পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মৃত্যুঝুঁকিতে লাখো মানুষ : নেপথ্যে ভূমিদস্যুরা অধরা
শফিউল আলম : অতিবর্ষণের সাথে প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ফের ডুবেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গতকাল (রোববার) দিনভর পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। অনেক এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান এমনকি কোথাও কোথাও বুক সমান কাদা-পানির ঢল বয়ে যায়। বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত এই নগরীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন, বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী ওঠানামা, ডেলিভারি পরিবহন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, ব্যাংক-বীমা, বাণিজ্যিক ও সওদাগরী পাড়া ছিল অনেকাংশে অচল। শত শত গুদাম দোকান-পাট পানিতে প্লাবিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। অমাবস্যার ‘জো’র বর্ধিত ও সক্রিয় প্রভাবে গতকাল সকাল সোয়া ৭টায় প্রবল জোয়ার শুরু হয়। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শনিবার রাতে শুরু হওয়া অতিভারী বৃষ্টিপাতের সাথে জোয়ারের চাপে চট্টগ্রাম মহানগরীর অনেক এলাকা একে একে তলিয়ে যেতে থাকে। সন্ধ্যা অবধি নগরীর অধিকাংশ এলাকা ডুবে যায়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১১২ দশমিক ৮ মিলিমিটার। আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক অঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগ তথা জেলা চট্টগ্রাম, তিনটি পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারে পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কায় কঠোর সতর্কতা বহাল রাখা হয়েছে। এসব জেলায় পাহাড়ে বসবাসরতদের মধ্যে যারা পাহাড়-টিলা ও এর পাদদেশে অপরিকল্পিত, যথেচ্ছভাবে কেটে-খুঁড়ে বসতঘর তৈরি করেছে তারা এই মুহূর্তে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে বারবার সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞমহল ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক অবস্থায় বসবাসরতদের সংখ্যা বেশ কয়েক লাখ। এদের বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গৃহহীন, দিনমজুর, নি¤œআয়ের লোকজন। প্রশাসন মাইকিং করাসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালিয়েও তাদেরকে সাময়িকভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে না। আবার স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করে পাহাড়ের মৃত্যুকুপ থেকে স্থানান্তরেরও নেই কোন পরিকল্পিত উদ্যোগ। গত জুন মাস থেকে সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত (বান্দরবান) ভয়াবহ পাহাড় ধসে পৌনে দু’শ মানুষের প্রাণহানি এবং বিপুল সহায়-সম্বল ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের পাহাড়-টিলাময় এলাকাগুলোতে এখন পাহাড় ধসের আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ অবস্থায় আরো পাহাড় ধসের সতর্কতা ঘোষণা সত্তে¡ও পাহাড়-টিলা ছেড়ে যাচ্ছে না লাখ লাখ মানুষ। প্রশাসনের অভিযানে মাঝেমধ্যে সরানো হলেও ফের ফিরে আসছে আগের জায়গায়। চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় ভর করেই তারা মৃতুকুপে দিনাতিপাত করছে। ওদেরকে ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে পাহাড়-টিলা খেকো প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। প্রসঙ্গত গত ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সভায় যে ১৭ দফা সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন, এর অন্যতম ছিল পাহাড় কাটা ও ধ্বংসকরণ অবিলম্বে বন্ধ করে পাহাড় সুরক্ষা এবং সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসরতদের জানমাল রক্ষায় নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া। এরপর কিছুদিন কর্তৃপক্ষের তোড়জোড় দেখা গেলেও এখন তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির পাহাড়ি এলাকাগুলোর বিদ্যমান ঝুঁকির অবস্থার উপর সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা তৈরি হয়নি এখনো।
ফের ডুবলো চট্টগ্রাম
অমাবস্যার ভরা জোয়ারের সাথে অঝোর বর্ষণে গতকাল চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। হাজার হাজার বাড়িঘর, দোকানপাট, গুদাম, আড়ত, হাট-বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ, রাস্তাঘাট, অলিগলি কাদাপানিতে সয়লাব হয়েছে। নগরীজুড়ে জনদুর্ভোগ পৌঁছে চরমে। খাল-নালা উপচে গিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাটের ভেতরের কাদাপানি, কাদা-বালি ও জঞ্জালের স্তূপ অপসারণ করতে গিয়ে অগণিত মানুষ গতরাত অবধি হয়রান-পেরেশান হয়েছেন। বৈরী আবহাওয়ায় যানবাহনের অভাবে কর্মস্থল ও ঘরমুখী হাজারো মানুষ কষ্ট পোহান। প্রবল জোয়ারের সাথে ভারীবর্ষণে বন্দরনগরীর চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক, পাঁচলাইশ, মেহেদীবাগ, বহদ্দারহাট, সিএন্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মোড়, কালুরঘাট, মোহরা, শোলকবহর, কাতালগঞ্জ, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, বাকলিয়া, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, মিয়াখান নগর, রাজাখালী, আগ্রাবাদ, সাগরিকা, হালিশহর, পতেঙ্গাসহ অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটে যানবাহন চলেছে হাতেগোনা। পাহাড়-টিলার কাটাছেঁড়া মাটি, বালি-মাটিতে রাস্তাঘাটের সর্বত্র স্তুপ জমে উঠে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। প্রবল বর্ষণের সাথে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙরে পণ্যসামগ্রী খালাস, ডেলিভারি পরিবহন ব্যাহত হয়। ভিয়েতনাম থেকে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন চালবাহী দু’টি জাহাজ থেকে আগের দু’দিনে আংশিক খালাস কাজ হলেও গতকাল তা বন্ধ রাখা হয়। গমের জাহাজবহরেরও লাইটারিং খালাস কাজ অচল হয়ে পড়েছে।
পাহাড়ে মৃত্যুকুপে লাখো মানুষ
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনও পাহাড়-টিলায় কিংবা পাহাড়ের কোলে মৃত্যুকুপে বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ। অব্যাহত ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসের সতর্কতা জারি রেখেছে আবহাওয়া দপ্তর। নিরাপদ স্থানে সরে যেতে গতকালও মাইকিং এবং অভিযান চলে। কিন্তু তা আমলে নিচ্ছে না পাহাড়ে বসবাসরতরা। যারা সরে যাচ্ছে তারা প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে আবারও ফিরে আসছে। ভূ-তাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা জানান, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বেশিরভাগই বালি মাটির, পাথুরে নয়। তাই ভারী বৃষ্টি হলেই ধসে যাবার আশঙ্কা থাকে। তদুপরি পাহাড়-টিলা যখন কেটে-খুঁড়ে বাড়িঘর তৈরি করা হয় তখন বিপদের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কেননা বৃষ্টিপাতে কাটা-ছেঁড়া বা জরাজীর্ণ পাহাড়-টিলা ধসে পড়ে জীবনহানির শঙ্কা অনেক বেশিই হয়।
শ্রাবণ মাস এখন ঘোর বর্ষা মৌসুম। এ সময়ে ভারী বর্ষণে বিপদের আশঙ্কা ও আতঙ্ক বুকে নিয়েই বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়-টিলা বা পাদদেশে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে। চট্টগ্রাম মহানগরীসহ শহরতলীতে বর্তমানে বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে আগেই চিহ্নিত হওয়া ১৭টি পাহাড়। সেখানে মরাত্মক ঝুঁকিতে বসবাস করছে প্রায় ৫ লাখ মানুষ। আর বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে একশ’রও বেশি পাহাড় টিলায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে অন্তত ১৮ লাখ মানুষ। চট্টগ্রামজুড়ে পাহাড়ি বন-জঙ্গল কেটে ন্যাড়া করে সেখানকারপাহাড়-টিলা ও তার ঢালু বা শানুদেশ কেটে-খুঁড়ে অবৈধ বসতঘর তৈরি করা হয়েছে। ভূমিদস্যু বিভিন্ন চক্র তাদের নিয়োজিত দালালদের দিয়ে বসতহারাদের ভাড়া দিয়ে কিংবা চাঁদার বিনিময়ে থাকতে দিচ্ছে। সেসব পাহাড়-টিলা কেটে বালি ও মাটি বিক্রি হচ্ছে অবাধে। বিপুল অঙ্কের লেনদেন হচ্ছে পাহাড়-টিলার দখলবাজিকে ঘিরে। আর দরিদ্র অসহায় লাখো মানুষকে ঠেলে দেয়া হয়েছে মৃত্যুর মুখে। চট্টগ্রামে অধিকাংশ পাহাড়ের মালিক সরকারি তিনটি সংস্থা। এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবে পাহাড়ের অবৈধ দখল ও কাটা বা ধ্বংসলীলা ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং দুর্নীতিবাজ কর্তাদের পকেটেও যাচ্ছে দখলবাজদের কাড়ি কাড়ি টাকার ভাগ-বাটোয়ারা।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও বিভিন্ন সংস্থার সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এ মুহূর্তে পাহাড়ধসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে লালখানবাজার মতিঝর্ণা, কুসুমবাগ, খুলশী পাহাড়, আকবর শাহ পাহাড়, বাটালি হিল, জয়পাহাড়, হামজারবাগ নবীনগর, বার্মা কলোনী, গোল পাহাড়, দেবপাহাড়, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, জালালাবাদ পাহাড়, নাছিরাবাদ পাহাড়, এনায়েত বাজার পাহাড়, জামতলা পাহাড়, জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়, টাইগারপাস পাহাড়, সিআরবি পাহাড়, মোজাফফর নগর পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকের অংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, বাটালি পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধাম বিশ্বকলোনি পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও সিডিএ এভিনিউ রোডের পাশে অবস্থিত বেøাসম গার্ডেন সংলগ্ন পাহাড়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলায় হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, মিরসরাই, সীতাকুন্ড, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালীতে লাখো মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলায় বা পাদদেশে বসবাস করছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।