Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়

| প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের ক্ষমতা রদ করে তা’ সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের উপর ন্যাস্ত করা হল। গত সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রীমকোর্টের ৭ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপীল বিভাগের পূর্নাঙ্গ বেঞ্চ সব সম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজের এই রায় প্রকাশ করেন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগের মধ্যে একটি অনাকাঙ্খিত টানাপোড়েনের আইনগত পরিসমাপ্তি ঘটল। যদিও রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ তথা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, উচ্চ আদালতের আইনজীবী মহল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষনা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে কোন রকম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া না জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকারের প্রত্যাশার বিপক্ষে দেয়া সুপ্রীমকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কোন ধরনের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া না জানানোর সরকারের নীতিগত অবস্থান সার্বিকভাবে ইতিবাচক।
বাহাত্তুরের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যাস্ত করা হলেও পঁচাত্তর সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তা’ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক ফরমান জারি করে বিচারপতি অপসারনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির স্থলে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের উপর অর্পণ করেন। সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদের নির্দেশাবলীতে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ জেষ্ঠতম বিচারপতিদের সমন্বয়ে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রক্রিয়া নির্ধারিত রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, জনগনের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আইনপ্রণেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের উৎস হলেও জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠদলের একাধিপত্য, রাজনৈতিক দলাদলি ও বিভক্তির বাস্তবতায় উচ্চাআদালতের বিচারপতি অপসারনের মত স্পর্শকাতর বিষয়ে ন্যায়ানুগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত রাখা অসম্ভব। এ কারণেই সংবিধান রচয়িতা ড. কামাল হোসেনসহ দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ১০জন অ্যামিকাস কিউরির ৯ জনই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বলবৎ রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। সর্বোপরি ষোড়শ সংশোধণী বাতিলের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা ও স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট আইনবিদরা মনে করেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ইস্যুতে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে এক ধরণের টানপোড়েন ও সাংঘর্ষিক অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। এ সময়ে প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও মতপার্থক্য ও দূরত্ব এড়িয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাজের ও দায়-দায়িত্বের সমন্বয় নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের আচরণ ও চাকুরী শৃঙ্খলার বিধিবিধানের গেজেট প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের গড়িমসি, সময়ক্ষেপন এবং বার বার সময় প্রার্থনার প্রেক্ষাপটে আদালতে এটর্নি জেনারেলকে বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিচারপতির কঠোর মন্তব্য শুনতে হয়েছে। সংসদে ষোড়শ সংশোধনী পাস হওয়ার পর বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে সংঘাত ও জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছিল। রায়ের পূর্নাঙ্গ কপি পাওয়ার পর আওয়ামিলীগের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে তাৎক্ষনিকভাবে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে আওয়ামিলীগের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যা’ই হোক,  রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এবং বিচারপতিঅপসারনের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত করে দেয়া রায়ের পর প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক মন্তব্য থেকে সে আশঙ্কা অনেকাংশেই দূরিভূত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। পাশাপাশি নিরপেক্ষ আইনজীবী মহল এবং বিরোধিদলের পক্ষ থেকেও এই রায়কে স্বাগত জানানো হয়েছে। রাজনৈতিকদলগুলোর অবস্থান যা’ই হোক, দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের প্রতি জনগনের আস্থা অক্ষুন্ন রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় এ ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ও ঐতিহাসিক রায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এই রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং বিচারপতি ও বিচার বিভাগের কাছে মানুষের প্রত্যাশার আরো জোরালো প্রতিফলন ঘটবে বলে আমরা মনে করি।      



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন