Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীন কি বিশে^র পছন্দনীয় পরাশক্তি হতে চলেছে

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি আটলান্টিক ঃ চীন আজ বিশে^র সবচেয়ে বড় পছন্দসই পরাশক্তি হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ইউরোপ সফরের সাথে চীনের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং-এর সফরের তুলনা করুন। লি জার্মানি ও বেলজিয়াম সফরের পর বুধবার বার্লিনে অবতরণ করেন। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাতৃা সংস্থা সিনহুয়ার মতে, একটি খোলা অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং বৈশি^ক আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন প্রদানে তিনি তার তিনদিনের সফরকে কাজে লাগাবেন বলে ধারণা। অন্যদিকে ট্রাম্প ন্যাটোকে সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, জার্মানিকে তার বাণিজ্য নীতির জন্য খুব খারাপ বলে সমালোচনা করেছেন এবং মনে হয়েছে গ্রæপ ফটো তোলার সময় মন্টেনিগ্রোর প্রধানমন্ত্রীকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার লি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রতি চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। বৃহস্পতিবার পরের দিকে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ত্যাগ করবে।  এ বক্তৃতায় ট্রাম্প তার আমেরিকা প্রথম নীতি পুনর্ব্যক্ত করেন। অন্যদিকে লি ইউরোপে তার বৈঠক ও বক্তৃতায় সাফল্যের সাথে চীনকে একটি উদার, দায়িত্বশীল , বিশ^বাদী শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেন।
তা সত্তে¡ও এসব ঘটনায় ধারণাই বাস্তবতা নয়। চীন একটি অনুদার, কর্তৃত্বপরায়ণ দেশ, ৬৮ বছর ধরে কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত। যুক্তরাষ্ট্র তার সকল দোষত্রæটি সত্তে¡ও বিশ্রে অধিকাংশ দেশের জন্য অনেক বেশী প্রাকৃতিক অংশীদার। এটি একটি স্থিতিশীল, বহুদলীয় সবল গণতন্ত্রের দেশ, বৈশি^ক হস্তক্ষেপের কয়েক দশকের  অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, তার রয়েছে মানবাধিকার ও মুক্ত বাণিজ্য রক্ষার গৌরবময় ঐতিহ্য ( সব সময় কাজে না হলেও কথায় তো বটেই)। চীনের এসব কিছুই নেই। কিন্তু ট্রাম্পের গোলমেলে প্রেসিডেন্সির কারণে , উপর্যুপরি বিপর্যয়কর পররাষ্ট্র নীতির ফলে এবং মার্কিন মিত্রদের সরিয়ে নিতে বেইজিংয়ের সমন্বিত চেষ্টার পরিণতিতে সম্প্রতি হৃদয় ও মন জয়ের বৈশি^ক যুদ্ধে চীন জয়ী হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।
গত এক দশক বা এ রকম সময়ে কোনো জোট গঠনের পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছে।  ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি না আসা পর্যন্ত তা ভোঁতা কৌশল বলেই মনে হয়েছে ( যদিও তা কয়েকদশক দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতাবাদী বৈদেশিক নীতির চেয়ে ভালো ছিল।) দেশগুলো কেন বেইজিং-এর সাথে আজ্ঞাবহ সম্পর্ক পছন্দ করবে যেখানে ওয়াশিংটন তাদের গ্রæপ নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অনকূল বাণিজ্য নীতি মঞ্জুর করে? অন্য কথায় দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশ অথবা এমনকিÑ যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে , জার্মানি বা ফ্রান্স কি এমনটি মনে করবে যে ওয়াশিংটন নয়Ñ বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কই তাদের স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা করবে?
যাহোক, গত নভেম্বর থেকে আমেরিকা ও চীনের স্ব স্ব কৌশল ও বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটেছে। অভিষেক বক্তৃতার মত ট্রাম্পের কিছু বক্তৃতা ( এখন এ মুহূর্ত থেকে আমেরিকাই প্রথম নীতি হতে যাচ্ছে) এবং কাজ আমেরিকার মিত্রদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এবং তার চার মাসের গোলমেলে পররাষ্ট্র নীতি, সেই জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার রূঢ় ও বিপর্যয়কর ফোনালাপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের  প্যারিস জলবায়ু চুক্তি পরিত্যাগ তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
আন্তর্জাতিক বা অন্যভাবে এর ফল হয়েছে যে মিত্র ও বন্ধু দেশগুলো কমপক্ষে বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করেছে। ট্রাম্পের ইউরোপ ট্রিপের প্রেক্ষিতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের জবাব বিবেচনা করুন। মার্কেল রোববার বলেন, ইউরোপে মহাদেশের উচিত আমাদের ভাগ্যকে আমাদের নিজের হাতে তুলে নেয়া।  তিনি আরো বলেন, অন্যদের উপর আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতার দিন শেষ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার লি’র সাথে বৈঠকের পর তিনি জোর দিয়ে বলেন, চীন এক অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত অংশীদারে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ^ অনিশ্চয়তার এমন সময়ে বাস করছি এবং আমরা সকল আলাদা ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারিত্ব সম্প্রসারিত করার ও আইনের ভিত্তিতে একটি বিশ^ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেখতে পাচ্ছি।  মার্কেলের মন্তব্য পরোক্ষভাবে ট্রাম্পকে শুধু তিরস্কারই করেনি, সে সাথে এমন আশাও প্রকাশ করা হয়েছে যে চীন আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কিছু দায় বহন করবে যেগুলো থেকে আমেরিকা সরে আসতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে ট্রাম্পের প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার নয়া প্রেসিডেন্টের ইষদুষ্ণ বার্তার বিষয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে যেতে অস্ট্রেলিয়ায় বিতর্কের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী পল কিটিং এপ্রিলে বলেন, আত্মনির্ভরশীলতা ও নিজেদেরকে নিজেরা সাহায্য করা আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয় হওয়া উচিত।   
বেইজিং এ সব দেশকে একটি বিশ^ শৃঙ্খলার আওতায় আনার কাঠামো প্রদান করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর সূচিত বাণিজ্য উদ্যোগ Ñ ওয়ান বেল্ট , ওয়ান রোড। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল চীনের পুরনো সিল্ক রোড ট্রেডিং রুট চালু যাতে চীন আরেকবার বিশ^ অর্থনীতির কেন্দ্র হতে পারে। মে মাসে বেইজিংয়ে এ উদ্যোগ বিষয়ে  আয়োজিত এক ফোরামে অন্যান্য নেতাদের মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও যোগ দেন।  এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ডজনখানেক দেশের কর্মকর্তারাও অংশ নেন। চীন জাতিসংঘের মত বিদ্যমান কাঠামোর উপরও তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। চীন এখন জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাজেটের দ্বিতীয় বৃহৎ দাতা দেশ এবং এমনকি বেসরকারীভাবে এই জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করে যেখানে শি জিনপিং নিজেকে বিশ^ায়নের ‘ প্যাট্রন সেন্ট’ হিসেবে প্রদর্শন করেন।
কিছু বিশিষ্ট ঘটনায় মিত্র বা বন্ধু দেশগুলো কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার অর্থ অবশ্যই এ নয় যে চীনের সাথে তাদের নৈকট্য ঘটছে। জাপান, ভারত ও জার্মানি সহ কিছু দেশ তাদের পররাষ্ট্র নীতি আরো বহুমুখী করতে চাইছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতির সহনশীলতার পরীক্ষায় অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ট্রাম্প ও লি’র সফরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান। এবং এ পন্থা এখনো চীনকে উপকৃত করছে যেখানে বহু শীর্ষস্থানীয় কৌশলগত চিন্তকের আশংকা যে আমেরিকার জোট চীনকে দমন করতে চায় ঠান্ডা লড়াইকালে যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আমেরিকার কৌশল।
বেইজিং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অবজ্ঞার শিকার দেশগুলোর উষ্ণ অভিনন্দনই গ্রহণ করছে না, সে সহিক্রয়ভাবে আমেরিকার মিত্রদেরকে চীন থেকে দূরে রাখারও চেষ্টা করছে যাতে তাদের উপর তার ক্ষমতা বিস্তার করা যায়। এর প্রধান উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। এ বছরের গোড়ার দিকে সিউল থাড ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। এ ঘটনায় বেইজিং অর্থনৈতিকভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। সে দু’দেশের মধ্যে পর্যটন হ্রাস করেছে এবং কিছু কোরীয় ব্যবসা চীনে বর্জনের সম্মুখীন হয়েছে।
সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাবেক উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বর্তমানে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সে কর্মরত এলি রাটনার বলেন, এশিয়াতে আমরা একটি অঞ্চল দেখতে পাচ্ছি যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে পলায়মান অঞ্চল হিসেবে বেইজিংয়েরও প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে ভীত।  তিনি বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রকে অবমূল্যায়ন করি না।
বেইজিং চায় দক্ষিণ কোরিয়া থাড অপসারণ করুক। কিন্তু সে সিউলকে মিত্র হিসেবে চায় না। কেন? কারণ বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও এমন একটি দেশ যে একুশ শতকে বিশে^ প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়, তার কোনো মিত্র নেই। চীনের কূটনীতিক ও পন্ডিতরা এমনকি দু’ প্রতিবেশী দেশ উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তানকেও মিত্র হিসেবে গণ্য করেন না যদিও দু’দেশের সাথেই ঐতিহাসিক উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। এর অংশ বিশেষ সময়ের সাথে সম্পর্কিত।  রাটনার বলেন, ১৯৯০ ও ২০০০-র দশকে চীন যখন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল তখন যেসব দেশের কাছে সে অত্যন্ত কাক্সিক্ষত ছিল তারা হচ্ছেঃ ভেনিজুয়েলা, ইরান, বার্মা, জিম্বাবুয়ে ও সুদান। কিন্তু পরে অবস্থা সে রকম থাকেনি। তার মানে এই নয় যে চীন আজ কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, বরং সে অবস্থা অনেক দূরে। বিশ^ব্যাপী আর্থিক সংকটের প্রেক্ষিতে বেইজিং মনে হয় উপলব্ধি করতে পেরেছে যে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার সাথে সে নিজেকে আরো সংশ্লিষ্ট করাই লাভজনক যা বৈশি^ক প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে দেবে।
হ্যাঁ, কিছু ঘটনা এ ধারা পাল্টে দিতে পারে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের লোকদের মত নোংরা , বর্বরোচিত, কিন্তু সংক্ষিপ্ত হতে পারে। অধিকতর ভাবে তৎপর আমেরিকা ট্রাম্প আমেরিকান জোটের যে ক্ষতি করেছেন সে ক্ষতির প্রশমন করতে পারে। শি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে চীনের প্রথম প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর সুরাহা করা এবং কূটনৈতিক ভাবে সরে আসা এবং অযৌক্তিক দাবিকারী বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোকে সরিয়ে দেয়া। বেইজিং একটি অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে পারে যা কম্যুনিস্ট পার্টের কাছে ভীতিকর। এটি রাজনৈতিক ব্যাপার যা তাকে চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে দিতে পারে অথবা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে বাধ্য করতে পারে। এ সম্ভানা নির্ভর করে চীনের ক্ষমতা সম্প্রসারণের উপর।
২০১২ সালের জুনে এক সংলাপে এক উচ্চপদস্থ চীনা কূটনীতিক আমাকে বলেন, বেইজিং জোটে বিশ^াস করে না। বরং সে দেখে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে সম্পর্ক। কূটনীতিক বলেন,দু’দেশ প্রতিবেশীর মত। বেইজিংয়ের গাছপালা যখন বাড়ছে - বিশে^র সকল প্রান্তে চীনের এখন বৈধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ওয়াশিংটনের এ নয়া বাস্তবতা স্বীকার করা উচিত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ