পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির অংশ হিসাবে নির্বাচন কমিশন একটি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে গত পরশু সাংবাদিক সম্মেলনে এই কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। নির্বাচনের দেড় বছর আগে উন্মোচিত এই কর্মপরিকল্পনায় নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বিষয়গুলো কখন কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনার বিষয়গুলো হলো : ১. আইন কাঠামো পর্যালোচনাও সংস্কার, ২. নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, ৩. সংসদীয় এলাকার সীমানা পুননির্ধারণ, ৪. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সরবরাহ, ৫. বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ৬. নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং ৭. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি। এই ৭ দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করে সিইসি জানিয়েছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপের এই দলিল সর্বশেষ নয়। সময় ও বাস্তবতার নিরিখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন কর্মকর্তারা আরও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ আস্থাশীল। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে বিদ্যমান আইনই যথেষ্ট। তবে সময়ের প্রয়োজনে ঘোষিত রোডম্যাপে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তার ভাষায়, এটি একটি সূচনা দলিল। নির্বাচনের পথে কাজ করার জন্য এ কর্মপরিকল্পনাই সব নয়। সংযোজন-পরিমার্জন করে আমরা সবার মতামত নিয়ে কাজ করে যাবো। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে আশাবাদ ব্যক্ত করে সিইসি বলেছেন, শুধু সরকার কেন, রাজনৈতিক দল বা যে কোনো দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আমরা করতে পারবো। প্রসঙ্গত তিনি উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অবস্থায় বর্তমান ইসির পক্ষে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।
সন্দেহ নেই, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে কোনো বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় অপরিহার্য বলে বিবেচিত হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। সে নির্বাচন না ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং না ছিল অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য। ওই ধরনের নির্বাচন পুনর্বার কোনো মতেই কাঙ্খিত হতে পারে না। সঙ্গতকারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য। বলার অপেক্ষা রাখেনা, তেমন নির্বাচন উপহার দেয়া নির্বাচন কমিশনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন বলেই এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্বাচনের এত আগে এই প্রস্তুতিমূলক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা থেকেই সেটা অনুধাবন করা যায়। কাঙ্খিত নির্বাচন নিশ্চিত করতে এই কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা অস্বীকার করা যায় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে ঘোষিত কর্ম পরিকল্পনাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ জাতির সামনে পেশ করেছে তা বাস্তব। সঙ্গত হয়েছে। পক্ষান্তরে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে বিএনপির তরফে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যেখানে আগামী নির্বাচনের রোড দেখতে পাচ্ছি না সেখানে ম্যাপ ঘোষণা করে কী হবে? নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ইসির রোড ম্যাপ সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সারকথা এরকম : আগামী সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রোডম্যাপে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা কি হবে, সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েছে। ইসিকে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর ও অর্থবহ করার বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা কি হবে, তা নিয়ে কোনো কথা নেই। নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে ঘুরে ফিরে রাজনৈতিক প্রসঙ্গটি প্রাধান্য চলে এসেছে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রকৃতি কেমন হবে, তার ওপর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নির্ভর করে। নির্বাচনে সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের দাবি করেছে। ক্ষমতাসীন দল এই দাবি মানতে নারাজ। তার মতে, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য ফয়সালা না হলে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারটি অনিশ্চিত থেকে যাবে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্যতম পূর্বশর্ত। নির্বাচন কমিশন বিধি-বিধান নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রকৃতি ও অবস্থান নিয়ে কিছু বলা হয়তো তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, তবে এক্ষেত্রে তার পরামর্শমূলক অভিমত থাকা সম্ভব। শুধু ইসির নয়, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দায়ও অনেকাংশে রাজনৈতিক দলগুলোর। ইসির তরফে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিষয়টি দেখবে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, সেটাই ইসির পক্ষে সম্ভব। সারাবছর রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর পরই এ দায়িত্ব ইসির ওপর বর্তায়।
ইসির দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এটি ইসির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ঘোষিত রোডম্যাপ সেই চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজটি অনেকখানি এগিয়ে নেবে, যদি ইসি সফলভাবে রোডম্যাপটি বাস্তবায়ন করতে পারে। ইসির পূর্ণ সাফল্য অবশ্যই নির্ভর করবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তার ওপর। নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা রোডম্যাপের যে সব অসম্পূর্ণতার কথা উল্লেখ করেছেন, ইসি তাদের সঙ্গে সংলাপ করে সেই অসম্পূর্ণতা দূর করতে পারে। ইসি পর্যায়ক্রমে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা প্রভৃতির সঙ্গে সংলাপের যে কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে, আমরা মনে করি, তাতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে সবচেয়ে বেশি। সিইসি এই অংশীজনদের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেছেন। পরামর্শ পাওয়া বড় কথা নয়, তা কার্যকর করাই বড় কথা। ইসি তার নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে পরামর্শ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রত্যাশিত নির্বাচন উপহার দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হতে পারে। আর যদি ইসি আগের ইসির মতো মেরুদন্ডহীনতার পরিচয় দেয়, সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালন করে তবে আমরা নিশ্চিত, তাকেও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।