মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
মনে হচ্ছে ভারতের দক্ষিণ-পন্থী হিন্দুরা এটাকে একটা বিদেশি ভাষা বলে মনে করে, যেটি তথাকথিত ইসলামী আগ্রাসীরা ভারতের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
উর্দু নিয়ে সর্বশেষ শোরগোল তৈরি হয়েছিল গত এপ্রিল মাসে। একটি কট্টর দক্ষিণ-পন্থী নিউজ চ্যানেলের একজন রিপোর্টার একটি জনপ্রিয় ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকে কর্মচারীদের হেনস্থা করা শুরু করলেন, কারণ এই নারী সাংবাদিকের মনে হয়েছিল সেই দোকানের খাবারের প্যাকেটের লেবেল উর্দুতে লেখা। পরে দেখা গেল, এই লেবেলের লেখা উর্দুতে নয়, আরবিতে।
অনেকেই বলছেন, ভারতে এখন কোন কিছুর সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃতির কোন সম্পর্ক থাকলেই সেটিকেও মোটা-দাগে ইসলামিক বলে তকমা লাগিয়ে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। গত বছর ভারতের পোশাকের ব্রান্ড ফ্যাবইন্ডিয়া তাদের একটি বিজ্ঞাপন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ এটির শিরোনাম উর্দুতে ছিল বলে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন।
অতীতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত সদস্যদের উর্দুতে শপথ নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়; শিল্পীদের উর্দুতে দেয়াল লিখন বন্ধ করে দেয়া হয়; অনেক শহর এবং এলাকার নাম বদলে ফেলা হয়। এমনকি স্কুল পাঠ্যবই থেকে উর্দু শব্দ অপসারণের দাবি জানিয়ে আবেদন করা হয়। উর্দুর ওপর এই আক্রমণ, অনেকের বিশ্বাস, ভারতের মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণের যে ব্যাপক চেষ্টা, তারই অংশ।
ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুশকে বলেন, "ভারতের ভাষাগুলোকে ধর্ম দিয়ে শেকলবন্দী করার এই রাজনৈতিক পরিকল্পনা সামনে এগিয়ে নেয়ার পথ একটাই- তাহলো আধুনিক ভারতীয়দের তাদের ইতিহাসের এক বিরাট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।" "অতীত ইতিহাসের সঙ্গে এরকম বিচ্ছিন্নতা হয়তো বর্তমান সরকারের স্বার্থরক্ষা করতে পারে, কিন্তু বাকী সবার জন্য এটি হবে নিজেদের ঐতিহ্য থেকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত হওয়া," বলছেন তিনি।
এই প্রতিবেদনের জন্য কথা বলতে বিবিসি বিজেপির তিনজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু তাদের কারও দিক থেকেই কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। উর্দু বেশ কোমল এবং ভাবপূর্ণ এক ভাষা। ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু কবি এবং লেখক তাদের লেখালেখির জন্য এই ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন। ভারতের খুবই উচ্চ প্রশংসিত কিছু সাহিত্যকর্ম এসেছে সাদাত হাসান মান্টো এবং ইসমত চুগতাই এর মতো উর্দু লেখকদের কলম থেকে।
উর্দুর যে লালিত্য এবং ভাষা শৈলী, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে এই ভাষায় বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী কবিতা যেমন লিখেছেন, আবার এই ভাষাতেই রচিত হয়েছে অজস্র রোমান্টিক গজল। বলিউডের সঙ্গীতের হৃৎস্পন্দনও হচ্ছে এই উর্দু ভাষা। তবে ভারতে যারা উর্দুর বিপক্ষে, তারা বলার চেষ্টা করেন এটি মুসলিমদের ভাষা, আর হিন্দুরা কেবল হিন্দিতেই কথা বলে। কিন্তু ইতিহাস এবং মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা বলে ভিন্ন কথা।
আজকে যেটিকে উর্দু ভাষা বলা হয়, তার শেকড় সন্ধান করলে পাওয়া যাবে তুর্কি, আরবি এবং ফারসি ভাষা- যার সবগুলোই ভারতে এসেছিল বাণিজ্য এবং বিদেশিদের বিজয়ের পথ ধরে। "এই ভাষা তৈরি হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে নানা সংস্কৃতির মিশেলে", বলছেন ইতিহাসবিদ অলোক রাই। "আর যখন ভাষাটির উদ্ভব ঘটছিল, তখন নানা পর্যায়ে এর ছিল হরেক রকম নাম: হিন্দাভি, হিন্দুস্থানি, হিন্দি, উর্দু বা রেখতা", বলছেন তিনি।
ডঃ রাই বলেন, কথ্য উর্দুর সঙ্গে এই ভাষার লিখিত রূপের একটা পার্থক্য আছে। উর্দুর যে সাহিত্য ভাষা, তার উদ্ভব ঘটে আঠারো শতকের শেষভাগে মুঘল রাজবংশের অন্তিম দিনগুলোতে দিল্লির দরবার ঘিরে থাকা অভিজাতদের হাত ধরে। এই 'উর্দু' ভাষাকে তখন মুসলিমদের ভাষা বলে গণ্য করা হতো না, এখন যেভাবে দেখা হয়। বরং তখন উর্দুর ছিল একধরণের আভিজাত্য, উত্তর ভারতের অভিজাতরা এই ভাষায় কথা বলতেন, এমনকি অভিজাত হিন্দুরা পর্যন্ত।
অন্যদিকে সাহিত্য ভাষা হিসেবে হিন্দির আবির্ভাব আরও পরে, উনিশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকে আজকের উত্তর প্রদেশে। হিন্দিরও উদ্ভব ঘটেছিল উর্দুর মতো একই কথ্য ভাষা থেকে, তবে এটিকে উর্দু হতে একটি আলাদা ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সচেতন প্রয়াস ছিল। 'উর্দু' ভাষায় যেখানে বেশিরভাগ শব্দ এসেছিল ফারসি থেকে, যেটি কিনা মধ্যযুগের ভারতের অভিজাতদের প্রধান ভাষা ছিল, - সেখানে হিন্দিতে এসব শব্দ আসে সংস্কৃত থেকে, যেটি প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় পাঠের ভাষা।
"কাজেই দুটি ভাষারই ব্যাকরণ কিন্তু অভিন্ন", বলছেন ডঃ রাই। "কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এই দুটি ভাষার আদি উৎস নিয়ে মিথ বা কল্পকাহিনী তৈরি হয়েছে।" ডঃ রাই বলছেন, হিন্দি এবং উর্দু ভাষাভাষী উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই কিন্তু একই ভাষাতেই কথা বলতেন, কিন্তু নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার জন্য তারা এই ভাষাকে ভাগ করে ফেললেন। তিনি বলেন, "পুরো বিষয়টা হয়তো কিছুটা প্রহসনমূলক হতো যদি না এর এরকম একটা বিয়োগান্তক পরিণতি দাঁড়াতো।"
ব্রিটিশ শাসনামলে এই বিভেদ আরও বাড়ে, কারণ ব্রিটিশরা হিন্দিকে হিন্দুদের এবং উর্দুকে মুসলিমদের ভাষা বলে চিহ্নিত করতে থাকে। তবে উর্দুকে একটি বিদেশি ভাষা হিসেবে চিত্রিত করার যে চেষ্টা এখন দক্ষিণ-পন্থীদের আলোচনায় দেখা যায়, সেটাও নূতন নয়। এই বিভেদ আরও তীব্র হয়ে উঠে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আগে।
"মুসলিম লীগ তখন ভারতের মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যে সব কারণ দেখাচ্ছিল, উর্দু হয়ে উঠেছিল তার একটি, এবং তারা পাকিস্তানের দাবির পক্ষে জনমত গড়তেও উর্দুকে ব্যবহার করেছিল", বলছেন ডঃ রাই। কাজেই ভারতে উর্দু যে শুরুতেই টার্গেটে পরিণত হলো, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। উত্তর প্রদেশ রাজ্যের স্কুলগুলোতে উর্দু নিষিদ্ধ করা হলো। ডঃ আহমদ বলেন, তখন অনেক হিন্দুও এই ভাষা ত্যাগ করলেন।
ডঃ ট্রুশকে বলেন, উর্দুকে ব্যবহার করে ভারতের দক্ষিণ-পন্থীরা এমন এক অতীত তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেটির আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। "উর্দু যদি হঠাৎ করে কেবলমাত্র মুসলিমদের ভাষা হয়ে গিয়ে থাকে, আমরা কি তাহলে বহু হিন্দু, যারা উর্দুতে লেখালেখি করেছেন, তাদের কথা আর কোনদিন বলবো না? আমাদের আদিকালের অনেক হিন্দি পাণ্ডুলিপি যে ফারসি-আরবি হরফে লেখা, সেগুলোর কথা উল্লেখ করবো না?"
মি. রাই বলছেন, হিন্দি থেকে উর্দু অপসারণের চেষ্টা হিন্দি ভাষার অধঃপতন ঘটিয়েছে। "এই হিন্দি জনমানুষের ভাষা নয়, এটি যেন এক বন্ধ্যা ভাষা, যার মধ্যে কোন আবেগের অনুরণন নেই।" সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।