Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সরকারের উচিৎ অর্থনীতির দিকে অধিক নজর দেয়া

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, একথা বেশ কিছুদিন ধরে জোরের সঙ্গে বলছেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন সূচকের ধারাবাহিক অবনমন তাদের বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে। যখন সরকারি মহল থেকে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার উচ্চাভিলাষী প্রচারণা চালানো হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার স্বাপ্নিক মেগা প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ¦াস প্রকাশ করা হচ্ছে তখন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকা কিংবা বাড়ার আশঙ্কা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকারি মহল রাজনীতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যত তৎপর, অর্থনীতির শঙ্কা নিরসনে ততটাই যেন বেখেয়াল ও নরাসক্ত। এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আগামীতে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততা আরো বাড়বে, সেটা স্বভাবতই আন্দাজ করা যায়। সেক্ষেত্রে অর্থনীতির বিষয়াশয়গুলো আরো উপেক্ষার শিকার হবে বলে ধারণা করা যায়। অবশ্য অর্থনীতিতে সৃষ্ট ধস বাড়লে এবং মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুতায়িত হওয়ার বদলে ধীরতার কবলে পতিত হলে সরকারি মহলের রাজনীতিও অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে। এটা তার জন্য কোনো সুসংবাদ হবে না। যা হোক, সবদিকের বিবেচনায় সরকারি মহলের উচিৎ অর্থনীতির দিকে অধিক নজর দেয়া। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অর্থনীতিতে বহুমুখী সংকট ক্রমশ ঘনিভূত হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের জন্য দূরূহ হয়ে পড়বে। বাজেটে যে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকায় ঘাটতি রয়েছে তা কিভাবে পূরণ হবে তার কোনো সুস্পষ্ট পথনকশা নেই। রাজস্ব আদায় বাড়ানো খুব সহজসাধ্য হবে না। রাজস্ব আদায়ে নিম্নমুখিতা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পটভূমিতে এদিকে বেশি কিছু করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ওদিকে রফতানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়ারও তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ দু’খাতে আয় কমার বরং আশঙ্কা রয়েছে। বিনিয়োগ তো প্রায় এক দশক ধরে অগ্রগতিহীন অবস্থায় রয়েছে। বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্বের কারণে কর্মসংস্থান সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে। নতুন বিপদ হিসাবে কৃষির ওপর বড় আকারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় বোরো ব্যাপকভাবে মার খেয়েছে। খাদ্য সংকট মারাত্মক হয়ে উঠেছে। চালসহ নিত্যপনের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এমতাবস্থায়, অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার কোনো অবধি নেই।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের অপরিহার্য ভূমিকার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বা বিদেশী বিনিয়োগ কোনোটাই বাড়ছে না। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। বিনিয়োগে ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়ার একটি বড় কারণ রাজনৈতিক সংকট এবং সংকট বৃদ্ধির আশংকা। আপাতত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃংখলার অস্তিত্ব নেই বটে; তবে সংকটের কোনো সুরাহা না হওয়ায় এবং সংকট বাড়ার আশঙ্কা থাকায় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে না। এ অবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সংকট মোচনের বিষয়টি। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, দেশের অর্থনীতির প্রধান দুটি স্তম্ভের একটি হলো রফতানি আয় অন্যটি প্রবাসী আয়। এই দু’ খাতের আয়ই কমছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, গেল অর্থ বছরে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এরকম নৈতিবাচক ধারা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বাজারেই রফতানি কমেছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন পণ্য রফতানি থেকে আলোচ্য বছর আয় এসেছে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ কম। গত ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম। একইভাবে গত বছর প্রবাসী আয় কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। বিগত দু’অর্থ বছরেই প্রবাসী আয়ে নিম্নগতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রবাসী আয় কমার জন্য ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন, চাকরিগত নানাবিধ সমস্যা, সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থপ্রেরণ হ্রাস ইত্যাদিকে দায়ী করা হলেও বাস্তবতা এই যে, এখাতে আয় হ্রাসমান এবং আগামীতে আরো হ্রাসের আশংকা রয়েছে। এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা তখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগও তেমন নেই। ফলে অর্থনীতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
অর্থনীতিবিদরা লাগাতার বলে আসছেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ জন্য সর্বাগ্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি আবশ্যক। গত প্রায় এক দশক ধরে যে রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত রয়েছে তার সুরাহা না হলে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সুবাতাস প্রবাহিত হবে না। তারা আরো মনে করেন, স্থিতিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের পাশাপাশি বিনিয়োগ ক্ষেত্রে আর যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমাত্র রয়েছে তারও দ্রুত সমাধান করতে হবে। ব্যবসা শুরুর ব্যয় হ্রাস, জমির যোগান, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধ, উৎকোচ-দুর্নীতি রোধ, ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাস এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংস্থান করতে হবে। রফতানি আয় বাড়ানোর জন্যও বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। গার্মেন্টপণ্যই রফতানি আয়ের প্রধান উৎস। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গার্মেন্ট পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক-কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা বাড়িয়ে তার ত্বরিৎ সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে। এব্যাপারে ওয়াকিবহাল একমত, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য মুসলিম দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত¡ও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগের অভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো ওইসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীরা ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছে, বেতন-ভাতার বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের কোনো সহায়তা করতে পারছে না রাষ্ট্র। তাদের বিশ্বাস, ওইসব দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক জোরদার করা হলে জনশক্তি রফতানি ও প্রবাসী কর্মীদের সুবিধা ও নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব। এদিকে সরকারের বিশেষভাবে সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। উন্নয়নলক্ষ্য অর্জন ও জনগণের জীবনমান বৃদ্ধির জন্য যে কোনো মূল্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের বাড়াতে হবে। সরকারকে এদিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। রাজনীতি ও ক্ষমতার চর্চার চেয়ে এটাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন