Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষণ জোয়ারে ডুবেছে চট্টগ্রাম

| প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম


জনজীবনে অচলদশা : পাহাড় কাটা বালি-মাটিতে বসতঘর রাস্তাঘাট সয়লাব : বন্দরের বহির্নোঙরে কাজ বন্ধ : পাহাড় ধসের সতর্কতা
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো : আকাশ ভেঙে যেন নামে বৃষ্টি। সেই সাথে সামুদ্রিক জোয়ার। আষাঢ়ের বৈরী আবহাওয়ায় গতকাল (সোমবার) বন্দরনগরী ও জেলা চট্টগ্রামে স্বাভাবিক জনজীবনে নেমে আসে অচলদশা। মহানগরীর অনেক এলাকায় কোমর সমান পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রোববার রাত থেকে কখনও থেমে কখনও একটানা বর্ষণের সাথে গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ জোয়ার শুরু হলে নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়। এ অবস্থায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। পাহাড়-টিলায় অবৈধভাবে কাটা বালি-মাটির সাথে আবর্জনা ও ঢলের পানিতে বসতঘর, সড়ক, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গুদাম, আড়ত, অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ সয়লাব হয়ে গেছে। গতরাত পর্যন্ত অনেক জায়গায় কাদা-জঞ্জাল সরাতে গিয়ে হয়রান হতে হয় হাজারো পরিবারকে। নগরীতে ঢলের তোড়ে খালে ভেসে মারা গেছেন একজন সাবেক কর্মকর্তা। নগরীজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল। কর্মমুখী মানুষজন ও যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। নগরীতে হকার, দিনে এনে দিনে খাওয়া ও নি¤œআয়ের মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। সবজিসহ কিছু কিছু নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে।  
অতিবর্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামা, ডেলিভারি পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরে বাড়ছে জট। আর বহির্নোঙরে আমদানিকৃত খোলা ও বস্তাজাত পণ্যসামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল লাইটারিং কার্গোজাহাজে খালাস কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। অতিবর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে পাহাড়ি ভূমিধসের সতর্কতা বহাল রয়েছে। ভূমিধসের আতঙ্ক বিরাজ করছে এসব এলাকায়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১৩৮ মিলিমিটার। আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এই সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের অধিকাংশ স্থানে মাঝারি থেকে ভারী, কোথাও কোথাও অতিভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে পানিবদ্ধতায় ফের জনদুর্ভোগের জন্য চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে গতকাল বলেছেন, প্রকৃতির সাথে তো যুদ্ধ করা যায় না। নগরীর পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চলছে বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি।   
গতকাল দিনভর ভারী বর্ষণের সাথে বিকেলে ভরা জোয়ার শুরু হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর অনেক এলাকায় কোমর এমনকি বুক-সমান ডুবে যায়। জোয়ারের উল্টো চাপে পানি নামতে না পারায় সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতা। এ অবস্থায় হাজার হাজার বাড়িঘর, দোকানপাট, গুদাম, আড়ত, বাজার, মসজিদ, রাস্তাঘাট, অলিগলিতে বিশেষত পাহাড়ের বালি-মাটি ও কাদাপানি জমে গেছে। নগরীজুড়ে জনদুর্ভোগ পৌঁছে চরমে। প্রচুর মালামাল বিনষ্ট হয় শত শত দোকান, গুদাম, আড়তে। বৈরী আবহাওয়া ও পানিবদ্ধতার কারণে যানবাহনের অভাবে কর্মস্থল ও ফের ঘরমুখী মানুষকে সারাদিন ভোগান্তি পোহাতে হয়। ভারী বর্ষণ ও জোয়ার একত্রিত হয়ে মহানগরীর কালুরঘাট, মোহরা, চান্দগাঁও, কাপ্তাই রাস্তা, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে শুরু করে চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, শোলকবহর, প্রবর্তক, পাঁচলাইশ, মেহেদিবাগ, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, আগ্রাবাদ, হালিশহর, সাগরিকা, পতেঙ্গাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। প্লাবিত ও ভাঙেিচারা সড়ক রাস্তাঘাটে যানবাহন চলেছে হাতেগোনা। নগরীতে পাহাড়-টিলা কাটার কারণে পাহাড়-ধোয়া বালিমাটিতে রাস্তাঘাটে ঢিবি তৈরি হয়।
প্রবল বর্ষণের সময় রোববার রাতে নগরীর দামপাড়া মোহাম্মদ আলী রোডে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ঘরে ফেরার সময় রাস্তায় পানির তোড়ে খালে পড়ে যান সাবেক একজন হিসাব কর্মকর্তা শিলব্রত বড়ুয়া স্বপন (৬০)। দশ ঘণ্টা ধরে নির্খোজ থাকার পর গতকাল সকালে তার লাশ ভাসমান অবস্থায় চাক্তাই খালে পাওয়া যায়। শিলব্রতের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। তিনি রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।     
এদিকে প্রবল বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং খালাস ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায় সকাল থেকেই। লাইটার কার্গোজাহাজ মালিকদের সংগঠন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ ইনকিলাবকে জানান, বহির্নোঙরে ৩৫টি মাদার ভেসেলে বৈরী আবহাওয়ায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব জাহাজে বাহিত আমদানি পণ্যসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে গম, সার, পাথর, সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, র-সুগার প্রভৃতি। গতকাল কোন লাইটার কার্গোজাহাজ বুকিং দেয়া হয়নি।
তাছাড়া বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড, শেড এবং বেসরকারি আইসিডিগুলোতে স্বাভাবিক কাজে ভাটা পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাবে বন্দরে পণ্য ও জাহাজের জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্দর-নির্ভর শিপিং প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কাজের গতি মন্দা। দিনে স্বাভাবিক সময়ে তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার কন্টেইনার যেখানে ডেলিভারী হয়ে থাকে ঈদ থেকে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।
পাহাড়ধসের সতর্কতা বহাল              
বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ুমালার সক্রিয় প্রভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ কারণে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভ‚মিধসের আশঙ্কায় সতর্কতা বহাল রেখেছে আবহাওয়া বিভাগ।
তিনটি ফ্লাইট নামতে পারেনি      
বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতকাল তিনটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামতে পারেনি। এসব ফ্লাইট ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরমধ্যে দু’টি আন্তর্জাতিক এবং একটি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ইউএস বাংলার একটি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, সউদী আরবের জেদ্দা থেকে আসা বিমানের ফ্লাইট এবং দোহা থেকে আসা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট চট্টগ্রামে অবতরণ করতে না পেরে ঢাকায় অবতরণ করে। যাত্রীদের বিশেষ ব্যবস্থায় চট্টগ্রামে আনার প্রক্রিয়া চলে। জেদ্দা থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটে অধিকাংশই ছিলেন মাহে রমজানে ওমরাহ পালনে যাওয়া যাত্রী।  
অব্যাহত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস     
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত আরও ২-৩ দিন অব্যাহত থাকবে বলে আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড খেপুপাড়ায় ২৩৩ মিলিমিটার। এ সময় ঢাকায় ৫২, ময়মনসিংহে ৪৮, চট্টগ্রামে ১৩৮, সিলেটে ১১, খুলনায় ৭৩ মিমি বর্ষণ হয়।   
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ বা বলয় ভারতের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে জোরদার অবস্থায় রয়েছে।
আজকের (মঙ্গলবার) পূর্বাভাসে জানা গেছে, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। এর পরের ৫ দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।
এদিকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য তিনটি জেলা ও কক্সবাজারে অতিবর্ষণের পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকায় পাহাড়-টিলায় ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিংসহ প্রশাসনের বিভিন্ন তৎপরতা চলছে।



 

Show all comments
  • আলমগীর ৪ জুলাই, ২০১৭, ১১:৫৬ এএম says : 0
    পানিবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরাসনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষণ

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ