Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রাম বন্দর ২৪ ঘণ্টা সচলে সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চব্বিশ ঘণ্টা সচল রেখে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম গতিশীল করতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দরের অপ্রতুল অকাঠামো সুবিধা, যন্ত্রপাতি ও ইক্যুপমেন্ট স্বল্পতার পাশাপাশি অদক্ষতা, সমন্বহীনতায় ক্ষোভ অসন্তোষও প্রকাশ করেন তারা। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দর সার্বক্ষণিক সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়ে এব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেন ব্যবহারকারীরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সহজীকরণ এবং চব্বিশ ঘণ্টা বন্দর চালুর বিষয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের সাথে গতকাল (সোমবার) এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল। সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করতে বন্দর ব্যবহারকারীরা দ্রুত জাহাজ জট নিরসন, বন্দরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়, নিলাম পণ্যের কন্টেইনার দ্রুত খালাস, তাৎক্ষণিক পণ্য ডেলিভারি, স্ক্যানারের সংখ্যা বৃদ্ধি ও দক্ষ কর্মচারী, কাস্টমসের লোকবল বাড়ানোর দাবি জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এম এ লতিফ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আটকা পড়বে আর গোটা জাতিকে তার খেসরাত দিতে হবে- তা হবে না। যেকোন মূল্যে বন্দর সচল রাখতে হবে। দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমদানি-রফতানি বাড়ছে। বন্দরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। অতীতে চট্টগ্রাম বন্দর অবহেলিত ছিল অনেক কিছুই হয়নি। বিগত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেসব প্রকল্প এখনও বাস্তবায়ন হয়নি তা দ্রুত শেষ করতে হবে।
নৌ পরিবহন সচিব অশোক মাধব রায় বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি গতিশীল। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়তো হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে তাল মিলাতে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হবে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর সদস্য (শুল্কনীতি) লুৎফর রহমান বলেন, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম গতিশীল করতে সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে এনবিআর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস সার্বক্ষণিক সচল রাখতে যা যা করা দরকার এনবিআর তা সবকিছু করবে। আমদানি-রফতানি সহজীকরণে যে কোন প্রস্তাব এনবিআর গ্রহণ করবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান এম খালেদ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর সার্বক্ষণিক সচল রয়েছে জানিয়ে বলেন, বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল, কর্ণফুলী টার্মিনাল এবং বে-টার্মিনাল প্রকল্পের প্রথম পর্ব স্বল্পতম সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু হয়েছে এবং চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকটি লাইটারেজ জেটি সচল করা সম্ভব হবে। বন্দরের জট কমাতে দুই দিনের মধ্যে কন্টেইনার ডেলিভারি দেওয়া হবে এবং শুল্ক পরিশোধের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কন্টেইনার ডেলিভারি দেওয়া হবে।
চব্বিশ ঘন্টা বন্দরের কার্যক্রম সচল রাখতে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কামনা করে বন্দর চেয়াম্যান বলেন বন্দরের সকল বিভাগ আরও সেবা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। যন্ত্রপাতি ও ইক্যুপমেন্ট সংকট দ্রæত কেটে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ৫৫টি ইক্যুপমেন্ট আমদানির অনুমোদন পাওয়া গেছে বেশকিছু ইক্যুপমেন্ট এসেছে। বেসরকারি আইসিডির সক্ষমতা বাড়ানোর পাশপাশি ৩৭টির অধিক পন্য সেখানে হ্যান্ডলিং করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময়ে ৯৬ ভাগ এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ৪ ভাগ পণ্য ডেলিভারী হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ে পণ্য ডেলিভারীর হার বাড়ালে বন্দর আরও বেশি গতিশীল হবে। আমদানি কারকদের দাবির প্রেক্ষিতে বন্দরের ইয়ার্ডে পণ্যপরিক্ষার জন্য একটি শেড নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন বন্দর চেয়াম্যান।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর কাস্টম হাউস চব্বিশ ঘণ্টা সচল রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু সংকট, সমস্যা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি, এসব সংকট কেটে যাবে। ইতোমধ্যে কাস্টম হাউসে ১শ’ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ১০ জন সহকারী কমিশনার দেয়া হয়েছে। এতে করে কাস্টম হাউসের কার্যক্রম আরও গতিশীল হচ্ছে।
বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মইনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু বলেন, বন্দরে জাহাজ জটের কারণে পোশাক রফতানিতে এক মাসের লিড টাইমের (ক্রেতাদের টার্গেট সময়) শুধুমাত্র কাঁচামাল আমদানি করতে ২০ দিন পার হয়ে যায়। বাকি ১০ দশদিনের মধ্যে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। বর্তমানে দেশের পোশাক শিল্পের বাজার সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলারের। প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০২১ সালের মধ্যে সেটিকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের উন্নীত করার কথা বলেছেন। তবে বর্তমানে আমাদের বন্দরের রয়েছে নানামুখী সমস্যা। জাহাজ জটের কারণে রপ্তানিকারকরা বাধ্য হয়ে বিমানে পণ্য পরিবহন করতে বাধ্য হচ্ছে। বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন দরকার ২৬টি, তবে বর্তমানে আছে মাত্র ৪টি। তারমধ্যে ২টি আবার বিকল।
সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশেনের সভাপতি একেএম আকতার হোসেন বলেন, কাস্টমস হাউজ ২৪ ঘন্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্তের পর থেকেই আমরা শুক্র ও শনিবার আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখছি। বন্দরের অব্যবস্থপনা তুলে ধরে তিনি বলেন আমরা শুল্ক পরিশোধের পরও কন্টেইনার ডেলিভারী দেওয়া হয় না। আর এই কারণে বন্দরের ভেতরে যানজট হচ্ছে। কন্টেইনার ডেলিভারী দিতে ইক্যুপমেন্টের অভাব যেমন আছে তেমন ইক্যুপমেন্ট চালকদের খামখেয়ালীও রয়েছে। এতে করে আমদানিকারকরা হয়রানীর শিকার হন। তিনি চব্বিশ ঘন্টা সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বন্দরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের যথাসময়ে অফিসে উপস্থিতি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো এসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল করিম খান বলেন, ১৬ টি অফডকে আমরা ২২ শতাংশ আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। বেশিরভাগ অফডকে সক্ষমতা বেড়েছে। আরও বেশি পণ্য বিশেষ করে যেসকল পণ্যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনা কম সেপণ্য অফডকে ডেলিভারীর অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের জট অনেক কমে যাবে। বার্থ অপারেটরের প্রতিনিধি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টম চব্বিশ ঘণ্টা সচল থাকলে আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্দরে জটের জন্য বন্দর একা দায়ী নয়। অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি কেপিটাল ড্রেজিং দ্রæত সম্পন্ন করে অচল বার্থগুলোকে সচল করার মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেন। আমদানি-রফতানি গতিশীল করতে এনবিআরের সিদ্ধান্তহীনতার সমালোচনা করেন তিনি। শিপিং এজেন্টের প্রতিনিধি শাহেদ সরোয়ার বলেন, জাহাজ বার্থে আসার পরে গ্যান্টো ক্রেন সমস্যার কারণে তিনদিনের কাজ শেষ হতে লাগে ১২ থেকে ১৪ দিন। এছাড়া রমজান ও বৈরি আবহাওয়ার কারণে প্রচুর কর্মঘন্টা নষ্ট হয়েছে। সভায় চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অঞ্জন শেখর রায়, বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি খলিলুর রহমান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য প্রশাসন মোঃ জাফর আলম, বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম শাখার নির্বাহী নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও ব্যবসায়ী নেতারা বক্তব্য রাখেন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ