Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

লক্ষ্য নির্বাচন : বড়ো দুই দলের আগাম প্রস্তুতি

| প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি হাতে নিয়ে এগোচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরো আগে থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তার দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহŸান জানিয়েছিলেন বছরখানেক আগেই। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন সরকার হয়তো আগাম নির্বাচন দেবে। কিন্তু রাজনৈতিক বোদ্ধামহল তখনই বলেছিলেন, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে এ সরকার নির্বাচন দেবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই নির্বাচনী মাঠের একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে যারা দলটির সংসদ সদস্য, তাদের কারো কারো আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বলেছেন, জনবিচ্ছিন্ন বা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি এবং নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন, তারা এবার মনোনয়ন পাবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপিদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওয়ি শুরু হয়েছে। কার ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটে তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন। তবে, রাজনীতি সচেতন মহল মনে করছেন, এবার শেখ হাসিনা খুব ভেবে চিন্তে ভোটযুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধা পাঠাবেন। কেননা, গত দশ বছরে তার দলের কতিপয় সংসদ সদস্যের কর্মকাÐে দলের ভাবমর্যাদা যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী এটাও উপলব্ধি করছেন যে, আগামী নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা হবে না। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’ ছাড়া নির্বাচনে যাবো না বললেও শেষ পর্যন্ত তারা ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে এটাও তিনি বুঝতে পারছেন। বিএনপি নির্বাচনে এলে মাঠের চিত্র পাল্টে যেতে পারে এবং নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ নাও হতে পারে। আর সে জন্যই তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন তিনি চান না। ২০১৪ সালে তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে শিরোপা ঘরে তুললেও এবার আর সে রকম সম্ভব হবে না। পুরো সময় প্রতিপক্ষের সাথে খেলেই জয় করায়ত্ত করতে হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্যকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের কথা হলো, প্রতিপক্ষকে মেকাবিলার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেয়াই সঠিক কাজ। সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ অত্যন্ত শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এমন সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে এগোনোই কুশলতার পরিচায়ক। লক্ষণীয় হলো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের নানা ধরনের উপদেশ দিয়ে চলেছেন। দলের কোন্দল মিটিয়ে ফেলা, একসঙ্গে মিলেমিশে দলের স্বার্থে কাজ করার জন্য তিনি সবাইকে নির্দেশনাও দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থানকে আরো সংহত করার জন্য নানা পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অবলম্বন করে চলেছে।
অপরদিকে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত ১০ মে ভিশন-২০৩০ নামে তার দলের সুদূর প্রসারি এক কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। তার এ কর্মসূচী দেশের সর্বমহলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০ একটি সময়োপযোগী রাজনৈতিক ও উন্নয়ন প্রস্তাব বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা যদিও আওয়ামী লীগ ভিশন-২০৩০ কে অন্তঃসারশূন্য এবং তাদের রূপকল্প-২০২১ এর অনুকরণ বলে অভিহিত করেছে। আওয়ামী লীগের এ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবগুলো যে জনমনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে, তা আওয়ামী লীগের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকেই অনুমান করা যায়। বোধকরি আওয়ামী লীগ আশঙ্কা করছে যে, জনগণ যদি বিএনপির ভিশন-২০৩০ গ্রহণ করে ফেলে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে যেতে পারে। অবশ্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল এটাও বলছেন যে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই বিএনপির আগামী নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মন্তব্য করেছেন, ভিশন-২০৩০ ইতিবাচক, কিন্তু এর বাস্তবায়ন কঠিন। কেননা, এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা নেই। আর সে জন্যই অনেকে এ ভিশন ঘোষণাকে বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন।
বিএনপিকে তৃণমূল থেকে সুসংগঠিত করতে ৫১টি বিশেষ টিম এখন সারাদেশে সফর করছে। এসব টিম জেলা পর্যায়ে সফর করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী করার কাজে নিয়োজিত আছে। কিন্তু যে বিষয়টি বিএনপির শুভানুধ্যায়ীদের ভাবিয়ে তুলেছে তাহলো, এ কর্মসূচী বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, নাকি দলের মধ্যে কোন্দল বিভাজনকে আরো প্রকট করে তুলবে। কেননা, বিশেষ টিমগুলো সফর শুরু করার পর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জেলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল, রাজশাহী, জয়পুরহাট, এমনকি ঢাকা জেলার কর্মী সম্মেলনও বিবদমান গ্রæপের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ঢাকা জেলার কর্মী সম্মেলনে সংঘর্ষের খবরে ক্ষুব্ধ চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ভাইস-চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ আমানকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেছেন বলে পত্রিকায় কবর বেরিয়েছে।
আধিপত্য বিস্তার, আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ এবং পদ-পদবীজনিত দ্ব›েদ্ব বিএনপিতে ব্যাপক কোন্দলের খবর নতুন নয়। এসব কোন্দল ও তৎজনিত কারণে সংঘাত-সংঘর্ষের খবর মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে উঠে আসে। সেসব খবরের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও হতাশার কথাও থাকে। পাশপাশি দলের চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তার দলীয় বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ, দলের ভেতরে কোন্দল সৃষ্টি, দলের প্রকৃত অবস্থা চেয়ারপার্সনকে অবহিত না করা, বিশেষ কোটারি সৃষ্টি করে দলের স্টিয়ারিং নিজেদের হাতে রাখা, এসব অভিযোগও বারবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
অপরদিকে একই বিষয়ে বিএনপি নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন কথা বলাও সচেতন মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে দলটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আদৌ অংশ নেবে কিনা- এ বিষয়ে কেউই সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না। মহাসচিব মির্জা আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের কথা জোরে শোরে বললেও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ আরেক দল নেতা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচন হবে না বলে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। রাজনৈতিক সচেতন মহল আশঙ্কা করছেন, সরকার নির্বিঘেœ নির্বাচনী সাগর পার হওয়ার জন্য বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে সে রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারে’র দাবিতে যদি বিএনপিকে আবারো কোনো অপরিণামদর্শী আন্দোলনে ঠেলে দেয়া যায়, তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে সহজেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিএনপিতে এখন দুই ধারার মত অত্যন্ত প্রবল। এ বিষয়ে গত ২১ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে দুই মত’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ‘দলটির বড় একটি অংশ বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর অধীনে কিছুতেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। তাদের ভাষ্য-শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে না। অন্যদিকে উদার পন্থী অংশটি আলোচনার পথ খোলা রেখে দর কষাকষির মাধ্যমে কিছু দাবি আদায় করে নির্বাচনে যাবার পক্ষে। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পত্রিকাটিতে বলেছেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য দেখে মনে হয়, তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তিনি বলেন, আগে ভাগেই অমুকের অধীনে নির্বাচনে যাব না বলে শর্তে জুড়ে দেয়া ঠিক নয়। যারা এমন শর্ত দেন তাদের কাছে প্রশ্ন বিএনপি নির্বাচনে যাবে না কী হাওয়া খাবে ?’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুধু নন, বিএনপিকে যারা অবলোকন বা পর্যবেক্ষণ করেন তাদের সবার কাছেই এই সমন্বয়হীনতার বিষয়টি প্রকটভাবেই ধরা পড়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা সমন্বয়হীনতা। সেটা নেতাদের বক্তব্য-মন্তব্য কিংবা সাংগঠনিক কর্মকাÐ যেটাতেই হোক। সমন্বয়হীনতা যখন কোনো রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়, তখন সে দলের বিপর্যয়ের খাদে পড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বিএনপিকে যদি আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়, আগামী নির্বাচনী লড়াইয়ে যদি কোমর শক্ত করে অবতীর্ণ হতে হয়, তাহলে সমন্বয়হীনতা, কোন্দল, নেতাদের কোটারি স্বার্থের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন