Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হিন্দু তীর্থস্থান অমরনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন এক মুসলিম

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ভারতে হিন্দু তীর্থক্ষেত্র অমরনাথ থেকে পূজা শেষ করে ফেরার পথে গত সোমবার জঙ্গিদের হামলায় সাত জন তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার পর এর নিন্দায় সরব হয়েছেন ভারতশাসিত কাশ্মীরের হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা সবাই। এমনকি যাঁরা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতার জন্য আন্দোলন করছেন, সেসব নেতারাও নিন্দা জানিয়েছেন।
তবে শ্রীনগরে বিবিসির সংবাদদাতা মাজিদ জাহাঙ্গীর লিখছেন, হিন্দুদের কাছে এই পবিত্র তীর্থস্থানের সঙ্গে মুসলমানদের নিবিড় সম্পর্ক বহু শতকের। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান ভারতশাসিত কাশ্মীরের এই অমরনাথ গুহা। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দীর্ঘ পাহাড়ী পথ পেরিয়ে খুব কষ্ট করে পৌঁছান ওই গুহায়। কিন্তু হিন্দু পুরাণে বর্ণিত অমরনাথ গুহা প্রায় ৫০০ বছর আগে খুঁজে বের করেছিলেন একজন মুসলমান মেষ পালক।
বুটা মালিক নামের ওই মেষ পালকের পরিবার তাই এখনও এই হিন্দু তীর্থযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকেন প্রতি বছর। তার বংশধররা এখনও বাস করেন পহেলগাঁওয়ের কাছে বটকোট নামের একটি গ্রামে।
পরিবারের সপ্তম পুরুষ গুলাম হুসেইন মালিক বলছিলেন যে, তারা পারিবারিক ইতিহাস থেকেই জেনেছেন, কীভাবে বুটা মালিক খুঁজে পেয়েছিলেন অমরনাথ গুহা। ‘ঘটনাটা শুনতে একেবারে পৌরাণিক কাহিনীর মতো। বুটা মালিক মেষ পালন করতেন। দূরের পাহাড়-পর্বতে ভেড়া-ছাগল চরাতে যেতেন তিনি। সেই পর্যায়েই এক সাধুর সঙ্গে তার দেখা হয়। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়’ - বিবিসিকে বলছিলেন জনাব মালিক। একবার প্রবল শীতের হাত থেকে বাঁচতে বুটা মালিক একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সঙ্গে ওই সাধুও ছিলেন। ভেতরেও খুব ঠান্ডা লাগছিল বুটা মালিকের। তখন ওই সাধু একটা কাঙ্গরি দিয়েছিলেন বুটা মালিককে।
কাশ্মীরে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষজন একটা ছোট ঝুড়ির মধ্যে কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে ঢোলা পোষাকের ভেতরে রেখে দেন। ওই ঝুড়িকেই কাঙ্গরি বলে।
গুলাম হুসেইন মালিক বলছিলেন, ‘সকালবেলায় বুটা দেখেছিলেন যে, ওই কাঙ্গরিটা একটা সোনার কাঙ্গরি হয়ে গেছে’।
জনাব মালিকের পারিবারিক ইতিহাস বলছে, গুহা থেকে বের হতেই বুটা মালিক দেখেন সামনে অনেক সাধু-সন্তের একটা মিছিল চলছে। তারা ভগবান শিবের খোঁজ করছিলেন ওখানে।
‘বুটা ওই সাধু-সন্তদের জানান যে, শিবের সঙ্গে তার একটু আগেই দেখা হয়েছে গুহার ভেতরে। সাধুদের তিনি গুহায় নিয়ে যান। দেখা যায় বরফের তৈরি এক বিশাল শিবলিঙ্গ রয়েছে, সঙ্গে পার্বতী আর গণেশও আছেন’- জানাচ্ছিলেন গুলাম হুসেইন মালিক। ওই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই অমরনাথে তীর্থযাত্রা শুরু হয়।
তবে একটা সময়ে বেশ কয়েকজন সাধুসন্ত গুহার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তখন সেখানকার মহারাজ রঞ্জিত সিং অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে দেন।
‘আমরা তো মুসলমান। হিন্দুদের পূজা-পাঠের ব্যাপারে আমাদের পূর্বপুরুষরা কিছুই জানতেন না। যাত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে পাশের গণেশ্বর গ্রাম থেকে কয়েকজন কাশ্মীরী পন্ডিতকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যরা। তারাই অমরনাথে পূজা চালিয়ে যেতে থাকেন’ - জানালেন জনাব মালিক।
এখনও অমরনাথে তিন ধরনের মানুষ বাস করেন - কাশ্মীরি পন্ডিত, মালিক পরিবার আর সাধুসন্তরা। এঁরাই অমরনাথ যাত্রার সূচনা করেন ‘ছড়ি-মুবারক’ শোভাযাত্রার মাধ্যমে। যে গ্রামে মালিক পরিবার এখনও থাকেন, পহেলগাঁও এলাকার সেই গ্রামের নামও বুটা মালিকের নাম অনুসারেই - ‘বটকোট’।
‘একসময়ে অমরনাথ তীর্থযাত্রীরা পায়ে হেঁটে আমাদের গ্রামে পৌঁছাতেন। গ্রামের মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা - সবাই মিলে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। ছড়ি-মুবারক শোভাযাত্রা দেখতে গোটা গ্রাম অপেক্ষা করে থাকতো। মেয়েরা কাশ্মীরী গান গাইত। আমরাই হিন্দু তীর্থযাত্রীদের গুহায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। আবার গুহা থেকে নেমে আমাদের গ্রামে এসে অনুমতি নিয়ে ফিরে যেতেন তীর্থযাত্রীরা। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ কখনোই ছিল না’ - বলছিলেন জনাব মালিক।
হিন্দু তীর্থযাত্রীরা যেহেতু অমরনাথ যাত্রার সময়ে আমিষ খান না, তাই মালিক পরিবারের সদস্যরা ওই সময়ে গোশত খান না। সংস্কৃত ভাষায় কবি কল্হনের লেখা কাশ্মীরের ইতিহাস রাজতরঙ্গিনীতেও মালিক পরিবারের যেমন উল্লেখ রয়েছে, তেমনই অমরনাথ যাত্রা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় যে আইন পাশ হয়েছে, সেখানেও মালিক পরিবারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও কাশ্মীরে গেলেই মালিক পরিবারের কথা স্মরণ করতেন। কিন্তু বুটা মালিককে সেই সাধুর দেওয়া কাঙ্গরি - যেটা পরের দিন সোনার কাঙ্গরি হয়ে গিয়েছিল - সেটার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।
গুলাম হুসেইন মালিক জানাচ্ছেন, সেই সময়কার রাজারা কাঙ্গরিটা তাদের পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। তারপর থেকে সেটার আর কোনও খোঁজ নেই। বহু খুঁজেও পাওয়া যায়নি সেই সোনার কাঙ্গরি। অমরনাথ যাত্রার সময়ে ভক্তদের দান করা অর্থের এক-তৃতীয়াংশ বুটা মালিকের পরিবার পেত।
‘কিন্তু ২০০২ সালে অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড তৈরি হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারকে যাত্রার সবরকম কাজ থেকে দূরে রাখা হয়। আমাদের বলা হয়েছিল মুসলমানদের ওয়াকফ বোর্ডে তো কোনও হিন্দু নেই, তাই শ্রাইন বোর্ডে মুসলমান কী করে থাকে’! - বলছিলেন গুলাম হুসেইন।
পরিবারের আরেক সদস্য মালিক আফজাল বলছিলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা শিবের দর্শন পেয়েছিলেন। অমরনাথ গুহায় পৌঁছানোর যে প্রথম কাঁচা রাস্তাটি ছিল, সেটিও বুটা মালিকই বানিয়েছিলেন। এখনও আমরা প্রতি বছর গুহায় যাই যাত্রীদের বিনামূল্যে ওষুধপত্র বিলি করতে। যাত্রীরাও পরম্পরা মেনে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসেন’।
হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ঘোড়া অথবা ডুলিতে করে কঠিন পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে নিয়ে যান যারা, তারাও সবাই স্থানীয় মুসলমান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হিন্দু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ