Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চীন-ভারত-বাংলাদেশ জনসংখ্যা তথ্যে ভেল্কিবাজি!

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : বাংলাদেশে মুসলমান জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে; ২০৫০ সালে ভারতের জনসংখ্যা গণচীনকে ছাড়িয়ে যাবে ইত্যাদি গবেষণা তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। বর্তমান ভারতের অর্থনীতির ৫গুন বড় অর্থনীতির দেশ চীন যখন পরাশক্তি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম; তখন হঠাৎ ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধি থিউরি তুলে ধরার নেপথ্য রহস্য কী? বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা হ্রসের তথ্য প্রকাশ কেন? জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা যখন সর্বচ্চো ঘ্রিষ্টান ধর্মের জনসংখ্যাকে ছুঁই ছুঁই করছে; তখন হিন্দু জনসংখ্যাকে কাগজে কলমে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলার নেপথ্যের রহস্য বোঝা ঝানু কূটনীতিকদের পক্ষ্যেও দুঃসাধ্য। প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে জনসংখ্যা নিয়ে মাতামাতি কেন?
৯২ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের এই দেশে হঠাৎ করে মিডিয়ায় খবর বের হলো ৫ বছরে বাংলাদেশে মুসলমান জনসংখ্যার হার ০.৪ ভাগ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস্ ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করে। বিবিসিসহ দেশী বিদেশী  মিডিয়ায় এ খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় ব্যপক হৈচৈ। ফেসবুক-বøগ-টুইটার ব্যবহারকারীদের যারা এ নিয়ে মতামত দেন তাদের অধিকাংশই এ তথ্যকে ‘গাঁজাখুড়ি’ ‘মনগড়া’ হিসেবে অবিহিত করেন। আসলে কী বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা কমছে? প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গবেষক অধ্যাপক আবুল বারাকাত ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় জানিয়েছেন, বিগত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে। প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন এবং প্রতিদিন ৬৩২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী  দেশ ছেড়ে চলে যান। এসব পরিসংখ্যান ও তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন। তবে হঠাৎ করে এশিয়ার দেশগুলোর জনসংখ্যার অনুপাত, অর্থনৈতিক স্বক্ষমতা, সুপার পাওয়ার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে এসব নিয়ে এতো আলোচনা-বিতর্কের অবতারণা কারা করছে?
গবেষণা সংস্থা এইচএসবিসি গেøাবাল রিসার্চ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বের ২০৫০ সালের মধ্যে ‘উদীয়মান’ অর্থনীতির দেশগুলোয় অর্থনীতি ৫গুন বৃদ্ধি পাবে। এইচএসবিসি’র অর্থনৈতিক রিপোর্টে বৈশ্বিক অর্থনীতির এই পূর্বাভাস হলে ৩৫ বছর পর বিশ্বে ‘অনেক পরিবর্তন’ দেখা দেবে। বলা হচ্ছে ২০৫০ সালে ধনী রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় চীনের সম্ভাব্য ২৪.৬২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপি এবং ১৭,৭৫৯ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে ‘অবস্থান’ হবে এক নম্বরে। তারাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ২২.২৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপি ও ৫৫,১৩৪ ডলার মাথাপিছু আয় সত্তে¡ও সেরা ধনী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। তৃতীয় ধনী রাষ্ট্র হতে পারে ভারত। ভারতের জিডিপি ৮.১৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ও মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫,০৬০ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বার্তা দিচ্ছে তখন হঠাৎ করে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘জাতীয় জনসংখ্যা স্থিতিশীলতা’ প্রচার করে ৩৫ বছর পর ২০৫০ সালে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ চীনের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে ভারত। ওই সময় ভারতের জনসংখ্যা হবে ১৬৩ কোটি। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ চীন। ভারতের ওই রিপোর্টে বলা হয় দু’বছর আগে চীনের জনসংখ্যা যখন আনুমানিক ১৩৯ কোটি; তখন ভারতের জনসংখ্যা ১২৭ কোটি। প্রতিবছর ভারতের জনসংখ্যা ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হার অব্যহত থাকলে ২০৫০ সালে ভারতের জনসংখ্যা ১৬৩ কোটির ঘরে পৌঁছে যাবে। তখন চীনের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে ভারত। প্রশ্ন হলো এই ৩৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বাড়বে আর চীনের জনসংখ্যা কমে যাবে? নাকি চীনের নাগরিকেরা সন্তান জন্ম দেবেন না?
 আমেরিকার গবেষণা সংস্থা পিউ (ঢ়ব)ি রিসার্চ সেন্টার এক গবেষণায় বলেছে- বর্তমানে বিশ্বে জনসংখ্যার খবর হলো প্রথম খ্রিষ্টান, দ্বিতীয় মুসলিম ও তৃতীয় ধর্মহীন (যারা কোনো ধর্ম মানেন না)। কিন্তু ২০৫০ সালে বিশ্বে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটিতে পৌঁছবে। এর ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৪.৯ শতাংশ হবে হিন্দু জনসংখ্যা; যা তাদের তৃতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার অধিকারী করবে। ওই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যার বাসস্থান হবে এই ভারতবর্ষ। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের হিন্দুদের আধিক্য থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিমও এদেশেরই বাসিন্দা হতে পারে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা। ভারত সেটাকেই টপকাতে পারে। উল্লেখ চার দশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। পিউ-এর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ খ্রিস্টান জনসংখ্যার একেবারে কাছাকাছি চলে আসবে মুসলিমরা। ৭ বছর অগের ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা ১৬০ কোটি ও খ্রিস্টান জনসংখ্যা ২১৭ কোটি। ২০৫০ সালে যেখানে খ্রিস্টান জনসংখ্যা হবে ২৯০ কোটির কাছাকাছি; সেখানে মুসলিমদের হবে ২৮০ কোটির কাছাকাছি। সমীক্ষায় বলা হয় এ অবস্থা চলতে থাকলে জনসংখ্যার দিক দিয়ে ২০৭০ সালে মুসলিম জনসংখ্যা শীর্ষে যাবে। সমীক্ষায় বলা হয়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৩.২ শতাংশ (তৃতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা) এমন মানুষ যারা কোনও ধর্মে বিশ্বাস করেন না। ২০৫০ সালে সেই ধর্মহীন জনসংখ্যাকেই ছাপিয়ে হিন্দুরা তৃতীয় স্থান দখল করবে। হিন্দু বা খ্রিস্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্বের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে একইহারে হলেও মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি বলে পিউ-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
 অপর এক সমীক্ষায় বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের এক ভাগ মুসলমান। কয়েক বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা যখন ছিল ৬৮০ কোটি (বর্তমানে বলা হয় ৭৩০ কোটি); তখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫৭ কোটি। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ ভাগ মুসলমান। এই মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ এশিয়ায় বসবাস করে। ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ২০ কোটি ৩০ লাখ মুসলমান বাস করে যা বিশ্বে মোট মুসলমান জনসংখ্যার প্রায় ১৩%। তা ছাড়া পাকিস্তানে ১৭ কোটি ৪০ লাখ, ভারতে ১ কোটি ৬১ লাখ, বাংলাদেশে ১৪ কোটি ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৩ কোটি জনসংখ্যার ৯৮ ভাগ মুসলমান এবং ইরান ও তুরস্কে ৭ কোটি ৪০ লাখ মুসলিম বসবাস করে। চীনের মুসলমানদের সংখ্যাও কম নয়। বিশ্বে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮৪%। সারাবিশ্বে যখন মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১ দশমিক চৌরাশি; তখন ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তাহলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদের টপকায় কেমন করে? আর চীনের যে অর্থনীতি এবং জনসংখ্যা তাতে ভারতের পক্ষ্যে টপকানো কী সম্ভব? চীন অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে গেছে। যে চীনের বর্তমান অর্থনীতি ভারতের ৫গুন বড়; সে চীনকে জনসংখ্যায়, অর্থনীতিতে পিছনে ফেলে উপরে উঠা ভারতের পক্ষ্যে কাল্পনিকভাবে সম্ভব; বাস্তবে নয়। যারা ২০৫০ সালে জনসংখ্যায় চীনের টপকে যাবে ভারত; অর্থনীতিতে চীনের পর্যায়ে যাবে ভারত বলে কল্পকাহিনী রচনায় মহাব্যস্ত তাদের অনুসারীদের মস্কিকের ফসল হলো বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে এমন তথ্য। আসলে হঠাৎ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, চীন-ভারত-বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিমের অনুপাত ইস্যু নিয়ে এতো প্রোপাগান্ডা কেন? জনসংখ্যা তথ্য নিয়ে এই ভেল্কিবাজীর রহস্য জনগণ চানতে চায়।



 

Show all comments
  • জাফর ১ জুন, ২০১৭, ৩:০৪ এএম says : 0
    আমার কাছেও বিষয়টা সেরকম মনে হচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ