পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
রফিকুল ইসলাম সেলিম : প্রবেশ পথের সড়কটি ভাঙ্গাচোরা, ভবনের ইট-সুড়কি খুলে পড়ছে, ফাটল ধরেছে কোন কোন অংশে, বৃষ্টি হলে পানি গড়ায়-এ চিত্র চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে। দীর্ঘ তের বছর বড় ধরনের কোন সংস্কার না হওয়া এমন জীর্ণদশা ১০৪ বছরে পুরাতন অনন্য স্থাপত্য শৈলীর এই দৃষ্টিনন্দন ভবনটি। অবহেলায় মলিন হলেও জাদুঘরে কমছেনা দর্শনার্থীর সংখ্যা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে জানতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি শত শত দর্শনার্থী ভিড় করছে এখানে। চলতি বছর গড়ে প্রতিদিন ৪১০ দেশি-বিদেশী দর্শনার্থী এসেছেন এই জাদুঘরে।
দর্শনার্থী আগমনের দিক থেকে দেশের তৃতীয় স্থানে থাকা এই সরকারি জাদুঘরটিতে ২০০৬ সালের পর আর কোন সংস্কার কাজ হয়নি। ‘টেকনিক্যাল’ কারণ দেখিয়ে জাদুঘরটি সংস্কারে কোন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে জরাজীর্ণ ভবনটিতে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ব্রিটিশ আমলে ১৯১৩ সালে নির্মিত পুরাতন সার্কিট হাউজ ভবনটি এখন জিয়া জাদুঘর। ৩৬ বছর আগে ১৯৮১ সালের ৩০ মে কালো রাতে এ ভবনে শাহাদাতবরণ করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ভবনের প্রতিটি কক্ষে জিয়াউর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনের অসংখ্য ঘটনাবহুল নিদর্শন স্থান পেয়েছে।
গতকাল (সোমবার) জাদুঘরটি ঘুরে এর দৈন্যদশা দেখা গেছে। দর্শনার্থীদের অনেকে তাদের হতাশার কথা জানান। তারা বলেন, জাদুঘরটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। জিয়ার নামে হলেও এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। পুরো ভবনটি মলিন হয়ে গেছে। জিয়া স্মৃতি জাদুঘর লেখা স্মৃতি ফলকটিতে কি লেখা তা বোঝার উপায় নেই। খসে পড়েছে ভবনের আস্তর। দরজা-জানালায় ধুলোবালির আস্তরণ। পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন বøু আর নতুন সার্কিট হাউজের মাঝখানে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটির দৈন্যদশা খুবই বেমানান। দর্শনার্থীরা বলছেন, অনাদর, অবহেলা চলতে থাকলে জাদুঘরটি দর্শক হারাবে। একজন দর্শনার্থী বলেন, এভবনটি একটি পুরাকীর্তি। এটি সংরক্ষণ করারও জরুরী।
রেডিসনের গেইট পার হলেই জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের সড়ক। সড়কটি অসংখ্য গর্তে ভরা। জানা যায় প্রথমবার বিটিসিএল এবং দ্বিতীয়বার ওয়াসা সড়কটিতে খোঁড়াখুড়ি করে। তাদের খোঁড়াখুঁড়ি শেষে নিয়ম অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন সড়কটি সংস্কার করার কথা থাকলেও তা করেনি। এই কারণে সড়কটির এখন বেহালদশা। জাদুঘরে আসার পথে দর্শনার্থীদের শুরুতেই হোঁচট খেতে হয়।
বিগত বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে এসে ভবনের কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জাদুঘরটি অবহেলিত হয়ে পড়ে। জাদুঘরের পক্ষ থেকে সংস্কারের জন্য তিন বছর আগে ৫০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে তা অনুমোদনের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়। তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। জিয়া জাদুঘরের নামে কোন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় না এ জেনেই দেশের সব জাদুঘরের উন্নয়নে একটি সমন্বিত প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না বলে জানান একজন কর্মকর্তা।
বড় প্রকল্প অনুমোদন না হলেও কিছু কিছু সংস্কার কাজ করা হতো জাদুঘরের উদ্যোগে। এখন তাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কারণ চলতি বছর থেকে জাদুঘরের বাজেটও ২৫ লাখ টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জাদুঘরের কিউরেটর মোঃ মতিয়ার রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সংস্কার কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তবে তাতে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন বড় ধরনের সংস্কার কাজ না হওয়ার বিষয়টি স্বীকারও করেন তিনি। জাদুঘরের সড়কটির সংস্কার কাজ খুবশিগগির শুরু করা যাবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, সংস্কার না হওয়ায় পুরাতন ভবনটি দূর্বল হয়ে পড়েছে।
সরকারী একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও জাদুঘরটিকে টিকিয়ে রাখার কোন উদ্যোগ নেই। এরপরও এখানে দর্শনার্থী আসছে। জাদুঘরটিতে রয়েছে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক এবং দুর্লভ অনেক ছবি ও দর্শনীয় বস্তু। সৈনিক-রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে। একজন পরিপূর্ণ জিয়াকে জানতে এবং বুঝতে এই যাদুঘরে আসছেন দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ। অনেকে আসেন দৃষ্টিনন্দন ভবনটি দেখতে। তবে ভবনের ভেতরে থাকা মানুষটির বর্ণাঢ্য জীবনগাথা তাদেরও নাড়া দেয়।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ৯২ হাজার ৩৩ জন দর্শনার্থী জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। তাদের মধ্যে বিদেশী আছেন ৮৭ জন। গেল বছরের একই সময়ে ৯০ হাজার ৩৬৮ জন দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করে। তাদের মধ্যে ১০৮ জন বিদেশী ৭ হাজার ৬৬৯ জন শিশু এবং বাকি ৮২ হাজার ৫৯১ জন প্রাপ্তবয়স্ক। সপ্তাহে ৫ দিন খোলা থাকে জাদুঘর। সে হিসেবে গড়ে প্রতিদিন ৪৩২ জন দর্শনার্থী এসেছে জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে। এবছর দিনে ৪১০জন জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। প্রতিবছর গড়ে সোয়া লাখ দর্শনার্থী আসে জাদুঘরে। জাদুঘরের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার জাতীয় জাদুঘর ও আহসান মঞ্জিলের পর সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী আসে জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে। দেশের ৫টি জাদুঘরের মধ্যে দর্শনার্থী আগমনের হারে জিয়া জাদুঘর তৃতীয়।
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সরকার জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণের স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজকে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৯৯৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং জিয়াউর রহমানের পতœী বেগম খালেদা জিয়া এই স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ভবনটিতে জিয়াউর রহমানের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন বই নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পাঠাগারও। সেখানে রয়েছে অভিজাত একটি অডিটোরিয়াম।
জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের ১৭ গ্যালারীতে প্রায় একক হাজারের বেশি বস্তুগত নিদর্শন রয়েছে। এক নম্বর গ্যালারীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা। দ্বিতীয় গ্যালারীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা নিদর্শন। কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণার স্মৃতি বিজড়িত বেতারযন্ত্রসহ নানান সামগ্রী সেখানে স্থান পেয়েছে।
তৃতীয় গ্যালারী সেক্টর ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের নানা কর্মকান্ড ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার এবং বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্তদের প্রোট্রেট। চতুর্থ গ্যালারীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সংঘটিত ঐতিহাসিক যুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত রণপ্রস্তুতির ঘটনা ডিউরমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গ্যালারি পাঁচে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে একটি পোস্ট অফিস স্থাপনের নিদর্শন। গ্যালারি ছয়-এ জিয়াউর রহমানের সংগ্রামী সৈনিক জীবনের নানা চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে জিয়াউর রহমানের সামরিক পোশাক, ব্যাগ, টুপি, ছড়িসহ নানা সামগ্রী।
সাত নম্বর গ্যালারিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে জিয়াউর রহমানর হাতে লিখা বিএনপির আদর্শ, উদ্দেশ্য সম্বলিত মেন্যুফেস্ট স্থান পেয়েছে। আট নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে জিয়াউর রহমানের বেশকিছু বিরল ছবি। নয় নম্বর গ্যালারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গভবনে অফিসকরাকালীন দৃশ্য। জিয়াউর রহমান নিজেই খাল কাটায় অংশ নেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এগার নম্বর গ্যালারিতে সার্কের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে রয়েছে সার্কভুক্ত ৭টি দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রোট্রেটসহ একটি ডিউরমা।
বার নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমানের বিদেশ সফরের বেশকিছু দুর্লভ ছবি। এর পাশাপাশি সেখানে রাখা হয়েছে নির্মম হত্যাকান্ডের পর বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের কাটিং। গ্যালারি তেরতে শোভা পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিদেশ সফরকালে বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের দেয়া উপহার সামগ্রী।
গ্যালারী চৌদ্দ এবং পনেরতেও বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর পাশাপাশি বিদেশ সফর এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বিদেশী সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের দুর্লভ অনেক ছবি। ষোল নম্বর গ্যালারিতে আসলেই দর্শকদের চোখ আটকে যাবে সেখানে রাখা একটি খাট তারপাশে রাখা ছোট্ট টেবিল এবং তার উপর একটি প্লাসের দিকে।
শাহাদাতের পূর্বমুহূর্তে এ কক্ষেই রাত্রি যাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। খাটের পাশে মেঝেতে রাখা কার্পেট এবং কক্ষ থেকে বের হওয়ার পথে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ এবং বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে এখনও। ওই কক্ষেই ঘাতকের তপ্ত বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যায় জিয়াউর রহমানের শরীর। শাহাদাত গ্যালারি হিসেবে পরিচিত এ গ্যালারি থেকে বের হলেই গ্যালারি নম্বর সতের। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের শাহাদাত বরণের পর জিয়াউর রহমানের লাশ গোপনে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে রাঙ্গুনিয়ার জিয়ানগরে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দাফন করা হয়। পরে সেখান থেকে লাশ তুলে নিয়ে ঢাকায় তাকে দাফন করা হয়। রাঙ্গুনিয়ার প্রথম মাজার এবং ঢাকার মাজারের চিত্র ডিউরমার মাধ্যমে এ গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।