প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এই কুরবানী কোথায় হয়েছিল: যরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোথায় কুরবানী করে ছিলেন? এ সম্পর্কে তৌরাতে উল্লেখ আছে যে, সে স্থানটির নাম ছিল ‘মুরাহ’বা ‘মূরিয়া’। কোন কোন তর্জমাকারী এই শব্দটির অর্থ করেছেন, উঁচু সমতল স্থান বা পাহাড়ী উপত্যকা। কিন্তু সূ²দর্শী তর্জমাকারীগণ সে শব্দটির কোন অর্থ ব্যবহার করেননি বরং তার আসল নামটিই বহাল রেখেছেন। বর্তমানে আমাদের সামনে তৌরাতের সেই আরবী অনুবাদটি রয়েছে, যা ইব্রানী, কিলদানী এবং ইউনানী ভাষা হতে ১৮৯০ খৃস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুদিত হয়ে ছাপা হয়েছে। এই অনুবাদে স্থানটির নাম লেখা আছে’ মুরিয়্যা’ বলে। আর এর ফার্সী তর্জমায় বাইবেল সোসাইটির পক্ষ হতে অনুদিত গ্রন্থে ১৮৮৫ সালে যা লÐনে ছাপা হয়েছে এবং এতে সে স্থানটির নাম মুরিয়া লেখা আছে। আসলে স্থানটির নাম হচ্ছে মারওয়া। যা মক্কার বাইতুল্লাহ শরীফের সংলগ্ন একটি পাহাড়ের নাম। ফার্সী অনুবাদে বলা হয়েছে, “আল্লাহ পাক ইব্রাীম (আ:)-কে পরীক্ষা করার মানসে বললেন, হে ইব্রাহীম! প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! বান্দাহ হাজির। আল্লাহ বললেন, তোমার একমাত্র প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসহাককে হাত ধরে চিহ্নিত পাহাড়ের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে কুরবানী কর। তাই পরদিন প্রত্যুষে ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় গাধার উপর আরোহণ করে এবং দু’জন চাকর ও প্রিয় পুত্র ইসহাককে নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে রওয়ানা হলেন।” (পয়দায়েশ : ২২)
উদ্ধৃতাংশের ‘ইসহাক’ নামটি হচ্ছে ইহুদীদের বানানো কথা ও সংযোজন। কেননা মূল তৌরাতে ইসহাক নামটি ছিল না। বরং এর স্থলে ‘ইসমাঈল’ নামটি লিখিত ছিল।
মুসলমান গবেষকগণ অকাট্য দলিল-প্রমাণসহ ইহুদীদের এই নাম পরিবর্তন ও সংযোজনকে তুলে ধরেছেন। আমরা সীরাতুন নবী গ্রন্থের প্রথম খÐে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছি। তাছাড়া প্রখ্যাত গবেষক মাওলানা হামিদ উদ্দীন সাহেব “আর রায়ুস সহীহ ফী মান হুয়াজ জবীহ” নামক গ্রন্থে প্রমাণাদিসহ ইহুদীদের এই পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়টি প্রমাণ করেছেন এবং নামটি যে ইসহাকের পরিবর্তে ইসমাঈল ছিল তা প্রতিপন্ন করেছেন। তাই এ ব্যাপারে বিশদ আর কোন আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না।
মোটকথা, মহান আল্লাহপাক হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে কুরবানী করার যে স্থানটির কথা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে স্থানটি ছিল মারওয়া। এই স্থানটি হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর নিবাস হতে কয়েক দিনের পথ দূরত্বে অবস্থিত ছিল।
পবিত্র মক্কা এবং কা’বা:
হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং হযরত মূসা (আ:)-এর শরীয়ত মোতাবেক এটা অত্যাবশ্যক ছিল যে, যে স্থানে কুরবানীর বস্তুু প্রদক্ষিণ করানো হবে, সেখানে কোনও কুরবানগাহও হতে হবে এবং বাইতুল্লাহও থাকতে হবে। বিশেষ করে এ জন্যও যে, যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং সিজদাহ করেছেন এবং কুরবানগাহ বা বাইতুল্লাহ যেন এমন মশহুর হয় যেন সাথের সহচরদেরকে বলা যায় যে, তোমরা এখানে অবস্থান কর, “আমি সেখানে ইবাদত করে ফিরে আসছি।” সুতরাং এই বৈশিষ্ট্যগুলো কা’বা শরীফ ভিন্ন অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এমনকি ইহুদী ও নাসারাগণও এর সমতুল্য কোন স্থান প্রমাণস্বরূপ পেশ করতে পারবে না। আর এই মহত্ত¡র ঘটনার কোনও স্মৃতিচিহ্ন হযরত ইসহাক (আ:)-এর বংশেও ছিল না। তাছাড়া বাইতুল মুকাদ্দাস অথবা ঈসা মসীহ (আ:)-এর সার্বিক কর্মকাÐে এই ঘটনার কোনও চিহ্ন বা সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং বর্তমানেও নেই।
পক্ষান্তরে বনু ইসমাঈল অর্থাৎ ইসমাঈলী আরবদের মাঝে এই কুরবানী এবং এর বেশিষ্ট্যাবলীর এক একটি স্মৃতিচিহ্ন হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত হয়ে চলছিল। যদিও এর মাঝে দীর্ঘকালের পরিক্রমায় এবং বিবর্তনের মাধ্যমে কোন প্রকার কম-বেশী বা পরবর্তীকালের গোমরাহীর জন্য এর মাঝে অংশীবাদীতার কোনও সংস্পর্শ সংযোজিত হয়ে পড়েছিল। তবুও এর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অটুট ছিল। আরবে মূর্তি পূজারী যেমন ছিল, তেমনি কাফির এবং মুশরিক ও তারকা পূজারীও ছিল। এমনকি খৃস্টান এবং ইহুদীও ছিল। কিন্তুু আরবের প্রাচীন কবিতার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের কাছে খানায়ে কা’বা এবং হজ্জের বিধি-নিষেধের গুরুত্ব সমভাবেই বিদ্যামান ছিল। শুধু তাই নয়, আরব খৃস্টানরাও এগুলোর শপথ বাণী উচ্চারণ করত। আর সম্ভবত : এ কারণেই খানায়ে কা’বাতে তৎকালে অংশীবাদীদের মূর্তির সারি বিদ্যমান ছিল এবং একই সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর এবং হযরত মরিয়ম (আ:)-এর মূর্তিও সংস্থাপিত হয়েছিল। (আখবারে মক্কা : আজরাকী; ফতহুল বারী, ইবনে হাজার; সীরাতে ইবনে হিশাম)
কা’বা হচ্ছে সেই মোকাম যা মুসলিম আরেফদের খেয়াল মোতাবেক আরশে ইলাহীর ছায়া এবং তাঁর রহমত ও বরকতের কেন্দ্রবিন্দু। সৃষ্টির প্রারম্ভ হতেই এ স্থানটি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। “প্রথম গৃহ যা আল্লাহর ইবাদত নিষ্পন্ন করার খাতিরে মানুষের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-১০)
মক্কা এবং কা’বার অধিষ্ঠান তাই ছিল। কিন্তুু হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পূর্বে পথভ্রষ্ট পৃথিবীর অধিবাসীরা তার কথা বিস্মৃত হয়ে এর নাম ও নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর দ্বারা আল্লাহপাক যখন এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর বুকে তাওহীদের সমুজ্জ্বল চেরাগ সমুন্নত করলেন, তখন হুকুম দেয়া হলো যে, “কা’বা গৃহের চারটি দেয়াল উঁচু করে দুনিয়ার বুকে তাওহীদের ভিত্তি প্রস্তর পুনর্বান গ্রথিত করা হোক।” সুতরাং কুরআনুল কারীমের বর্ণনা মোতাবেক (সূরা হজ্জ ৩, ৪) কা’বা শরীফ হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর আমলেও ‘আল বাইতুল আতীক’ বা পুরাতন গৃহ হিসেবে পরিচিতি ছিল। এটা কোন নতুন গৃহ ছিল না। হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও হযরত ইসমাঈল (আ:) উভয়ে তপ্ত-তালাশ করে এর পুরাতন ভিত্তিমূল উদ্ধার করেন এবং এর চার দেয়াল নির্মাণ করেন। আল কুরআনের ঘোষণা : “ইব্রাহীম (আ:) যখন এই গৃহের ভিত্তি প্রস্তর সমুন্নত করে ছিলেন” দ্বারা বুঝা যায় যে, এই গৃহের স্থান পূর্ব হতেই নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং হযরত ইসমাঈল (আ:) সেই চিহ্নের ওপরই নতুন করে দেয়াল নির্মাণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) ইরাক, শাম, মিসর প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে পরিশেষে দীর্ঘকালের অজ্ঞাত স্থানটির সন্ধান লাভ করেন যা ঐশ্বর্যশীল রাজন্যবর্গ, মূীর্ত পূজারীদের আড্ডাখানা ও তারকা পূজারীদের সীমারেখা হতে বহু দূরে অবস্থিত চারদিকে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় অবস্থিত ছিল। আল কোআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “আমি ইব্রাহীম (আ:)-এর জন্য এই গৃহকে ঠিকানা নির্ধারণ করেছিলাম, যেন আমার সাথে কখনো অংশী স্থাপন করা না হয়।” (সূরা হজ্জ : রুকু-৪)
এ আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, এই পবিত্র গৃহের স্থানটি পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু কালের করালগ্রাসে এর দেয়ালগুলো ধসে পড়েছিল। আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে এর ঠিকানা সনাক্ত করে দিয়েছিলেন। যেন এ গৃহটি তাওহীদ পন্থীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে বরিত হয় এবং মূর্তি পূজারীদের হাত হতে নিরাপদ থেকে সত্য ধর্মের তাবলীগের কাজ সুচারুরূপে পরিচালিত করা সহজতর হয়।
তৌরাতের ভাষ্য হতেও জানা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর পূর্ব হতেই এই ইবাদতের স্থানটি মওজুদ ছিল। কেননা শামী পদ্ধতি মোতাবেক এটা আবশ্যকীয় ছিল যে, যে স্থানে আল্লাহর কুরবানী অথবা নজর অথবা ইবাদত করা হয়, এটা যেন, কোনও ইবাদতের স্থান বা কুরবানগাহ হয়।
এই নিরিখে সেই স্থান যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ:) হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে কুরবানী করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং যে সম্পর্কে তিনি স্বীয় খাদেমদের বলে ছিলেন যে, আমি সেখানে গমন করে ইবাদত সম্পন্ন করার পর ফিরে আসছিÑ সেখানে অবশ্যই ইবাদতগাহ থাকবে। এ জন্য কুরআনুল কারীমে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর প্রতি সে গৃহকে নতুন নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়নি বরং নতুন সংস্কার ও পবিত্রকরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “আমার গৃহকে ইবাদতগুজার বান্দাহদের জন্য পবিত্র করা।” আর তখনো পর্যন্ত সেই ভূখÐের জন্য আরব শব্দটিরও উৎপত্তি হয়েছিল না। কেননা ‘আরব’ শব্দটি সম্মিলিত তৌরাতের মাঝে হযরত সুলাইমান (আ:)-এর জামানায় পাওয়া যায়। এর পূর্বে এই স্থানটির নাম পূর্ব অথবা দক্ষিণ দেশ বলে অভিহিত ছিল। কেননা এই স্থানটি সিরিয়ার দক্ষিণে বা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। কখনো কখনো এর নাম ছিল ‘মরু এলাকা’ বা বিয়াবান।
পরিশেষে এই বিয়াবান এলাকাটির নাম ‘আরব’ রাখা হয়। মূল আরব শব্দটির অর্থ হচ্ছে বিয়াবান বা বিস্তৃত মাঠ (আরদুল কুরআন, ১ম খ:, ৫৭-৬০ পৃ: দৃষ্টব্য) এজন্য হযরত ইব্রাহীম (আ:) যখন বলেছিলেন, হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমি আমার কিছুসংখ্যক সন্তান-সন্ততিকে এমন এক ভূখÐে বসত করিয়েছি, যেখানে ক্ষেত-ফসল মোটেই নেই।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
মক্কা শব্দটি প্রাচীন ভাষাসমূহের বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবুলী অথবা কালদানী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে গৃহ বা আবাস। (তারীখুল আরব কাবলাল ইসলাম : জরজী যয়নুদ্দীন, ২৪৪ পৃ:)
এই বিশ্লেষণের দ্বারা দু’টি হাকীকত বেরিয়ে আসে : (১) এটা সুস্পষ্ট যে, এ স্থানটি ছিল বাবুল ওকালদান সম্প্রদায়ের কাফেলাসমূহের ভ্রমণ স্থল। এর দ্বারা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর সম্পর্কে একটি আভিধানিক সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) আর এই শহরের আবাদী সে গৃহটির অস্তিত্বের কারণেই হয়েছিল। এর দ্বারা এই খানায়ে কা’বার পবিত্রতা এবং প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং আরব অধিবাসীদের বর্ণনার সত্যতাও সপ্রমাণ করে।
হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর স্মৃতি:
পবিত্র মক্কার ‘বাক্কা’ নামটি সর্বপ্রথম যাবুর কিতাবে পরিদৃষ্ট হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রাচীন শামী ভাষায় ‘বাক’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে আবাদী অথবা শহর। যেমন-আজো শামের একটি প্রাচীন শহরের নাম ‘বায়ালবাক’। অর্থাৎ বায়াল-এর শহর। (বায়াল একটি দেবতার নাম) এতেও এ শহরটির প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর কা’বার প্রাথমিক নির্মাণের সময় এই নামটিই আল কুরআনে উক্ত হয়েছে, “অবশ্যই প্রথম গৃহ যা মানুষের ইবাদতের জন্য বাক্কাতে নির্মাণ করা হয়েছে।” কা’বা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্চে চতুষ্কোণাকৃতি। কারণ এই ঘরটি চতুষ্কোণাকৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখনও এর আকৃতি অবিকল তা-ই রয়ে গেছে। এজন্য এ গৃহটি কা’বা নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
গ্রীক ইতিহাসেরও কা’বার উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। গ্রীসের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘থিওডোরস’ যিনি হযরত ঈসা (আ:)-এর এক শতাব্দী পূর্বে জীবিত ছিলেন, তিনি আরব প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন : সামুদ ও সাবা বংশীয়দের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি বিখ্যাত ইবাদাতখানা আছে। যার নাম আরবগণ অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করে।” (গীবন : রোমানদের উত্থান-পতন : পঞ্চদশ অধ্যায়)
সামুদ গোত্রের অধিবাস ছিল শাম এবং হিজাজ অঞ্চলে, আর সাবা গোত্রের বসতি ছিল ইয়েমেনে। এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, এ দু’টি অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থান হিজাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং এখানকার। বিখ্যাত ইবাদত গৃহ যার নাম আরবগণ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, তাহলো “খানায়ে কা’বা।”
তাছাড়া রোমানদের ইতিহাসেও খানায়ে কা’বার উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক প্রাদকোপাস লিখেছেন : ৫৪১ খ্রীস্টাব্দে রোমান সেনাপতি ‘বিøজির’ স্বীয় অধীনস্থ সেনাপতিদের একটি অধিবেশন আহŸান করেন। এতে শাম দেশের দু’জন সেনা অফিসার দাঁড়িয়ে বললো, “তারা আগামী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কেননা তারা যদি নিজেদের স্থান পরিত্যাগ করে তাহলে আরবের রাজা ‘তৃতীয় মুনজির’ অকস্মাৎ হামলা করে বসবে”। তাদের কথা শুনে সিপাহসালার বললেন : “তোমাদের এই ভয় অমূলক। অতিসত্ত¡র সেই মওসুম এসে যাবে, যার দু’টি মাস আরবগণ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখে। এ সময় তারা সকল প্রকার অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখে।” (মাতায়েজুল আকহাম ফী তাকবীমিল আরবে কাবলাল ইসলাম : মাহমুদ পাশা ফুলকী, পৃ: ৩৫ এবং ফ্রান্স এশিয়াটিক জার্নাল, এপ্রিল, ১৮৮৩ খৃ:)। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ সময়টি ছিল হজ্জের সময়।
উপরোল্লিখিত প্রমাণাদির দ্বারা বুঝা যায় যে, আরবের অধিবাসীরা কিংবা বনী ইসমাঈল সর্বদাই নিজেদের পৈতৃক অনুষ্ঠানাদি পালন করতো। আর এ সকল অনুষ্ঠান পূর্ণ বৈশিষ্ট্যসহ তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাই দেখা যায়, জাহিলিয়াত আমলে, রচিত কাব্য কবিতায় হজ্জের কথা এবং হজ্জের আরকানের কথা বহুলভাবে আলোচিত হয়ছে। (আল আনতাম ফী আকছামিল কুরআন : মাওলানা হামীদ উদ-দীন)। শুধু তা-ই নয়, আররে খৃস্টান কবিরাও সম্মানের সাথে হজ্জের কথা তুলে ধরেছে। এমনকি আরবের বাজারসমূহে এবং মেলাসমূহের জমজমাট অবস্থা কায়েম রাখার জন্যই হজ্জের মওসুমটি ছিল একটি উত্তম সহায়ক। (কিতাবুল আমকিনাহ ওয়াল আজমানাহ : ইমাম মারকুজী পৃ: ১৬১)
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দাওয়াত ও তাবলীগ হিজরতের পূর্বেই আরবের দূর-দূরান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। এবং ইয়েমেন ও বাহরাইনে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল কেননা হজ্জের মওসুমে আরবের সকল গোত্র মক্কা উপত্যকায় তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অনুষ্ঠানগুলো আদায় করার জন্য একত্রিত হত।
হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় ছেলের কুরবানী সংক্রান্ত যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং ‘লাব্বায়েক’ বলে সম্মতি জানিয়েছিলেন, যার পরিপূরণের জন্য তিনি এই দূর-দারাজ স্থানে আগমন করেছিলেন। যখন তিনি পুত্রকে কুরবানী করার জন্য ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন এবং প্রাণপ্রিয় পুত্রও আল্লাহর নির্দেশের সামনে স্বীয় মস্তক অবনত করেছিল, ঠিক তখন ধ্বনিত হলো, “হে ইব্রাহীম (আ:)! তুমি স্বীয় স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ এবং এভাবেই আমি পুণ্যবানদেরকে বিনিময় প্রদান করি...। সুতরাং আমি একটি বৃহত্তর কুরবানীর বিনিময়ে তাঁর ছেলেকে বিমুক্ত করলাম।”। (সূরা সাফফাত : রুকু-৩১
(৩) এ ঘোষণার সাথে সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ:) বুঝতে পারলেন যে, তাঁর স্বপ্নের তাবীর হলো স্বীয় ছেলেকে আল্লাহর ঘরের খেদমতের জন্য এবং তাওহীদের প্রচার বুলন্দ করার জন্য সুনির্দিষ্ট করা এবং এরই প্রেক্ষিতে “খানায়ে কা’বাকে” বিশ্বের বুকে আল্লাহর ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং সেই সময়কে স্মরণ কর যখন কা’বা গৃহকে মানব জাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তার স্থল করে ছিলাম, এবং বলেছিলাম তোমরা ইব্রাহীম (আ:)Ñএর দাঁড়াবার স্থানকেই সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ:)-কে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকুকারী ও সিজদাকারীদর জন্য আমার ঘরকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।”
স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম (আ:) বলেছিল, “হে আমার প্রতিপালক” একে নিরাপদ শহর কর, আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান কর।” তিনি বললেন, যে কেউ সত্য প্রত্যাখ্যান করবে তাকেও কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দেব। তারপর তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব এবং তা’ কত নিকৃষ্ট পরিণাম!
“স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ:) কা’বা গৃহের প্রাচীর তুলছিল, তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজকে গ্রহণ কর, নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞাতা।”
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার এক অনুগত উম্মত কর; আমাদেরকে ইবাদত-বন্দেগীর নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
“হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ কর, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে, তুমি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”
যে নিজেকে নিবোর্ধ করেছে সে ছাড়া ইব্রাহীম (আ:)-এর ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে? পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি, আর পরকালেও সে সৎকর্ম পরায়ণদের অন্যতম হবে। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলেছিল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫-১৬)
অন্য এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং স্মরণ কর, যখন আমি ইব্রাহীম (আ:)-এর জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলে ছিলাম, আমার সাথে কোন অংশী স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো, তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাতে দাঁড়ায় এবং রুকু করেও সিজদাহ করে।”
আর মানুষের কাছে হজ্জের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটসমূহের পিঠে চড়ে আসবে। যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিয্ক হিসেবে দান করেছেন, এগুলোর উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে; তারপর তোমরা ইহা হতে আহার কর এবং দু:স্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।
তারপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে এবং প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে। এটাই বিধান এবং কেউ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোর সম্মান করলে তার প্রতিপালকের নিকট তার জন্য ইহাই উত্তম।”(সূরা হজ্জ : রুকু-৪)। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজ

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ