Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পে দুর্নীতি

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনস্ত বোর্ড, অধিদফতর, পরিদফতরগুলোতে দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ও কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার ব্যাপারে কর্মকর্তাদের আগ্রহ যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহ বরাদ্দের অর্থ ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। বলা হয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাবরে বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশটিই ‘পানিতে যায়’ বা লুটপাট হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং ঠিকাদাররা যোগসাজস করে এই অর্থ মেরে দেয়। প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে হয়না, মানসম্পন্নভাবে হয় না। সময় বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি পায়; এতে লুন্ঠনের পরিমাণ বাড়ে। মানসম্পন্নভাবে কাজ না হওয়ার কারণ  নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার; এরও প্রধান কারণ লুণ্ঠন। দুর্নীতি ও লুটপাট ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্পের কাজ হয় বা হতে পারে, একথা এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। সম্প্রতি হাওরাঞ্চলে হঠাৎ পানির সয়লাব এবং ফসলহানির ঘটনায় একবাক্যে অভিযোগ করা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধের কাজ সময় মত ও ভালোভাবে না কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে। অবিরাম বর্ষণ এবং উজান থেকে আসা ঢলের পানি বাঁধ ভেঙ্গে বা ছাপিয়ে হাওরের ধানক্ষেতে প্রবেশ করেছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে উঠতি ধান পানির নীচে তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলের মানুষ অভিযোগ করেছে, বাঁধ মেরামত ও রক্ষার কাজ যথাসময়েও টেকসইভাবে করা হলে এত বড় বিপর্যয় হতো না। ফসল হারিয়ে এভাবে তাদের নিরালম্ব ও সর্বস্বান্ত হতে হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে হাওরাঞ্চলে। সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়। সঙ্গতকারণেই দুর্নীতির বিষয়টিও সামনে এসে যায়। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ ও উম্মা প্রকাশ করেন। হাওরাঞ্চলের ফসলহানির সূত্র ধরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ৩ হাজার ৭শ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল প্রকল্পের দুর্নীতি খতিয়ে দেখার নিদের্শনা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলীকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওদিকে দুদকের পক্ষ থেকেও একটি কমিটি হয়েছে। হাওরাঞ্চলের পাঁচ জেলার দুর্নীতি দেখতে গঠিত হয়েছে আরো একটি তদন্ত কমিটি। ড. মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তার তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। অন্যান্য কমিটির কাজ চলছে।
কমিটিগুলোর সব রিপোর্ট হাতে এসে গেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসমূহে কোথায় কতটা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে তা হয়তো সকলের জানা সম্ভবপর হতে পারে; তবে শর্ত এই যে, সরকারকে তা জন-অবগতির জন্য প্রকাশ করতে হবে। আমরা জানি, অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তুু সব ক্ষেত্রে তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না। স্মরণ থাকার কথা, শেয়ারবাজারে ধস ও লুটপাট নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত কমিটি রিপোর্টও দিয়েছিল। কিন্তুু সে রিপোর্ট কখনোই আলোর মুখে দেখেনি। কোনো বিচারাচার হয়নি। লুটেরারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। কখনো কখনো তদন্ত রিপোর্টের বিষয়বস্ত জানানো হয়। কিন্তুু সুপারিশমালা আর কার্যকর হয় না। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ২২টি কারণ ও ৩৬টি সুপারিশ করেছিল, যার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। যদি হতো তাহলে এবারে পাহাড় ধসে হয়তো এত মানুষের মরণ হতো না। কাজেই তদন্ত কমিটি গঠন, দুর্নীতি অনুসন্ধান বড় কথা নয়, বড় কথা হলো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও দুদকের পক্ষ থেকে যে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে, তা  দ্রæত সম্পন্ন করে প্রকাশ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বোর্ড, দফতর, পরিদফতরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যেহেতু নতুন নয় এবং মন্ত্রীও অভিযোগ অস্বীকার করেননি সুতরাং দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব করা যাবে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭টি ড্রেজার কেনার সময় যে দুর্নীতি হয় তার খেসারত হিসাবে ড্রেজারগুলো অচল হয়ে আছে এবং তাতে ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। সাড়ে চারশ’ কোটি টাকার এসব ড্রেজার কেনার সময় সকল যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়। উন্নত দেশের যন্ত্রাংশ দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় যশোরের ওয়ার্কশপে তৈরি  যন্ত্রাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। বাঁধ ও নদী সংক্রান্ত যত কাজ রয়েছে তার প্রায় সবই এই মন্ত্রণালয়ের অধীন। উপকূল রক্ষা বাঁধ ও শহর রক্ষা বাঁধসহ সকল রক্ষাবাঁধ, নদী নিয়ন্ত্রণ, নদী ড্রেজিং ইত্যাদি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন। বাঁধসমূহ নির্মাণই শুধু নয়, এদের সংস্কার-মেরামত ইত্যাদিও তার দায়িত্বের অন্তগর্ত। অত্যন্ত দু:খজনক, বাঁধের কাজ, পানির কাজ, নদীর কাজ সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে সরকারী অর্থের অপচয় হচ্ছে। প্রকল্পসমূহের উপকার ও সুবিধা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বাঁধগুলোর অবস্থা মোটেই ভালো নয়। উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলো এতটাই দুর্বল ও ভংঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে যে, মাঝারি ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ¡াস হলেই সেগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে। শহর রক্ষা বাঁধগুলোর অবস্থাও ভিন্ন নয়। সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি শহর রক্ষা বাঁধ বর্ষা এলেই হুমকির মুখে পতিত হয়। এসব বাঁধ টেকসই ও স্থায়ীভাবে নির্মাণ এবং নিয়মিত তদারকি আজও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নদী পুন: খনন, সংস্কার, ড্রেজিং যে কত জরুরি, নদনদীর নাব্যতা হ্রাস ও নৌপথ কমে যাওয়া থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়। অথচ এক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে কোনো কাজ হচ্ছে না। পরিকল্পনার কমতি নেই। কিন্তুু কাজ সেভাবে হচ্ছে না; যা-ও বা হচ্ছে মানসম্পন্নভাবে হচ্ছে না, যথাসময়ে হচ্ছে না। জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকার অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে। যে কোনো মূল্য ও প্রক্রিয়ায় এই অপচয়-লুণ্ঠন বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধানে যে-উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আশা করি, এর মধ্য দিয়ে মন্ত্রণালয়, বোর্ড দফতর, পরিদফতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা অত্যন্ত জরুরি।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন