Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত পেরিয়ে

| প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গভীর সমুদ্রে সৃষ্ট প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছিল। ঘুর্ণিঝড়টি ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করে উপক’লের কয়েকশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর সোমবার দেশের উপক’লীয় জেলাগুলোতে ১০ ও ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে কর্মরত সকল মাছধরা জাহাজ ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ জারি করা হয়। উপদ্রæত উপক’লীয় জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষকে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য রবিবার ও সোমবার স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। মঙ্গলবার সকাল নাগাদ বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপক’লে মোরা আঘাত হানবে বলে আবহাওয়া দফতর থেকে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল তা সঠিক ছিল। তবে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকুলে প্রথম আঘাত হানার পরই ঘুর্ণিঝড়টি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ায় তা দেশের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে মওসুমী সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের বিরুদ্ধে পূর্ণ সতর্কতা ও প্রস্তুতি থাকা সত্বেও মোরা শেষ পর্যন্ত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে না আনলেও শত শত বাড়িঘর, গাছপালা, স্থাপনা ও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত ঘূর্ণীঝড় মোরা দেশের বিভিন্ন উপক’লীয় অঞ্চল অতিক্রম করছিল। তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান পাওয়া না গেলেও পূর্ব সতর্কতা, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং লাখ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার কারণে মোরা’র আঘাত দেশের জন্য মহাবিপর্যয় হয়ে উঠেনি।
মোরা উপক’ল অতিক্রম করে ক্রমশ দুর্বল হয়ে দেশের অভ্যন্তরে নিম্মচাপে পরিণত হতে পারে বলে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল। সেই সাথে মোরার বিপদ কাটতে অন্তত ৮ থেকে ১২ ঘন্টা সময় লাগতে পারে বলেও আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে। মোরার প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ার ও জলোচ্ছ¡াসে উপক’লীয় এলাকার নিম্নভ’মি তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের দক্ষিন ও মধ্যাঞ্চলে থেমে থেমে বৃষ্টিপাতসহ ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করছে। দেশের মানুষ যখন ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, তখন মোরার অপেক্ষাকৃত দুর্বল আঘাতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। মোরা’র প্রভাব ও  বিপদ সঙ্কেত প্রত্যাহারের আগেই কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, পটুয়াখালি, নোয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, ফেনী, বরগুনা, বরিশালসহ উপক’লীয় জেলাগুলোর শত শত আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লাখ লাখ মানুষ মঙ্গলবার সকালেই বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করে। মোরা উপদ্রুত অঞ্চলে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে পড়ার চিত্র টিভি ক্যামেরায় উঠে এসেছে। কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পূর্নাঙ্গ হিসাব পাওয়া না গেলেও লাখ লাখ মানুষ নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে না আসলে প্রানহানির সংখ্যা হয়তো অনেক বেশী হতে পারতো। মোরা আঘাত হানার দুইদিন আগে থেকে বিশেষ সতর্কতা জারি এবং নানামুখী ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় মনিটরিং ও তাৎক্ষনিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলেও জানা যায়। এ ধরনের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সফলতার সাথে মোকাবেলা করায় আবহাওয়া দফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।
দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের জনগনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য রয়েছে। বিগত দশকে সামুদ্রিক সাইক্লোন আইলা ও সিডরের মত মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। বন্যা, সাইক্লোনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে এ দেশের সাহসী মানুষ বার বার ঘুরে দাড়িয়েছে। তবে প্রতিটা প্রাকৃতিক দুর্যোগই দীর্ঘমেয়াদী জনভোগান্তির স্বাক্ষর রেখে যায়। আইলা ও সিডরে বিদ্ধস্ত বেড়িবাধগুলো এখনো পুন:নির্মান করা সম্ভব হয়নি। দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতি, মাথাভাঙ্গাসহ ছোটবড় নদী উপচানো জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে। ঘূর্ণিঝড় মোরা আঘাত হানার আগেও অস্বাভাবিক জোয়ার ও জলোচ্ছাসে কয়েকটি উপকুলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আরো অনেকগুলো বেড়িবাধ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। হাওরের সাম্প্রতিক বন্যায়ও অনেকগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছরই মওসুমী ভারীবৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঢলে হাওরাঞ্চলে লাখ লাখ টন ফসলহানি ঘটে। হাওরে এবারের ক্ষয়ক্ষতি লাখো কৃষকের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ঘূর্ণিঝড় মোরা মোকাবেলায় আবহাওয়া অধিদফতর, ত্রাণমন্ত্রনালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন প্রশংসনীয় তৎপরতা চালালেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন কার্যক্রম সমস্যার স্থায়ী সমাধান কেন সম্ভব হচ্ছে না, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলের সক্রিয় তৎপরতা ও আগাম প্রস্তুতির কারনে মোরায় প্রানহানি কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও ঝড়ের ধ্বংসলীলা যেন আর কোন দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে না দাড়ায় সে বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সামনের দিনগুলোতে আরো কয়েকটি প্রাকৃতিক দুযোর্গের আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। উপক’লীয় জনগন মোরা’র ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে খুব দ্রুত স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততায় ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হবেন, এই প্রত্যাশা আমাদের।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন