Inqilab Logo

রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আদালত পাড়ায় জালিয়াতচক্র

| প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন কর্মচারীরাও : গত এক বছরে ৩ জন চাকুরীচ্যুত : তদন্ত কমিটি গঠন করবে-আইনজীবী সমিতি : জালিয়াতি বন্ধে আমরা কাজ করছি-রেজিস্ট্রার জেনারেল
মালেক মল্লিক : উচ্চ ও নিম্ন আদালত পাড়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে জালিয়াতচক্র। তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে জামিন জালিয়াতি থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গণে নানা অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কেউ কেউ জড়িত। তারা মামলার প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জামিন নিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে প্রতারক চক্রটি। ফলে খুন, ডাকাতি, মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত অনেক ভয়ঙ্কর আসামি ভূয়া জামিননামার (জালিয়াতি) মাধ্যমে জামিন নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে সারা দেশে আদালতে বেশ কয়েকটি জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়েছে। এ ধরনের ঘটনায় অনেক সময় বিচারপ্রার্থী ফেঁসে গেলেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা। স¤প্রতি অস্ত্র মামলার এক আসামী জামিন জামিন নিতে এলে নথি জালিয়াতির বিষয় নজরে আসে হাইকোর্টের। এরপর ঘটনাটির তদন্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভূয়া আইনজীবী থেকে শুরু করে আদালতে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীরা এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। অবিলম্বে তাদেরকে শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে হবে। জালিয়াতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গত বছর কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। আরও তিনজন স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। চলতি বছরের প্রথম অন্তত আটজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও গত এক বছরে অধস্তন আদালতের ১৬৮ কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযোগ এসেছে বলে জানা যায়। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ মো. আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আদালতে জামিন জালিয়াতি বন্ধ করার জন্য আমরা কাজ করছি। আদালতের অধিকাংশ কাজ অন লাইনে চালু করা হবে। এতে করে এইসব অনিয়ম করার সুযোগ পুরাপুরি বন্ধ হবে। আগামীতে কোন নথি থাকবে না; কোর্টের অর্ডারগুলো সঙ্গে সঙ্গ অনলাইনে চলে যাবে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, আদালতের কোন অসৎ কোন কর্মচারী এইসব কর্মকান্ড জড়িত কিনা সে সব কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গত এক বছরের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ইনকিলাবকে বলেন, জামিন জালিয়াতির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। আদালতে প্রাঙ্গণে এধরনের কর্মকান্ড কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। কোন আইনজীবী যদি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিব। সুপ্রিম কোর্টি প্রশাসনকে অনুরোধ করব যদি তাদের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকে তাহলে যাতে বিভাগীয় মামলা করেন। আমরা এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাবো বলেও মন্তব্য করেন্ ওই আইনজীবী নেতা।
জাল নথিতে জামিন নিয়ে আসামী পলাতক ঃ গত ৬ জুলাই মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকার নথি জাল করে জামিন নেয়া অস্ত্র মামলার আসামি হুমায়ন কবির ঝনুর জামিন বাতিল করে আরেক আসামি হাইকোর্টে জামিন নিতে আসলে বিষয়টি নজরে আসে উচ্চ আদালতের। জালিয়াতির ঘটনায় কারা জড়িত, তা বের করে মামলা করতে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চ এ আদেশ দেন্। পরে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ইউসুফ মাহমুদ মোর্শেদ বলেন, মুগদা থানাধীন বিশ্ব রোডের গার্মেন্টস গলির সামনের রাস্তায় অস্ত্র ও গুলি কেনা-বেচার সময় চারজনকে গত বছরের ১৩ নভেম্বর গ্রফতার করে পুলিশ। ওই মামলায় জুনু ও শহর আলী গ্রেফতার হন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নথি জাল করে হাইকোর্ট থেকে নেন আসামি জনু। সেদিন জনুর পক্ষে আদালতে জামিন আবেদন করেছিলেন শফিকুল ইসলাম। ওই মামলার অপর আসামি শহর আলী হাইকোর্টে জামিন নিতে আসলে জালিয়াতি করে জামিন নেয়ার বিষয়টি ধরা পরে। আইনজীবী নাসিমা বলেন, আসামি জনু হাইকোর্টে জামিন পেয়েছেন। সে হিসেবে শহর আলীও জামিন পেতে পারেন। তখন আদালত জনু ও শহর আলীর জামিন আবেদন পর্যালোচনা করেন। তখনই আদালতের কাছে ধরা পড়ে মামলার মূল এজাহার ও জব্দ তালিকার নথি জাল করে জামিন আবেদন করেছিলেন জনু। যে নথি দাখিল করেছিলেন, তাতে একটি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলি উদ্ধারের বিষয়টির উল্লেখই ছিল না বলে জানান এই আইনজীবী। পরে হাইকোর্ট তার জামিন বাতিল করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আর আসামির শহর আলীর জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন।
গত ১৩ এপ্রিল এমএলএসএস সুমনকে বরখাস্তের আদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে দায়েরকৃত রিট পিটিশন মামলা নং-৯৭৬/২০১৭-এর ২৩ জানুয়ারির আদেশ এবং রিট পিটিশন মামলা নং-৯৭৫৩/২০১৪-এর ২১ মার্চের আদেশ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় ১২ এপ্রিল থেকে উক্ত বিধিমালার ১০(১)বিধি অনুযায়ী আপনাকে অত্র কোর্টের চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হল।
জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতের আদেশ পরিবর্তন করে বাদীপক্ষে রায় পাইয়ে দেয়া হয়। আর এ কাজে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের নজরে এলে ওই বেঞ্চের এক কর্মকর্তাকে দিয়ে সুমনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কাছে জালিয়াতির অভিযোগ দাখিল করা হয়। পরে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এছাড়াও গত ৬ জুন হত্যাচেষ্টা মামলার এক আসামির কারাগারে পাঠানোর আদেশ হওয়ার সত্যেও একজন আইনজীবী ওই পুলিশকে আদালতের ভুল ব্যাখ্যা বুঝিয়ে জামিন জালিয়াতির চেস্টা করেন।
এর আগে গত বছরের আগস্ট মাসে হাইকোর্টের বিচারপতি এ কেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের স্বাক্ষর জাল করে সাড়ে ২৯ কেজি স্বর্ণের মামলায় স্থগিতাদেশ নেয়া এবং প্রায় ১৮ হাজার পিস ইয়াবার মামলার আসামির জামিন নেয়ার ঘটনা ঘটে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে জাল আদেশের কপি দুটি নিন্ম আদালতেও পৌঁছায়। যদিও পরবর্তীতে আদেশ দুটি প্রত্যাহার করে নেন ওই বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ ব্যাপারে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। এরপর আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বিষয়টি তদন্ত করে এ জালিয়াতির জন্য ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করেছেন।
কর্মচারীরাও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ঃ গত এক বছরে অধস্তন আদালতের প্রায় দেড় শতাধিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে অভিযোগবক্সে। তবে অভিযোগকারীর নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এগুলো সুনির্দিষ্ট না থাকায় অধিকাংশই অভিযোগই আমলে নিতে পারছে না সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে একজন হলেন চট্টগ্রাম প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী দীপংকরদাস (বরখাস্তকৃত)। তার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দাখিল করেন। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, দীপংকরের সোনালি ব্যাংকের চট্টগ্রাম কোর্টহিল শাখার ১০০০১২৬৭৯ নম্বর হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার বেতন-ভাতার চেয়েও বহুগুণ বেশি টাকা অসাধু লেনদেনে জড়িত, যা ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। একই সঙ্গে বিচারাধীন মামলায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকের কাছে তদবির করেন। অসৎ উদ্দেশ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে দীপংকর দাসকে ২০১২ সালে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। তবে কিন্তু ওই নোটিশের কোনো জবাব তিনি দিতে পারেনি। এসব অভিযোগের কারণে তাকে কেন স্থায়ীভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়। এখনও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শেষ হয়নি।
উচ্চ আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম রোধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের অভিযোগ জানানোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেল দপ্তরের সামেন বসানো হয়েছে অভিযোগ বক্স। এছাড়া অনলাইনে ওয়েবসাইটে ঢুকেও অভিযোগ দাখিলের সুযোগ রয়েছে। বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। তারপরও আদালতের নিন্ম শ্রেণীর কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিশেষ করে জাল-জালিয়াতি, ফাইল গায়েব করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠছে।
অস্ত্রসহ ভুয়া আইনজীবী আটক ঃ গতকাল ঢাকার আদালত প্রাঙ্গনে অস্ত্রসহ এক ভুয়া আইনজীবীকে আটক করা হয়েছে। নারী ও শিশু আদালত থেকে উচ্চ আদালতের ভ্যান্ড গাউন পরা অবস্থায় তাকে আটক করা হয়। তিনি নিজেকে ব্যারিস্টার নিয়ামত উল্ল্যাহ, তিনি সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভাকেট এবং হার্টের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দীর্র্ঘ দিন যাবত প্রতারণা করে আসছিলেন। ভুয়া আইনজীবীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আইনজীবী সমিতি ভবনে আনার পর তার কাছে পরিচয় পত্র চাইলে তিনি তখনো নিজেকে ঢাকা বারের সদস্য দাবি করেন। তবে সকল তথ্য যাচাই করে দেখা যায় তার আইনের কোনো ডিগ্রীই নেই। এতদিন ধরে আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে নিয়ামত উল্ল্যাহ টিপুকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটি পুলিশে সোপর্দ করেন।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারীতে ময়মনসিংহ জজ কোর্ট এলাকায় থেকে একজন ভূয়া একজন আইনজীবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ আগে গত বছর হাইকোর্টে মো. জালাল উদ্দিন নামের একজন ভূয়া আইনজীবীকে শনাক্ত করা হয়। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত উচ্চ আদালতে নানা ভাবে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে কাজ করে দেয়ার কাজ করেন। তার মতো ছদ্ম বেশে প্রায় শ খানেক প্রতারক আদালত পাড়ার সক্রিয় আছেন বলে জানা যায়।
এর আগে একজনন আইনজীবীকে আটক করে আইনজীবী সমিতি। তার নিজের নামে কোন সনদ নেই্। তিনি ২৯ বছর ধরে আইনজীবী পরিচয়ে কাজ করেন। শত কোটি টাকার মালিক ও ঢাকায় দুটি বাড়ি ও ৪১ কাঠা জায়গার মালিক হয়েছেন বলে জানা যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আদালত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ