Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভারতে ধর্মান্ধতার রাজনীতি ও আইনের শাসনের ব্যর্থতা

| প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেনাফন-এশিয়া টাইমস : ২২ জুন দিল্লী থেকে ঈদের কেনাকাটা করে ট্রেন বাড়ি ফিরছিল ১৬ বছরের মুসলিম কিশোর হাফিজ জুনাইদ। তার সাথে ছিল তার ভাই ও আরো দু’ বন্ধু। ট্রেনে একদল মানুষ (হিন্দু) মুসলমান হওয়ার কারণে জুনাইদকে পিটিয়ে হত্যা করে। বরেণ্য ভারতীয় লেখক মুনসি প্রেমচাঁদ তার ঈদগাহ গল্পে বাঁচার আনন্দ হিসেবে ঈদকে অমর রূপ দিয়েছেন।
কিন্তু ট্রেনে যা ঘটেছিল তা ছিল হত্যার আনন্দ।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ভারতের কোনো কোনো স্থানে চলছে ধর্মান্ধতার সন্ত্রাস, বৈধ হচ্ছে সহিংসতা , আর তা আইনের শাসনের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী হিন্দু উগ্রপন্থী গো-রক্ষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতায় ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ৭টি পৃথক ঘটনায় ১২ বছরের এক বালকসহ ৭ জন নিহত হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) দ্বারা অনুপ্রাণিত ও তার রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থনে হিন্দু সাংস্কৃতিক গ্রæপগুলো সারা ভারতে হাজার হাজার গো-রক্ষা ব্রিগেড গঠন করে গরুর ব্যবসা ও গরুর গোশত আহারকারীদের মারধর ও হত্যা করছে।
মুসলিম সংখ্যালঘুরা বৈরিতার শিকার
মুসলমানদের উপর অত্যাচারকারী হিন্দুদের কোনো শাস্তি হয় না, কারণ তারা হিন্দুত্ববাদে বিশ^াসী। এ হিন্দুত্ববাদ মুসলমানদের ভারত থেকে বহিষ্কার ও তাদের সাথে বৈরিতার পরামর্শ দেয়। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ১৮ কোটি।
শাসক বিজেপি দলের মন্ত্রীরা এ হত্যার কথা হয় অস্বীকার করেন অথবা তা গুরুত্বহীন বলে দেখান, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এ গুরুতর ব্যাপার সম্পর্কে দায়সারা ভূমিকা পালন করছেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের রূপটির গত দু’দশক ধরে হিন্দুত্ববাদের রূপে উৎসারণ ঘটেছে। তাদের প্রথম প্রধান ধর্মান্ধতার কাজ হচ্ছে আরএসএসের অঙ্গদল ও গ্রæপগুলো যেমন বিজেপি, বিশ^ হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল দ্বারা উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরী মসজিদ ধ্বংস।
বিজেপি বাবরী মসজিদ ধ্বংস ও পরবর্তী দাঙ্গায় লাভবান হয় যা হিন্দু সংখাগরিষ্ঠদের মেরুকরণ করে এবং ১৯৯৮ সালে জোট সরকার গঠনে সক্ষম হয়।
বিজেপির পার্লামেন্ট সদস্য যোগী আদিত্যনাথ মুসলমানদের তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’, গরুর গ্শোত ও হিন্দুদের মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করার মোকাবেলায় ধর্মান্ধ হিন্দু যুব বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
অসন্তোষ বিজেপির শক্তি বাড়িয়েছে
২০১৪ সাল নাগাদ আদিত্যনাথের সংগঠন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার পালনের জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবিরাম হামলার মাধ্যমে ধর্মান্ধদের সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়। উত্তর প্রদেশের (ইউপি) বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গার ঘটনায় লাভবান বিজেপি ৮০টি পার্লামেন্টারি আসনের মধ্যে ৭১টি লাভ করে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম করে। ২০০২ সালে মোদির বিরুদ্ধে গুজরাটের দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল। তিনি তখন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
মার্চে উত্তর প্রদেশ বিধান সভার নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসন পায় বিজেপি। যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। হিন্দু যুব বাহিনীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার ভূমিকা অব্যাহত থাকে। এ বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে গোরখপুরে ও ২০০৫ সালে মাউতে ভয়াবহ দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার জন্য ফৌজদারি মামলা করা হয়।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থার উদ্দেশ্য তাদের অধীনস্থ করে রাখা। যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর হিন্দু ধর্মান্ধ রাজনীতি বৈধতা পেয়েছে।
ধর্মান্ধ রাজনীতি থেকে উঠে আসা নেতারা কর্তৃত্বপরায়ণ , কারণ তারা ঘৃণা, ক্রোধ ও সহিংসতার ফসল। তাই তাদের কঠোর ও সিদ্ধান্তমূলক হওয়া প্রয়োজন। তারা মনে করে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানকে তারা ততটুকুই মানে যতটুকু তাদের মানা প্রয়োজন।
হুমকির মুখে ব্যক্তি স্বাধীনতা
উত্তর প্রদেশে শুরু। সারা ভারতব্যাপী মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ভোগ করতে অক্ষম। যেমন কোথায় যেতে হবে, কার সাথে বন্ধুত্ব ও বিয়ে হবে, অথবা কি খেতে বা বলতে হবে ইত্যাদি। বর্তমান সরকারের আমলে জনগণকে স্বাভাবিক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হতে বাধা দেয়া হচ্ছে।
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউপি পুলিশ দাবি করে যে রোমিও বিরোধী অভিযানে তারা এক মাসে প্রায় ৭ লাখ ৫ হাজার লোককে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক লোককে সতর্ক করেছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ইউপির নয়া মুখ্যমন্ত্রী কসাইখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন যার ধারাবাহিক প্রভাব হিন্দু প্রাণকেন্দ্রে পড়েছে এবং কেন্দ্র সরকারকে প্রাণিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধ আইনের আওতায় নতুন আইন প্রণয়ন করার দিকে অগ্রসর করেছে।
নতুন আইনের প্রভাবে মাংস শিল্প বিলুপ্ত হয়েছে, লাখ লাখ মুসলমান ও দলিতকে জীবিকার্জন ও খাদ্যের সস্তা উৎস থেকে বঞ্চিত করেছে। অন্য কথায়, সংস্কৃতি বা সংবিধান নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একজন নির্বাচিত নেতা নাগরিকদের খাদ্য ও কাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে সক্ষম।
কোনো কর্তৃত্ববাদী এবং সর্বদলীয় শাসনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে আগেরটিতে কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। ভারতে বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া এ শ্রেণিতে পড়তে পারে। যাহোক, বর্তমান সরকার সবগুলোকে শক্তিহীন করার চেষ্টা করেছে।
হাইকোর্টের স্বাধীনতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল
সরকার বিভিন্ন হাইকোর্টে নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়ামের সুপারিশকৃত ৭৭টি নামের মধ্যে ৪৩টিই প্রত্যাখ্যান করে। সরকার বিচারকদের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে।
৮ নভেম্বর রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাথে আলোচনা না করেই মোদি দেশের ৮৬ শতাংশ মুদ্রা বাতিল করেন যার ফলে মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয় , দেশে গোলযোগ দেখা দেয় এবং সারা দেশে ১৫০ জন লোকের মৃত্যু ঘটে। অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন একে স্বৈরাচারী পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেন।
সরকারী দলের মুখপাত্র একটি সরাসরি সংবাদ অনুষ্ঠানকে পক্ষপাতিত্বের জন্য অভিযুক্ত করার পর সরকার টিভি নিউজ চ্যানেল এনডিটিভি-র অফিসে হানা দেয়। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ফালি নরিমান এ হানাকে পুনরায় মিডিয়ার বৈধতাহরণের কাজ বলে বর্ণনা করেন।
যে সমাজে সহিংসতাকে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে আইনসঙ্গত করা হয় , সেখানে আইনের শাসন, শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের বিনিময়ে স্বৈরাচারী প্রবণতা উদ্ভূত হয়। যাহোক, বহুত্ববাদ ও গান্ধীর উত্তরাধিকারের ভারতের দীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে এই বিচ্যুতিকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করা হতে পারে যা দেশে অতিরিক্ত যুদ্ধরেখা আঁকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ