ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আবুল কাসেম হায়দার
উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষিত বেকার হচ্ছে ৯ শতাংশ। ¯œাতক বা এর বেশি ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা অধিক। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ বেড়েছে। তাই বেকারের সংখ্যাও বেশি। বিবিএস-এর শ্রম জরিপ ২০১৫-১৬ অনুযায়ী দেশে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পায়নি। তাই বেকারর সংখ্যা সর্বক্ষেত্রে বেড়েছে। কর্মসংস্থান কম হওয়াতে দেশে বিভিন্ন স্তরে বেকার যুবকের সংখ্যাও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে আছে। গত দুই অর্থবছরে তা ৭ শতাংশ পেরিয়েছে। এত প্রবৃদ্ধি হলেও তা কর্মসংস্থান বাড়াতে পারছে না, বরং আগের তুলনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি কমেছে। এক দশক আগে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান বাড়ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এখন তা কমে ৯ লাখ ৩৩ হাজারে নেমেছে।
বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কাজ করে এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৫ লাখ। এর আগের ২০১৩ সালের জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। বিবিএস বলছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত দেড় বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১৪ লাখ, যা নতুন কর্মসংস্থান বলে মনে করে বিবিএস। এতদিন পঞ্জিকাবর্ষ ধরে শ্রমশক্তি জরিপ করা হলেও এবারই প্রথম অর্থবছর ধরে জরিপ করা হয়েছে। জরিপে অর্থবছরের (২০১৫-১৬) চার প্রান্তিকের গড় হিসাব করা হয়েছে। তাই ওই অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় ধরা যুক্তিযুক্ত হবে। সেই হিসাবে দুই জরিপের ব্যবধান দুই বছরই হবে। জাহিদ হোসেনের হিসাব বিবেচনায় আনলে ওই সময় প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ কর্মসংস্থান বেড়েছে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হিসাব সম্পর্কে একটি হিসাবে গরমিল আছে বলে মনে হচ্ছে। হতে পারে এত প্রবৃদ্ধি হয়নি, তাই কর্মসংস্থান কম হয়েছে। নতুবা প্রবৃদ্ধি ঠিকই হয়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান এত বাড়েনি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম বড় খাত। কিন্তু রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর এই খাতে খুব বেশি নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তৈরি পোশাক খাত আর আগের মতো শ্রমঘন নেই। মানুষের পরিবর্তে মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে।
শ্রমশক্তি জরিপে এবারই প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক চিত্র দেওয়া হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চার প্রান্তিকের মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বর এই প্রথম প্রান্তিকেই কর্মসংস্থান কম বেড়েছে। আর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে। এর মানে হলো জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে, অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে কাজ পাওয়া কঠিন। এটি কাজের মন্দা মৌসুম। আর শীতে কাজের সুযোগ বেশি থাকে। নতুন শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগও পান না। বেকারত্বের এই হিসাব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেওয়া মানদÐ অনুযায়ী। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
তবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, ৯ শতাংশ। এর মানে হলো স্নাতক কিংবা এর বেশি ডিগ্রিধারী প্রতি ১০০ জনে ৯ জন বেকার। এ দেশে পড়াশোনা না করলেই কাজ পাওয়ার সুযোগ বেশি। কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি বেকার। ২০১৩ সালের হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার।
আইএলওর ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড এশিয়া প্যাসিফিক ও আরব স্টেটস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্কিয়। তাঁরা পড়াশোনা করছেন না, আবার কাজও করছেন না। কিংবা কাজ খুঁজে পেতে কোনো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না। এ ধরনের নিষ্ক্রিয় তরুণদের হার বিবেচনা করলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ তৃতীয় খারাপ অবস্থানে আছে। একদিকে এসব নিষ্কিয় তরুণ, অন্যদিকে কাজের আশায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে দেশের তরুণেরা সমুদ্রপথে পারি দিচ্ছেন। জরিপ অনুযায়ী, এখন বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি বেকার। নারীদের বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। নারী ও পুরুষ উভয়েই ১৩ লাখ করে বেকার।
শ্রমশক্তি ও কর্মসংস্থান: শ্রমশক্তি জরিপে কর্মসংস্থানের চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ আছেন ৬ কোটি ২১ লাখ। তাঁরা কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকেন। তবে এই হিসাবে, পড়াশোনা করেন কিংবা অসুস্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজের জন্য প্রস্তুত নন, তাঁরা এই শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হন না। এই শ্রমশক্তির ৫ কোটি ৯৫ লাখ কাজ করেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ১৮ লাখ এবং নারী ১ কোটি ৭৮ লাখ। বাকিরা বেকার। এ দেশের ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। আর আনুষ্ঠানিক খাতে মাত্র ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কাজ করেন। দেশের কৃষি খাত এখনো কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এ খাতেই প্রায় ৪৩ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। ২০ শতাংশ কাজের ক্ষেত্র হলো শিল্প খাত। এ ছাড়া সেবা খাতে প্রায় ৩৭ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়।
দুই বছরের ব্যবধানে নারী ও পুরুষ উভয়ের গড় মজুরি বা আয় বেড়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, পুরুষদের চেয়ে নারীরা কম আয় করেন। নারীদের গড় আয় ১২ হাজার ১০০ টাকা। ২০১৩ সালে আয় ছিল ১০ হাজার ৮১৭ টাকা। এখন একজন পুরুষ গড়ে ১৩ হাজার ১০০ টাকা আয় করেন, দুই বছর আগে ছিল ১১ হাজার ৭৩৩ টাকা। এখনো শ্রমশক্তিতে অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ মানুষ বেশি, তাঁরা মজুরি কম পান। এর মানে হলো আমরা শোভন কাজ বা চাকরি দিতে পারছি না। এ ছাড়া প্রতিবছর কমপক্ষে দশ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য কাজ দেওয়ার সুযোগ সীমিত। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশ বাড়লেও তা এখনো কম। নারীর অংশগ্রহণ এখনো মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ করা হলে কর্মসংস্থান কৌশল নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের জন্য সহায়ক হবে।
কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধির উপায়: ১. এই জরিপ হওয়াতে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণে চিন্তার অনেক খোরাক হয়েছে। দেশে প্রতি বছর প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি অনুযায়ী কর্মসংস্থান সেই হারে বৃদ্ধি পায়নি। তার মূল কারণ দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বেশ কম হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা ছাড়া শুধু প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে এবং অসুবিধাগুলো দূর করতে হবে। তবেই বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তবেই বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
২. বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশে একটি রাজনৈতিক ভীতি কাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শান্তি নাই। দেশে রাজনৈতিক শান্তি স্থাপন করতে হবে। দ্রæত একটি গ্রহণযোগ্য, সকল দলের অংশ গ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ স্বচ্ছ জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই দেশে রাজনৈতিক অশান্তি অনেকটা দূর হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে। বিনিয়োগকারীরা তখন বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবেন।
৩. দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ আশানুরূপ না হওয়ার কারণ হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের স্বল্পতা। শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্যাস, বিদ্যুতের অভাবে সম্প্রসারণ করতে পারছে না। নতুন নতুন শিল্প কারখানা হওয়ার জন্য চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস তো পাওয়াই যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যুৎও পাওয়া বড়ই কঠিন। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে বিনিয়োগের হাওয়া ভালোভাবে শুরু হবে।
৪. দেশে ব্যাংকের সুদের হার ও চার্জ দুনিয়ার সকল দেশের চেয়ে বেশি। এখনও ১০ থেকে ১৪ শতাংশ হারে ব্যাংক সুদের হার শিল্প মালিকদের প্রদান করতে হচ্ছে। অত্যধিক সুদের হারের কারণে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না। এত বেশি সুদ প্রদান করে বাংলাদেশে লাভ করা বড়ই কঠিন। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বেশ হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার ৭ শতাংশ এগিয়ে আনতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে।
৫. বিবিএস-এর শ্রম শক্তি জরিপ আমাদেরকে উল্লেখিত বিষয়সমূহকে বেশি বেশি মূল্যায়ন করে অগ্রসর হওয়ার তাকিদ দিচ্ছে। মানুষের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি না হয়ে সংকুচিত হচ্ছে। তাই বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন প্রয়োজন উচ্চ শিক্ষার দিকে বেশি জোর না দিয়ে কারিগরি, ভোকেশনাল শিক্ষার প্রতি নজর দেয়া। বিদেশেও কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিতলোকের চাহিদা বেশি।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।